
ইসলামিক জার্নাল ডেস্ক :
প্রিয় নবীজীর ডাকে সর্বপ্রথম যাঁরা সাড়া দেন, পাশে এসে দাঁড়ান, জীবন-মরণ সঁপে দেন পবিত্র ইসলামের তরে। তাদেরই অন্যতম হযরত আবু বকর, হযরত বেলাল, হযরত খাব্বাব, হযরত সুহাইব, হযরত আম্মার ও হযরত সুমাইয়্যা রা.। সে ছিল এক ভয়ঙ্কর অত্যাচারী যামানা।
ভাগ্যবানদের ইসলাম গ্রহণের এক একটি সংবাদ বিষাক্ত তীর হয়ে বিদ্ধ হতো বেঈমান আবু জেহেলদের অন্ধ আত্মায়। তারা ক্ষুব্ধ হতো হিংস্রতায়। ফেটে পড়তো তারা। সেই ক্ষোভ ক্রোধ ও হিংস্রতা এক সময় চরম পাশবিক জঘণ্যতার রূপ নিল। তারা জোর করে ইসলামকে প্রতিহত করবে ভাবল।
সত্যের যে প্রদীপ জ্বেলেছেন স্বয়ং প্রভু তারা সেই প্রদীপ নিভিয়ে দিতে চাইল। মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন বেশ শক্তিশালী। বংশের শক্তি, বিত্তের বল সবই ছিল তাদের। যেমন হযরত আবু বকর রা.। কিন্তু অনেকেই ছিলেন এমন যাদের কোন শক্তি ছিল না। বংশেরও না, বিত্তেরও না! হযরত বেলাল, হযরত সুহাইব, হযরত আম্মার, হযরত ইয়াসির ও হযরত সুমাইয়্যা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) তাঁদেরই মধ্যে। হযরত আম্মার রা.-এর মা হযরত সুমাইয়্যা। বাবা হযরত ইয়াসির।
তিনি ছিলেন মূলত কাতানের অধিবাসী।
হারানো ভাইয়ের সন্ধানে এসেছিলেন মক্কায়। তারপর থেকে যান এখানেই স্থায়ীভাবে। চুক্তি ও সন্ধিবদ্ধ হন মক্কার আবু হুযাইফার সাথে। অবশেষে আবু হুযাইফার দাসী সুমাইয়্যাকে বিয়ে করেন। এ ছিল ইসলামপূর্ব ঘটনা। অতঃপর এ যুগল থেকেই জন্ম নেন হযরত আম্মার (রা.)।
তাই মক্কায় আম্মার পরিবারের কোন শক্ত খুঁটি ছিল না। আর খুঁটি ছিল না বলেই মক্কার কাফেরদের রক্তচক্ষুর প্রধান টার্গেট ছিল এই আম্মার পরিবার।
নির্যাতনের তাপিত প্রান্তরে ছিল হযরত সুমাইয়্যা ইয়াসির ও আম্মারের বাস। প্রচণ্ড গরমকালে মক্কার বালুকাময় প্রান্তরের প্রতিটি বালুকণা জ্বলন্ত অঙ্গারের মত দাউ দাউ করতো। তার উপর দিয়ে ভর দুপুরে কেউ হেঁটে যাওয়ার সাহস করতো না। পায়ে ফুসকা পড়ে যেত। তাপিত এই জ্বলন্ত বালুর উপর তাদেরকে শুইয়ে রাখা হতো। অবাধ্য জানোয়ারকে যেভাবে পেটানো হয় সেভাবেই পেটানো হতো তাদেরকে। তাদের একটাই অন্যায়। তারা মুসলমান। হাতের তৈরি পাথরের মূর্তিগুলোকে এখন আর খোদা মানে না। তারা খোদা মানে খোদাকেই। প্রহারে প্রহারে বেহুঁশ করে ফেলা হতো তাঁদেরকে।
