আগরবাতি: রীতি, বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতি ও আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণা

যারা নিয়মিত আগরবাতি ব্যবহার করেন। তাদের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়।

প্রকাশিত: ২:৪৭ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩

নেজা ডেস্কঃ
আতর ও সুগন্ধি ইসলামের পছন্দ। এর সূত্র ধরে গোটা পরিবেশ সুগন্ধিময় করতে পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার মধ্যে আগরবাতির প্রচলন ঘটে। আগরবাতি হলো কাঠিতে মসলামাখা সুগন্ধিযুক্ত এক ধরনের বাতি। আগরবাতিতে আগুন জ্বালালে তা ধীরে ধীরে পুড়ে চারপাশে সুগন্ধি ছড়ায়।

আগরবাতি উৎপাদন কুটির শিল্পের অন্তর্গত। সাধারণত বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠানে আগরবাতি জ্বালানো হয়। আগরবাতি জ্বালালে ঘরের পরিবেশ ও চারপাশ সুগন্ধে ভরে যায়। মন্দির, মসজিদ, গির্জা প্রভৃতি উপাসনালয়ে এবং বাড়িতে পূজা বা মিলাদে আগরবাতি ব্যবহার করা হয়।

 

এ ছাড়া সুগন্ধি হিসেবে অনেকে প্রতিদিন ঘরে বা দোকানেও আগরবাতি ব্যবহার করেন। স্থানীয় বাজার, থানা শহর অথবা উপজেলা শহরে আগরবাতি বিক্রি করা যায়।কিন্তু আবহমান এই রীতিতে চ্যালেঞ্জ করছে আধুনিক গবেষণা। ২০১৫ সালে সাউথ চায়না ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গবেষণা করেন।

তারা ধূপকাঠির সাধারণ উপাদান আগর কাঠ ও চন্দনকাঠের ওপর গবেষণা করে বলেন, আগরবাতির ধোঁয়া শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর।বিজ্ঞানীরা বলেন, আগরবাতি জ্বালিয়ে এর ধোঁয়া গ্রহণ করা আর ক্যান্সারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা একই ব্যাপার। সিগারেটের ধোঁয়া যেমন ক্ষতি করে, একই ক্ষতি করে আগরবাতির ধোঁয়া। বিজ্ঞানীরা বলেন, ধূপকাঠির ধোঁয়ায় তিন ধরনের টক্সিন আছে, যা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। ওই তিন টক্সিন হলো—মিউটাজেনিক, জেনোটক্সিক ও সাইটোটক্সিক।

যে ধরনের ক্ষতি হতে পারেঃ
শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ: গবেষণায় দেখা গেছে, জ্বলন্ত আগরবাতির ধোঁয়ায় কার্বন মনোঅক্সাইড পাওয়া যায়। যা নীরব ঘাতক নামে পরিচিত। এ ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে ফুসফুসের প্রদাহ বাড়ায়। শ্বাসতন্ত্রে জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও এ ধোঁয়া কাশি ও হাচি সৃষ্টি করে।

ফুসফুসের রোগ ও অ্যাজমা: আগরবাতির ধোঁয়ায় রয়েছে সালফার ডাইঅক্সাইড, ফরমালডিহাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড। যা নাকের মধ্যদিয়ে সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগ ও অ্যাজমা সৃষ্টি করে।

ত্বকের অ্যালার্জি: বিশেষ করে বাচ্চা ও বৃদ্ধদের ত্বকের অ্যালার্জি হয় আগরবাতির সংস্পর্শে এলে। এছাড়া চোখ জ্বালাপোড়ার সমস্যাও হতে পারে।

স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা: আগরবাতি পোড়ালে যে ধোয়া উৎপন্ন হয়। তা রক্তে কার্বন মনোঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। যা স্নায়ুতন্ত্রের নানাবিধ সমস্যা তৈরি করে।

শ্বাসতন্ত্রের ক্যান্সার: আগরবাতির ধোঁয়ায় কারসিনোজেন পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এটি শ্বাসতন্ত্রের ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

কিডনির সমস্যা: এ ধোঁয়া দেহের বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। যা দেহ থেকে অপসারণ করতে কিডনি ব্যর্থ হয়। ফলে কিডনি বিকল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

হৃদরোগ: যারা নিয়মিত আগরবাতি ব্যবহার করেন। তাদের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়।

সুতরাং আসুন আগরবাতির ব্যবহার বন্ধ করার চেষ্টা করি। একান্তই দরকার হলে জন সমাগম থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার চেষ্টা করি।

ইসলামিক দৃষ্টিতেঃ
আগরবাতি একটি সুগন্ধি। এটার ব্যবহার জায়েজ আছে।হযরত না’ফে রাহ বলেন,

