আজ মগড়ার নীরব কান্না দেখার কেউ নেই : দূষণ এবং দখলরোধে করণীয়
দুই তীরে গড়ে উঠছে ছোট বড় ১৫৭ টি অবৈধ স্থাপনা। মগড়া নদী রক্ষার দাবিতে স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্মারকলিপিও দিয়েছে। কিন্তু কোন প্রতিকার হয়নি।
নদী আবহমানকাল ধরে মানুষের আশ্রয়। নদী শুধু একটি নদী নয়। একটি নদী একটি জনপদ, একটি সভ্যতা, একটি ইতিহাস। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে খুব স্বাভাবিকভাবেই সভ্যতার নামের সাথে জড়িয়ে আছে, নদীর নামটিও। ক্ষেত্রবিশেষে নদীর নামেই গড়ে উঠেছে সভ্যতা, স্থাপত্য সাম্রাজ্য। নদীর গতিপথ, নদীর চরিত্র আর নদীর মানচিত্রই একসময় হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্য স্থাপনের, সাম্রাজ্য চিহ্নায়নের, সাম্রাজ্য পরিচালনার মূল সূত্র। মগড়া এমনই একটি ইতিহাসের নাম। যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে আমাদের কাঁদামাটির ইতিহাস। কালের বিবর্তে আজ মগড়ার নীরব কান্না দেখার কেউ নেই।
ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে মগড়ার উৎপত্তি। সেনেরচর নামক স্থান থেকে খড়িয়া নদী বেয়ে সারাসরি মগড়া নদীর প্রবাহ। সে প্রবাহ ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বুড়বুড়িয়া বিলে এসে পতিত হয়েছে। বুড়বুড়িয়া বিল থেকে বেরিয়ে গজারিয়া ও রাংসা নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়ে ফুলপুরের ঢাকুয়া নামক স্থানের ভেতর দিয়ে সরাসরি পূর্বদিকে ধলাই নামে প্রবাহিত হয়েছে। পূর্বধলা উপজেলার হোগলা বাজারের পাশ দিয়ে পূর্বধলা সদরের ভেতর দিয়ে ত্রিমোহনী নামক স্থানে এসে দক্ষিণেপ্রবাহিত হয়েছে। ত্রিমোহনীতে এসে ধলাইয়ের সঙ্গে উত্তর দিক থেকে এসে লাউয়ারী নদী মিলিত হয়েছে। সে স্থান থেকে মগড়া নামে পরিচিত। সেখান থেকে প্রথমে পাঁচ মাইল পর্যন্ত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে দয়াগঞ্জ ঘাট থেকে সরাসরি পূর্ব দিকে আকাঁবাকা হয়ে নেত্রকোণা শহরের পাশ দিয়ে আটপাড়া উপজেলার দিকে চলে গেছে।
পশ্চিম দিক থেকে শ্যামগঞ্জ হয়ে দয়াগঞ্জ ঘাটের কাছে মগড়ার সঙ্গে ধলাই নামের একটি স্রোতধারা মিলিত হয়েছে। নেত্রকোণা জেলার ঠাকুরাকোণা থেকে কংস নদী একটি শাখা নদী আটপাড়ায় মগড়ার মিলিত হয়েছে। গৌরীপুর দিক থেকে ছুটে আসা পাটকুড়া নদীটি বসুর বাজার এলাকায় এসে মগড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সাউডুলি, মগড়া ও পাটকুড়ার মিলিত স্রোতেকেন্দুয়ার গুগবাজার কাছে এসে যোগ হয়েছে। সেখানে বর্ষায় স্রোতেপ্রবাহ আনুপাতিক হারে বেশি থাকে। গুগবাজার হয়ে সে নদীটি মদন হয়ে ধনু নদীতে পতিত হয়েছে। নেত্রকোণা জেলায় মগড়া নদীর গতিপথ সব চেয়ে বেশি। এ নদীটি কোথাও ধলাই নামে কোথাও মগড়া নামে খ্যাত।
এ জেলার চারশ বর্গ মাইল এলাকা দিয়ে মগড়া নদীর প্রবাহ রয়েছে। মগড়া কংস নদী ৮/১০ মাইল ব্যবধানে প্রায় ৪০ মাইল সমান্তরায় ভাবে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে।
