কবি সাদেকা তামান্না’র এক গুচ্ছ কবিতা
১
প্রেমিক
পুরুষ তুমি একদিন ছিলে
সৃষ্টির প্রথম দিকে গৃহকর্তা,
সভ্যতার উন্নয়নে আজ তুমি
থমকে গেছ প্রেমে,
থেমে থেমে যেই পুরানো বার্তা।
তুমি ছিলে বহুবিবাহ আর
সন্তানের পিতৃ পরিচয়ে তৃপ্ত,
তুমিই ছিলে যোদ্ধা,
করেছো জয় আধুনিক সভ্যতার।
তুমি শ্রমবিভাজন শিখালে,
শিখালে সম্পত্তিতে অধিকারের প্রতিষ্ঠা।
কিন্তু বর্তমানে তুমি হয়েছো প্রেমিক,
ভুলেছো তোমার শ্রেষ্ঠত্ব,
আজ তুমি সামান্য কষ্টেই কাতরাতে থাক,
প্রেমিকার বিহরে তুমি সন্ন্যাসী হও,
তোমার চাকরি না পেলে
হতাশায় ভীরুর মত প্রেম কর বিসর্জন,
তোমার প্রেমিকা হয় তোমার বোন।
তোমার নি:শব্দ অধ:পতন মানতে
বড়ই কষ্ট হয়, ঘৃণা হয়।
তুমি আজ বউয়ের কথার দাস হয়ে
মা বাবাকেও কর নির্যাতন,
তাদের পাঠিয়ে দাও বৃদ্ধাশ্রম,
তুমি বউয়ের হাতে মাইর খাও,
শ্বশুর বাড়ির মানুষের সামনে বড়লোকি দেখাও।
তোমার জন্য প্রেমিক শব্দটা বেমানান দেখায়।
যদি এটা তোমায় বানায় না
তবুও তুমি প্রেমিক পুরুষ,
২
তুমি আমি
হয়ত তুমি মুক্তা, ঝিনুক,
শালুক কিংবা শাপলা ছিলে,
আমি কিছুই ছিলাম নাতো,
তবুও তোমায় খোঁজতে যেতাম,
তোমায় পেতে ব্যাকুল ছিলাম।
আজ তুমি স্বর্ণ, রুপা,
হিরা কিংবা কষ্টিপাথর,
আমি কিন্তু কিছুই নাতো,
তবুও তুমি আমায় খোঁজ,
আমায় পাওয়া যাচ্ছে নাতো।
হঠাৎ খবর, খুব কোলাহল,
আমার নাকি মরণ হলো,
মরার আগে কি বেঁচে ছিলাম?
এই প্রশ্ন মনে হলো।
সবাই মরে অসময়ে অসময়ে,
বাঁচে কেবল গুটিকয়েক,
আমি ছিলাম তাদের দলে
যারা মৃত্যুর আনন্দেই বাঁচে।
কোন স্ত্রীর প্রেমিক বলে।।।
৩
পর
শীত ঋতুর আমেজ শেষে ফাল্গুন আসবে ঠিকই
কেবল আমার মনের অসুখ যাবেনা।
প্রহর বেলা চক্রাকারে আসবে যাবে ঠিকই
কেবল আমার বাগানে ফুল ফুটলনা।
রিক্ত, কঠিন, বন্ধুর পথ একা হাটছি জেনেও
তুমি কোনদিন পাশে হাটবেনা।
কদম, বেলি, রক্তজবার সময় গেল ঠিকই
কেবল আমার জন্য তোমার সময় হলোনা।
বর্ষার বৃষ্টি তোমার বাড়ির উঠান ভেজালেও
তোমার মিষ্টি কথায় কেবল আমার মন ভিজালেনা।
অনেক অসুখে আমি ভুগছি জেনেও
তুমি আমার ওষুধ হলেনা।
নির্বাসনে যাচ্ছি জেনেও, দীর্ঘ পথে ক্লান্ত জেনেও তুমি আমার সঙ্গী হলে না।
আমি তোমার আছি জেনেও
তুমি শুধু আমার হলে না।
দৃষ্টিহীন চোখেও দৃষ্টি ছিলো,
অগাধ অসীম শূন্যতায়
হৃদয়ে হাহাকার ছিলো,
মনে হতো, কেন এমন হয়?