কখনো বা শাস্তির ধরণ বদল করতো তারা। গরম পানির মধ্যে চেপে ধরতো। মাঝে মধ্যে জ্বলন্ত কয়লার উপর শুইয়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখতো। শরীরের চর্বিগুলো গলে গলে পানি হয়ে পড়তো। আর তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকতো কেবলই আল্লাহকে। কারণ, এক আল্লাহ ছাড়া তাঁদের আর কোন সহায় ছিল না।
তাছাড়া হযরত সুমাইয়্যা আর হযরত ইয়াসির ছিলেন বয়সের ভারে দুর্বল। গায়ে শক্তি নেই। তবে হৃদয়ে বিশ্বাসের বল ছিল। আর সে বলেই লড়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা সময়ের সেরা ফেরাউনদের বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড নির্যাতন আর দাবানলের ভেতরে থেকেও কেবল ‘আহাদ আহাদ’ শ্লোগানে জাগিয়ে রাখতেন বিশ্বাসের প্রতিটি রক্তকণাকে।
মাঝে মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের পাশ দিয়ে যেতেন। দেখতেন জ্বলন্ত অঙ্গারে পোড়ে মরছে আল্লাহর সৈনিকেরা। বুড়ো মা-বাবার সঙ্গে কচি আম্মারও।
নবীজী কখনো বা আম্মারের মাথায় হাত রেখে বলতেন : “হে আগুন। ইবরাহীম (আ.)-এর জন্যে যেমন শান্তিদায়ক শীতল হয়ে গিয়েছিলে আম্মারের জন্যেও তেমনি হয়ে যাও!”
হযরত সুমাইয়্যা ও হযরত ইয়াসিরকে যখন নির্যাতিত হতে দেখতেন তখন বলতেন: ইয়াসির পরিবার ধৈর্য ধর! কখনো বা বেদনার ভার সইতে না পেরে প্রিয়তম প্রভুর দরবারে এই বলে প্রার্থনা করতেন : হে আল্লাহ! তুমি ইয়াসিরের পরিবারকে ক্ষমা কর। কখনো বা বলতেন: ইয়াসির পরিবার! সুসংবাদ শোন, বেহেশত তোমাদের অপেক্ষায় অধীর!
নবীজী সা.-এর আর কী-ই বা করার ছিল, তাঁর ডাকে সারা দিয়ে তাঁরই চোখের সামনে কোন অন্যায় ব্যতীত এভাবে নির্যাতিত হচ্ছে এঁরা। তাও সুমাইয়্যার মত একজন কৃতদাসী। এত নির্যাতন এত শাস্তি ও এত অত্যাচারের পরও সত্যের পথে অবিচল। নবীজী সা. -এর প্রতি পরম বিশ্বাস ও ভালোবাসায় নমিত- নিবেদিত। নমরূদের অগ্নিকুণ্ডে যেমনটি ছিলেন হযরত ইবরাহীম আ.।
কুরাইশদের নির্মমতা মাঝে মধ্যে সীমা ছাড়িয়ে যেত। তখন আর তারা মানুষ থাকতো না। বন্য হায়েনাদেরকেও হার মানাতো তারা। তখন এই অসহায় দুর্বল নিরপরাধ মানুষগুলোকে লোহার পোশাক পরিয়ে জ্বলন্ত বালুর উপর দাঁড় করিয়ে রাখতো। মাথার উপর থেকে আকাশ ভারি বর্ষার মতো তাপ ঢালতো, বাতাস বয়ে আনতো ক্ষিপ্ত লেলিহান আর পায়ের তলার তপ্ত বালুরাশি তুষের আগুনের মত সেদ্ধ করে তুলত দুটো পা! অসহায় সুমাইয়্যা, অসহায় ইয়াসির আর অসহায় আম্মার দগ্ধ হতে থাকতেন সে ভয়ঙ্কর অগ্নিজ্বালায়। ঈমানের সে অগ্নিপরীক্ষা ভাষাতীত বর্ণনাতীত। একদিনের ঘটনা। ভয়ঙ্কর জাহান্নামে দগ্ধ হচ্ছেন হযরত সুমাইয়্যা রা.!