মগড়া নদীর উৎপত্তিস্থল দেখানো হয়েছে ধলাই এবং সোয়াইন নদীর সংযোগস্থল এবং পতিতস্থল ঘোড়াউত্রা নদী। সেনেরচর থেকে খড়িয়া নদী বেয়ে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বুড়বুড়িয়া বিল, ঐ বিল থেকে বেরিয়ে গজারিয়া ও রাংসা নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়ে ফুলপুরের ঢাকুয়া-র ভেতর দিয়ে সরাসরি পূর্বদিকে ধলাই নামে প্রবাহিত হয়েছে। পূর্বধলার হোগলা বাজারের পাশ দিয়ে পূর্বধলা সদরের ভেতর দিয়ে ত্রিমোহনীতে এসে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। সে স্থান থেকে মগড়া নামে পরিচিত। সেখান থেকে প্রথমে পাঁচ মাইল পর্যন্ত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে দয়াগঞ্জ ঘাট থেকে সরাসরি পূর্ব দিকে আকাঁবাকা হয়ে নেত্রকোণা শহরের পাশ দিয়ে আটপাড়া হয়ে মদন হয়ে ধনু নদীতে পতিত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে মগড়ায় মিলিত হয়েছে লাওয়ারী নদী, ধলাই, কংসের শাখা, সাইডুলি, পাটকুঁড়া নদী-শাখানদী। নেত্রকোণা জেলায় মগড়া নদীর গতিপথ সব চেয়ে বেশি। নদীটি কোথাও ধলাই নামে, কোথাও মগড়া নামে খ্যাত। এ জেলার চারশ বর্গমাইল এলাকা দিয়ে মগড়া নদীর প্রবাহ রয়েছে। মগড়া ও কংস নদী ৮/১০মাইল ব্যবধানে প্রায় ৪০ মাইল সমান্তরালভাবে প‚র্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে।
বর্তমান সময়ের সবগুলো নদনদী কোননাকোন সমস্যায় জর্জররিত। তবে উল্লেখযোগ্য হলো নানা উপায়ে নদীকে দূষিত করা। নদীর পানিকে দূষিত করা। নদীর বিভিন্ন পাড় দখল করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে আটকিয়ে মৃতপ্রায় করে ফেলা। অতীতে বহুনদী এভাবে বিলীন হয়েছে প্রকৃতিতে। নিম্নে আমরা মগড়ার দূষণ ও দখল নিয়ে আলোচনা করছি।
নেত্রকোণা শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এককালের প্রমত্তা মগড়া নদীটি এখন দখল ও দূষণের শিকার হয়েছে। কালের বিবর্তনে মগড়া আজ তার সব ঐতিহ্য হারিয়ে ক্ষীণখালে এবং মানুষের অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এখানে নেই আগের সেই স্রোত। এখন চলছে নদীর তীর দখলের প্রতিযোগিতা।
দুই তীরে গড়ে উঠছে ছোট বড় ১৫৭ টি অবৈধ স্থাপনা। মগড়া নদী রক্ষার দাবিতে স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্মারকলিপিও দিয়েছে। কিন্তু কোন প্রতিকার হয়নি। যে ভাবে নদীর তীর দখলে প্রতিযোগিতা চলছে- তাতে একদিন হয়ত আমাদের মাঝে এই নদী আর থাকবে না। তাতে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে। কিছুদিন আগে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও মাত্র তিনটি স্থাপনা উচ্ছেদ করে অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে এই বিষয়ে আর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ‘মগড়া’ বাংলাদেশের অজস্র মৃতপ্রায় নদীগুলোর একটি। ‘মগড়া’ নামের আভিধানিক অর্থ উত্তাল। বলাইবাহুল্য যখন মগড়া’র নামকরণ করা হয়েছিলো তখন মগড়া ছিলো দুর্দান্ত যৌবনে, মানুষের কাছে ছিলো আতঙ্ক। কিন্তু কালের করাল গ্রাসে আর মানুষের আপোষহীন ভূমিকায় এখন নদীটি’র মতোই ‘মগড়া’ নামটিও নিয়েছে ভিন্ন অর্থ। এখন মগড়া মানেই যেনো- নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ, ধুকে-ধুকে মরা।