বার বার কেন আমাকেই আঘাত করা হয়?
প্রশ্নের উত্তর মিলেছিল বহুকাল পরে,
ততোদিনে আঘাতে আঘাতে
পাথরে পরিণত হয়েছিলাম,
অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
বারবার মনে হতো,
যেই তোমার জন্য সব ছাড়লাম
সেই তুমিই এমন!
তবুও নিজেকে বুঝিয়েছিলাম
এই পৃথিবীতে এটাই বাস্তবতা।
তুমি আঘাতের বিনিময়ে আঘাত পাবে না,
তুমি সুখের বিনিময়ে কেবল দুঃখই কিনবে,
এরপর কতো যুগ কেটে গেলো!
আমাদের নিত্যকার রুটিন হলো
তুমি ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে,
আর আমি তোমাকে নিয়ে।
একদিন অনুভব করলাম
আমি আর সেই আমি নেই,
কঠিন জড় পদার্থে পরিনত হয়েছি,
হৃদপিণ্ডে ধমনী পরিনত হয়ে যাচ্ছে
দূষিত শিরায়,
বুকের বাঁ পাশে
ধুকধুক বুকে কেবল মৃত্যুর প্রহর।
মৃত্যুও হার মানে মন্দ ভাগ্যের কাছে,
বেঁচে থাকাটাই যেন কঠিন সংগ্রাম,
তবুও কেন অনুভবে তুমি আসো
আমার নিকীলেশ।
৪
শব্দ ঝড়
ঠুক ঠাক, বিদঘুটে;
জঞ্জাল, আবর্জনা;
বাতাস করে ভারী,
অক্সিজেনে কমে কার্বনের রাজত্ব।
ঠিক ঠিক, সই সই;
মানবো না, লাগবেই;
মিথ্যার শহরে,
পতাকা স্বাধীন উড়বেই,
কারণ আমি যোদ্ধা।
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস;
ভূমিকম্প, খরা;
চারপাশে বন্যা,
হৃদয়ে মরুঝড়,
মুখে ফুটেছে শব্দ ঝড়।
দৃষ্টিহীন, দৃষ্টিপাত;
শ্রুতিকটু, রক্তপাত;
যুদ্ধ করে প্রাণনাশ,
গণতন্ত্র মুক্তি পাক,
মুখে কেবল চেপে যাক,
মনে মনে ঘাস খাক।
হা হা, হি হি;
চোখ বন্ধ, তাতে কি?
হৃদয়ে অনেক শব্দ ঝড়,
শকুনের দোয়ায় গরু মর।
৫
শ্রমিক
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে
স্যাঁতস্যাঁতে শরীরে গড়িয়ে পড়ে
যেন বৃষ্টির ন্যায়।
প্রখর রোদে ছাতাহীন
গায়ের চামড়া পুড়ে হয় মলিন
তবুও চলে পরিশ্রম।
রাত দিন এক করে
পরিবারের সুখকে সামনে রেখে
নিজের কস্ট ভুলে
খরা, ঝড়ে, শীতে, বন্যায়, জলোচ্ছ্বাসেও
যাদের দমিয়ে রাখা যায় না
তারাই শ্রমিক।
দিনের পর দিন ঘাম শুকিয়ে গেলেও
বেতন জুটে না কখনো সঠিক সময়ে,
পরিবারের সব আবদার মিটাতে পারে না কখনো,
তবুও চেষ্টায় কমতি রাখে না তারা।
অথচ নিজের জন্য কখনো কিছু ক্রয় করে না,
চিকিৎসায় করে অবহেলা।
কেউ কেউ একে লিঙ্গীয় বৈষম্যের ফ্রেমে
আটকে রেখে অপপ্রচার চালায়,
নারী পুরুষের ভিন্ন মজুরি ধার্য্য করে
একটি বিশেষ দিনেই কেবল উজ্জীবিত হতে চায়।
তাদের হুংকার দিয়ে বলতে চাই…
নর নারী সবাই সম
করো নাতো বিভেদ,
বিবেক আজ জাগ্রত করো
আমরা সবাই এক।
দাও মোদের পাওনা
ধরছি না বায়না,
এটা মোর অধিকার।
লেখক
সাদেকা তামান্না
প্রভাষক, চচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।