এক কলসি পানির জন্য আদিবাসী নারীর সংগ্রাম

প্রকাশিত: ৩:৪৭ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৩

দেশের পানি সম্পদ দিন দিন শেষ হয়ে আসছে।আমরা যদি পানি সমস্যার সমাধান না করি,আমাদের গ্রহটি অন্যগ্রহের মতোই হয়ে যাবে। পাহাড় থেকে হাওর, সমতল থেকে সমুদ্র উপকুল, রাজশাহী থেকে ঢাকা সর্বত্রই পানির জন্য হাহাকার। দেশের নদ-নদী , হাওর, বিল, খাল, পুকুর ডোবা,খাড়িসহ সকল জলাভূমি আজ শুন্য থাকে বছরের আটমাস। কৃষক পাচ্ছেনা সেচের জন্য ভূ-উপরিভাগের পানি, ভূ-গর্ভের অদৃশ্য পানি সম্পদ ধীরে ধীরে নীচের দিকে চলে যাচ্ছে।

নেত্রকোনার সীমান্ত অঞ্চলের আদিবাসীসহ সকল পেশাবৈচিত্র্যের মানুষ আজ যেমন ভয়াবহ পানি সমস্যার সন্মূখীন হচ্ছেন তেমনি রাজশাহীর বরেন্দ্র ও উপকুলের মানুষ সুপেয় এককলসী পানির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। পানির জন্য সীমান্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠি বিশেষ করে আদিবাসীরা নিরাপদ পানীয় জলের জন্য পাহাড়ের ছড়া থেকে বিন্দু বিন্দু ফোটা পানির জন্য দিনরাত অপেক্ষা করে এক কলসি পানি সংগ্রহ করেন।

রাজশাহীতে পানির জন্য কৃষকের আত্মহত্যা, উপকুলে এককলসি পানির জন্য নারী পুরুষ কিশোরীর প্রানান্তর যুদ্ধ, নেত্রকোণার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর সীমান্তের গ্রামে আদিবাসি নারী ও শিশুদের পাহাড়ের ছড়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে এক কলসি পানির জন্য।

নদী, হাওর, খাল, বিল, পুকুর, ছড়া, ঝরনা, ঝিরি, হ্রদ, পুকুর, দিঘি, ডোবা, নালা, ভাড়ানি, বাঁওড়, খাড়ি, লেক সহ কত জলাধার আছে বাংলাদেশে।

পানি নিয়ে দেশে আছে একটি নীতিমালা ও একটি আইন। ‘জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯’ এবং ‘বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩’। পানি আইনে বলা হয়েছে, পানি সম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে বিধান প্রণয়ন সমীচীন বলে আইনটি করা হয়েছে। পানীয়জল আজ বহুজাতিক কোম্পানির বোতলে বন্দি। নামে বেনামে কত ব্যবসা ও কত লাভ লোভের জায়গা তৈরী হয়েছে এই পানি নিয়ে। ভূগর্ভের পানি টেনে তোলা হচ্ছে। আমাদের পাতালের পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের সাধারণ সভায় অনুমোদনের পর ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ প্রথম পালিত হয় বিশ্ব পানি দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিটি দিবসের মতোই পানি দিবসে প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য থাকে। ১৯৯৪ সালের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘পানি সম্পদ সুরক্ষা সবার দায়িত্ব’। ১৯৯৫ ‘নারী ও পানি’, ১৯৯৬ ‘তৃষ্ণার্ত নগরীর জন্য পানি’, ১৯৯৭ ‘বৈশ্বিক পানি কি যথেষ্ট’, ১৯৯৮ ‘ভূ-গর্ভস্থ পানি অদৃশ্য সম্পদ’, ১৯৯৯ ‘সকলেই ভাটিতে’, ২০০০ ‘একুশ শতকের জন্য পানি’, ২০০১ ‘স্বাস্থ্যের জন্য পানি’, ২০০২ ‘উন্নয়নের জন্য পানি’, ২০০৩ ‘ভবিষ্যতের পানি’, ২০০৪ ‘পানি ও দুর্যোগ’, ২০০৫ ‘জীবনের জন্য পানি’, ২০০৬ ‘পানি ও সংস্কৃতি’, ২০০৭ ‘পানিহীনতা’, ২০০৮ ‘পয়োনিষ্কাশন’, ২০০৯ ‘অভিন্ন জল ও জলের ভাগ’, ২০১০ ‘পানির গুণগত মান’, ২০১১ ‘নগরের জন্য পানি’, ২০১২ ‘পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা’, ২০১৪ ‘পানি ও শক্তি’, ২০১৫ ‘পানি ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন’, ২০১৬ ‘ভালো পানি ভালো কাজ’, ২০১৭ ‘কেন বর্জ্যপানি?’ ২০১৮ ‘পানির জন্য প্রকৃতি’।২০১৯ ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়, সবার জন্যই পানি। ২০২০ ‘পানি ও জলবায়ু পরিবর্তন’ ২০২১ ‘ভ্যালুয়িং ওয়াটার’ (মুল্যবান জল) ২০২২ ভূগর্ভস্থ পানি: অদৃশ্য পানি, দৃশ্যমান প্রভাব’’ ২০২৩ ‘ পানি ও পয়:নিষ্কাশন সমস্যা দ্রুত সমাধান করি।

কেবল পানি দিবসই নয়; ২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পানি দশক, ২০০৮ সালকে আন্তর্জাতিক পয়োনিষ্কাশন বর্ষ ও ২০১৩ সালকে আন্তর্জাতিক পানি সহযোগিতা বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে।

দেশজুড়েই প্রাণ ও প্রকৃতিতে সংকট চলছে। এই সংকট ও যন্ত্রণা সামাল দেওয়া কোনো একক র্কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তির কাজ নয়। দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা। জলের জন্য বৃহৎ জাগরণ ও প্রচারণা পরিচালিত করতে হবে।

নেত্রকোণার কলমাকান্দার মানুষের ৩০/৪০ বছর ধরে পানির জন্য হাহাকার চলে আসছে বলে জানান এলাকার ভূক্তভোগী জনগণ। কলমাকান্দা এলাকা ঘুরে দেখা যায় যে, নারী, নারী শিশু, প্রবীণ নারীরাই বসতবাড়ি থেকে দূরের পাহাড়ের টিলা থেকে নেমে আসা নালা থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন নিরাপত্তাহীনতার ভেতর দিয়ে।

নেত্রকোনা সীমান্তে এলাকার সুমেশ্বরী, মহাদেও, উবদাখালী, কংস নদীসহ সকল নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, জলবায়ু পরিবর্তন, জলাভূমির বিলুপ্তি, ভরাট এ অঞ্চলের পানি সংকটকে দিন দিন বাড়িয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশংকা করা হচ্ছে।

রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্রডিঙ্গা,হাতিবের, পাচগাঁও, সন্নাসীপাড়া, জাকিরপাড়া, মনগড়া খারনৈ ইউনিয়নের ভাষাণকুড়া, কচুগড়া, বিশ্বনাথপুর, রানীগাঁও, গোবিন্দপুর লেঙ্গুরা ইউনিয়নের চেংগ্নী, গোপালবাড়ী, ফুলবাড়ী, কালাপানি, কাঠাবাড়ী লোকজন তাঁদের সংকটের কথা জানাতে গিয়ে বলেন, একসময় তাঁরা ওপারের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা ছড়ার ময়লাযুক্ত পানিই কাপড় দিয়ে ছেঁকে কোনো রকমে পরিষ্কার করে পান করতেন। কিন্তু এখন ছড়াগুলোও শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে।

রংছাতি ইউনিয়নের সীমান্ত গ্রাম চন্দ্রডিঙ্গার সাবিনা রেমা (৫৫) বলেন, সারা বছরই পানির সমস্যা থাকে।পরিমল রেমা বলেন, ‘চন্দ্রডিঙ্গার আশপাশের অন্তত ৮ টি গ্রামের লোকজন সীমান্তের জিরোলাইন থেকে তেলের টিন, কলসি, না হয় বালতি দিয়ে ঘাড়ে বয়ে পানি আনতে হয়।

কলমাকান্দার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে লেংগুরা, খারনৈ ও রংছাতি ইউনিয়ন মূলত পাহাড়ি এলাকা। এসব এলাকায় প্রধানত গারো ও হাজং সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। বিশুদ্ধ পানির অভাবে এমন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলার টিলাঘেরা পাঁচ পাড়ার শতাধিক আদিবাসী পরিবারের লোকজন স্বাধীনতা পরবর্তী গত ৫০ বছর ধরেই।’

নেত্রকোণার নদ নদীতে বোরো মৌসুমে শত শত পাওয়ার পাম্প বসিয়ে সেচের প্রাকৃতিক পানি উত্তোলন করে কৃষি কাজ চলতো। কিন্তু বর্তমানে সকল কৃষি সেচের পানির জন্য ভূগর্ভের পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে নেত্রকোণা সহ বাংলাদেশের সকল মানুষ। যেসকল মানুষ নদীতে পুকুরে গোসল করতো তারাও আজ বিদ্যুতের সাহায্যে মাটির নীচের পানি উত্তোলন করছেন।পানির উৎসগুলো আমাদের রক্ষা করতে হবে।কৃষি, মাছ, জলবায়ু পরিবর্তন রোঘ ও মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষায় পানির উৎস আমাদের জীবনের প্রয়োজনেই সংরক্ষণ করতে হবে।

 

লেখক :

পরিবেশ কর্মী ও আঞ্চলিক সমন্বয়কারী

বারসিক, নেত্রকোণা।