ﻋَﻦْ ﻧَﺎﻓِﻊٍ ﻗَﺎﻝَ : ﻛَﺎﻥَ ﺍﺑْﻦُ ﻋُﻤَﺮَ ﺇِﺫَﺍ ﺍﺳْﺘَﺠْﻤَﺮَ ﺍﺳْﺘَﺠْﻤَﺮَ ﺑِﺎﻟْﺄَﻟُﻮَّﺓِ ﻏَﻴْﺮَ ﻣُﻄَﺮَّﺍﺓٍ ﻭَﺑِﻜَﺎﻓُﻮﺭٍ ﻳَﻄْﺮَﺣُﻪُ ﻣَﻊَ ﺍﻟْﺄَﻟُﻮَّﺓِ ﺛُﻢَّ ﻗَﺎﻝَ ﻫَﻜَﺬَﺍ ﻛَﺎﻥَ ﻳَﺴْﺘَﺠْﻤِﺮُ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ .

হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) অভ্যস্ত ছিলেন যে, যখন তিনি সুগন্ধির ধোয়া নিতেন, তখন সুগন্ধিযুক্ত কাঠের উদ (চন্দন কাঠ) ধোয়া নিতেন। তিনি এর সাথে কোন কিছু মিলাতেন না। আবার (কখনো) চন্দন কাঠের সঙ্গে কর্পূর ছিটিয়ে দিতেন। তারপর বলতেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রকমভাবে সুগন্ধি জ্বালাতেন। [সহীহ মুসলিম-২২৫৪(শামেলা)(ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫৬৮৮, ইসলামিক সেন্টার ৫৭১৯), মিশকাতুল মাসাবিহ-৪৪৩৬]

হিন্দু ধর্ম মতেঃ
প্রদীপ জ্বালানো হিন্দু পুজোর আবশ্যিক ব্যাপার। বৈদিক যুগে অবশ্য প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা ছিল না। কারণ তখন হোম-যজ্ঞ হত। মনে করা হয় যে বৈদিক হিন্দুত্বের বাইরেও যে সনাতন ধর্ম রয়েছে সেখান থেকে এই প্রথাটি এসেছে। যদিও বৈদিক হিন্দুত্বের বাইরে যে সনাতন ধর্ম রয়েছে সে সম্বন্ধে আমরা খুব একটা জানি না। যবে থেকে হিন্দুরা সাকার দেব-দেবীর পূজা শুরু করে তবে থেকে এই প্রথা শুরু। ভাগবত গীতার ৯.২৬ শ্লোকে ভগবান কৃষ্ণ বলছেন যে শুধু মাত্র একটি ফল, একটি ফুল, গাছের একটি পাতা ও অল্প জল দিয়ে যদি ভক্তরা তাঁকে পুজো করেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট। এই শ্লোকটিতে ভগবান কৃষ্ণ কোথাও দীপ জ্বালানোর কথা বলেননি।

সমস্ত হিন্দুর মধ্যে, তা সে বৈদিক হোক বা পৌরাণিক, নিগমীয় হোক বা অগমীয় অথবা শ্ৰৌত বা স্মার্ত– তাঁদের পুজোর ধরন অনেকটা একই রকম: তাঁরা প্রথমে ঈশ্বরকে আহ্বান করেন, তারপর তাঁকে নৈবেদ্য উৎসর্গ করে ভক্ত সেই প্রসাদ পান। এরপর ভক্ত তাঁর কাছে কোনও বর চান। সব শেষে বিসর্জন।

বৈদিক যুগে এ ভাবেই ঈশ্বরের পুজো হত। তখন প্রদীপের জায়গায় ছিল মাটির হোমকুণ্ড। হোমকুণ্ডে কাঠ জ্বালান হত। এই যজ্ঞকুণ্ডকে পূজা করা হত ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া হত, সঙ্গে চলত বৈদিক মন্ত্রপাঠ।

দুহাজার বছর আগে যখন পুরাণ রচিত হল, তখন ঈশ্বর আর নিরাকার রইলেন না, ওই সময় তাঁরা সাকার হয়ে উঠলেন। সেই সময়ের পুজোর সঙ্গে এখনকার পুজোর অনেক মিল পাওয়া যায়। পুজোর অঙ্গ হিসেবে যেমন – স্নানাভিষেক, বস্ত্র, নৈবেদ্য, গন্ধদ্রব্য, ধুপ ও দীপ সহযোগে পুজো শুরু হয়। এই পুজোয় অবশ্য ঘৃতাহুতি দেওয়ার জন্য আগুন জ্বালানো হত না, পুজোর চারপাশ যাতে আলোকিত হয়ে ওঠে, কোথাও কোনও অন্ধকার না থাকে সে জন্য আলো বা দীপ জ্বালানো হত।

বিঃদ্রঃ দয়া করে কেউ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেননা। যার যার ধর্ম তাকে পালন করতে দেওয়াই আবশ্যক।