এই দূষণ ও দখলের ফলে মগড়া থেকে হারিয়ে গেছে নানা ধরণের মাছ। আমরা হারিয়েছি আমাদের ঐতিহ্যবাহী মহাশূলসহ অনেক প্রজাতির মাছ। নেই শুশুক, কচ্ছপসহ বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রাণী। এ নদীর গতিপথ ও নাব্যতা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। ফলে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টি হলেই নদীর দুই তীর উপচে প্রায়শই বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া, নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত পলিথিন, ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন নদীতে। এতে করে নদীর পানি দ‚ষিত হয়ে গেছে। শিশুরা এ ময়লা পনিতে নেমে গোসল ও খেলাধুলা করায় তাদের সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, পেটেরপীড়া, চর্মরোগসহ নানান রোগব্যাধি হচ্ছে। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগেও এই মগড়া নদী ছিল ভরা যৌবনা। সারা বছর কলকল করে বয়ে চলত পরিষ্কার পানি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নদীর তীরবর্তী অনেক জায়গা অবৈধ দখলে চলে গেছে। মোক্তারপাড়া ও রেল স্টেশন রোড এলাকার এ নদী তীর দখল করে অনেকেই তৈরি করেছেন বহুতল ভবন। জেলা প্রশাসন থেকে সম্প্রতি, এ নদী তীর দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
মগড়া নদী ও তার হারিয়ে যাওয়া নাব্যতা রক্ষায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বারসিক, জনউদ্যোগ, নদী বাঁচাও আন্দোলন নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন নদীর তীরে লংমার্চ করে জনসচেতনতা সৃষ্টি, বিভিন্ন সভা সমাবেস ও সেমিনার, মগড়া দূষণ মুক্ত করতে জেলা প্রশাসক ও পৌরমেয়রকে চিঠি প্রদান, মানববন্ধ ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সাংবাদিকবৃন্দ মগড়ার বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, নিউজ চেনেলে খবর পরিবেশনের মাধ্যমেও কিছুটা দাঁড়িয়েছে মগড়ার পাশে।
মগড়া রক্ষায় পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) নানা মুখি পদক্ষেপ নিয়েছে। নেত্রকোণায় নদীরক্ষায় বিভিন্ন সেমিনার এর আয়োজন করেছে। এর মাধ্যমে নদীপাড়ের মানুষগুলো যেন নদীতে ময়লা আবর্জনা না ফেলে, তাদের কাউন্সিলিং এর ব্যাবস্থা করেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে মগড়া নদী নিয়ে কোন ব্যাক্তি বা কোন সংস্থার সাথে কোন মামলা নেই।
মগড়া নদী দূষণ এবং দখলরোধে কি কি করণীয় তা হলো- ১। নদীর সীমানা নির্ধারণ, ২। দখল মুক্তকরণ, ৩। নদী খনন, ৪। নদীপাড়ে বৃক্ষরোপণ, ৫। নদীতে ড্রেন নিষ্কাশন বন্ধকরণ, ৬। আবর্জনা না ফেলতে নদীপাড়ের মানুষদের সচেতন করা।, ৭। নদীতে পয়ঃনিষ্কাশন বন্ধে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ, ৮। বাজার কেন্দ্রীক মগড়ার পারে রেলিং ও বৃক্ষরোপণ করে সৌন্দর্যবর্ধন করা।, ৯। শহর কেন্দ্রীক দখল উচ্ছেদ করে বৃক্ষরোপণ, রেলিং ও ওয়াকওয়ে তৈরি করা।, ১০। পানী ব্যাবহার উপযোগী রাখা।
লেখকঃ
মুহা. জহিরুল ইসলাম অসীম
সাংবাদিক