তার সামনে দিয়েই যাচ্ছিল বেঈমান আবু জেহেল। হযরত সুমাইয়্যা (রা.) কে দেখে তার ভেতরটা জ্বলে ওঠল। জ্বলে ওঠল নিজেদের পরাজয়ের কথা ভেবে। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে যেন ধিক্কার বাণে জর্জরিত হচ্ছিল আবু জেহেল। ভাবছিল, ওরা দুর্বল। কৃতদাস ওরা। আর এই সুমাইয়্যা। একজন অসহায় বুড়ি। অথচ কত শাস্তি দিলাম! কিন্তু একটুও নরম হলো না । মাথা নোয়াবার কোন লক্ষণ নেই। এত অত্যাচারের ভেতরও সেই ‘আহাদ আহাদ’ রব। ‘এক আল্লাহ এক আল্লাহ’ শ্লোগান!
আবু জেহেল আর ঠিক থাকতে পারল না। পাপের হাওয়া তার ভেতরে মহা তুফান সৃষ্টি করল। হাতে ছিল একটি বিষাক্ত বর্শা। ছুঁড়ে মারল হযরত সুমাইয়্যা (রা.)-এর লজ্জাস্থানে! ভাগ্যবতী মহান বেহেশতী নারী নীরবে ঘুমিয়ে পড়লেন শাহাদাতের শরাব পিয়ে। ইসলামের চির সবুজ শান্তিবৃক্ষ সিক্ত হলো সর্বপ্রথম এই জান্নাতী নারীর পবিত্র লহুতে।
পৃথিবীর সমগ্র নারী জাতির জন্যে এ এক বিস্ময়কর গৌরব। খোদার দীনকে যিন্দা করার জন্যে রক্ত দিয়েছেন তো অনেক ভাগ্যবানই। নবীজীর সা.-এর প্রিয়তম চাচা হযরত হামযা, হযরত হানযালা, হযরত সাদ, আবদুল্লাহ ইবন জাহশ, হযরত খুযাইমা (রা.) থেকে শুরু করে কত ভাগ্যবানই জীবন দিয়েছেন আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার খাতিরে। দিচ্ছেন আজো আফগান, কাশ্মীর ইরাকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু সর্বপ্রথম খোদার রাহে জীবন বিলাবার গৌরব সে হযরত সুমাইয়্যা রা.-এর, তিনি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহীদ।
অবশ্য হযরত ইয়াসির (রা.) ইতোপূর্বেই মক্কার বেঈমানদের নির্যাতনে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বেঁচে থাকেন হৃদয়ের ধন আম্মার রা.!
তারও অনেক পরে যখন আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত করেন তখন তাঁরা ঘুরে দাঁড়ান। ইসলামের পতাকাকে সমুন্নত করার অবিনাশী প্রেরণায় উজ্জীবিত নবীর সঙ্গীগণ জ্বলে ওঠেন ঈমানের বজ্রহিম্মতে। রুখে দাঁড়ান আঁধারচারী সন্ত্রাসী বেঈমানদের বিরুদ্ধে। সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। সত্য-মিথ্যা আলাদা হয়ে ওঠার যুদ্ধ। আল্লাহর সৈনিকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনে- সত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে। আল্লাহ তাআলা বিজয় দান করেন মুসলমানদেরকে। এমনকি মক্কার সবচে’ বড় বোয়াল আবু জেহেলটাও মারা যায় এই যুদ্ধে।
নবীজী সা. -এর পাশে তখন আম্মার। বীর জননীর বীরপুত্র আম্মার। সামনে দুর্ভাগা আবু জেহেলের লাশ। অসহায় বৃদ্ধা শহীদ জননীর রক্তমাখা বদনখানি যেন স্বরূপে ভেসে ওঠল আম্মারের সামনে। নবীজী সা. তখন সান্ত্বনার সুরে বললেন, “আল্লাহ তোমার মায়ের হত্যাকারীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।” [সূত্র : সীরাতুল মুস্তাফা – ১ : ২২৫-২২৭ পৃ.]
সংকলক:
মুফতি আতাউল্লাহ বাশার
শিক্ষক, মাদ্রাসায় দারুস সালাম
বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ।