কবি গোলাম কবিরের অসুস্থ মাকে নিয়ে লেখা একগুচ্ছ কবিতা
১
তবুও আশা ছাড়ি না
রাতের আকাশের দিকে তাকাই না বহুদিন!
কতোদিন দেখি না নিবিড় অন্ধ রাতে
সারি সারি নক্ষত্রের মেলা, হয়না দেখা
মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি খেলা
কিংবা যুবতী জ্যোৎস্না রাতে বাঁশঝাড়ের
ফাঁক গলে ঢেউ খেলানো বাতাসের দোলের
মধ্যেও জোনাকির আনাগোনা
কিন্তু দেখছি কী করে একটা বিশাল ছায়া
মাথার ওপর থেকে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে!
অনুভব করছি “মা” নামের একটা অপরূপা
স্নিগ্ধ কোমল আলো কিভাবে ধীরে ধীরে
নিভে যাচ্ছে, টের পাচ্ছি বুকের গহীনে
কিভাবে একটা ভারী পাথর চেপে বসে
থিতু হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারি কিভাবে
“মা” নামের পৃথিবীতে সবচেয়ে
নিরাপদ আশ্রয় ধ্বসে যাচ্ছে আমাকে
অতলান্ত অশ্রর সাগরে ডুবাতে ডুবাতে!
তবুও আশা ছাড়ি না যদি আরো
কিছুদিন বেশি এই অপরূপা
স্নিগ্ধ কোমল আলোর
কিরণ পাই ভূবনে আমার!
২
তুমি ভালো হয়ে যাও না মা
এই শীতের রাতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে
বুকের গহীনে, ভিজে যাচ্ছে সব!
শীতার্ত এই দীর্ঘ রাত স্বাক্ষী,
কেউ না দেখলেও আমি তো জানি
কতোটা কষ্ট এই তুমুল বৃষ্টিতে ভেজা!
এই তুমুল বৃষ্টিতে সবকিছু ভিজে গেলেও
কিছু স্মৃতি পাপড়ি মেলে ফুটে আছে
সদ্য ফোটা বেলীফুলের মতো।
মা’র সাথে কতো আনন্দের মূহুর্তের
কথা মনে ভিড় করছে,
আমার জন্মের দিনকে নিয়ে
মা’র মুখে বহুবার শোনা অবিকল
বিভূতিভূষণের উপন্যাসের মতো বর্ণনায়
কতো গল্প বলা রাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!
বুকের ভেতরটা হুহু কান্নায় দলা পাকিয়ে
ওলটপালট করে দিচ্ছে আমার অস্তিত্বের গহীন,
মা’র মতো এমন করে
আর কে গল্প শোনাবে আমায়!
আমার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়
আর কে বসে থাকবে রাতে,
কে এমন করে আর বকার পরে
ভাত সামনে নিয়ে বসে থাকবে!
তুমি ভালো হয়ে যাও না মা!
বুড়ি হলেই কী এমন তাড়াতাড়ি
করে চলে যেতে হয়!
আরও তো বুড়ি হওয়া যায়,
আরও একটু বেশি বুড়ি হতে তো পারতে তুমি!
৩
শীতার্ত এই রাত
শীতার্ত এই রাত যতোই গভীর হয়
আতংকের বিভীষিকাময় ক্ষণগুলো
ততোই দীর্ঘায়িত হতে থাকে,
হাসপাতালের সামনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে
টং দোকানে চা খাবার ছলে বেরিয়ে এসে
নিজে আরও একা হয়ে যাই।
কতো কথা, কতো স্মৃতি মনে পড়ে মা’কে নিয়ে!
একটু একা হয়ে কান্না করতে চাই
অস্তিত্বের নড়বড়ে খুঁটি ধরে
অথচ কান্না আসে না বরং বুকের ওপর
চেপে বসে বিশালকায় কালো পাথর!
মাঝেমধ্যে একদমই নীরব রাস্তায়
বেওয়ারিশ কুকুরের কান্না শুনতে পেয়ে
ওদের প্রতি ঈর্ষা জাগে, কেনো যে
ওদের মতো কী সুন্দর কান্না করে
বিষাদের অতল নীল জলরাশিতে
ভেসে গিয়ে হালকা হতে পারছি না!
শীতার্ত এই রাত কেনো এতো দীর্ঘ হলো!
কেনো যে এতো তৃষ্ণা পায় ” মা ” ডাকার!
একা একা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ইচ্ছে করেই
এদিক সেদিক দেখে নিয়ে চিৎকার করে
বেশ কয়েকবার ” মা, মা, মা ” বলে ডাকলাম
কিন্তু কোথাও কোনো সাড়া নেই,
উত্তর আসে না কোনো!
৪
মা ডাকার তৃষ্ণা
মা, তোমাকে ডাকার তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়,
প্রবল জলের তৃষ্ণায় যেমন মরুর বুকে
উটের রাখালের অবস্থা হয় প্রখর দারুণ
দগ্ধ দুপুরে অথচ জলের দেখা পায় না,
আমার অবস্থা তারচেয়েও বেশি করুণ!
কখনো বুঝিনি আগে এমন তৃষ্ণায়
বুক ফেটে যাবে শুধু তোমাকে ডাকার জন্য !
চেয়ে দ্যাখ, আমার বুক ফেটে হয়ে গেছে
চৌচির খর বৈশাখের মাটির মতো!
একবার মনেহয় – প্রচণ্ড জোরে
চিৎকার করে ডাক দিয়ে উঠি
“মা, মা, মা” বলে যেনো তুমি শুনতে পাও
আমার মা ডাক হাসপাতালের সিসিইউ’র
বিছানায় সংজ্ঞাহীন শুয়ে থেকেও,
ইচ্ছে করে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলো,
“এই তো বাবা, পাগল ছেলে আমার!
আমি আছি তো তোর সঙ্গে!”
৫
আমার কেবলই রাত নেমে আসে
সবারই তো রোদ ঝলমলে দিন আসে,
আসে ঘুঘু ডাকা মন কেমন করা
অলস দুপুরবেলা, আসে মায়াবতী
নিঝুম জ্যোৎস্না রাত।
আমার জন্য এসব কিছুই এখন আসে না!
আমার এখন কোনো দিন বলতে কিছু নেই,
না সকাল, না দুপুর, না বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা!
আমার কেবলই রাত নেমে আসে,
মিশমিশে কালো আতংকের বিভীষিকাময়
গাঢ় অন্ধকার জেঁকে বসা
শীতার্ত না ফুরানো দীর্ঘ রাত!
এই দীর্ঘ রাত যেনো কোনো
গ্রাম্য মেঠো পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা
একলা তালগাছ, যে সারাক্ষণ
শুধু দাঁড়িয়েই থাকে, দাঁড়িয়েই থাকে ক্লান্তিহীন!
এরকম বিভীষিকাময় অন্ধসময়
কখনো আসে নি আর জীবনে আমার!