কমলা রাণী দিঘী
রাজা জানকি নাথ রাতে তার সন্তানকে পুকুরের পাড়ে রেখে আসতেন। রাণী কমলা দেবী সন্তানকে বুকের দুধ খাইয়ে আবার পানিতে মিলিয়ে যেতেন।
নেজা ডেস্কঃ
দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের কাছে ঐতিহ্যবাহী কমলা রাণী দিঘী (Komola Ranir Dighi) অবস্থিত। অনেকের কাছে এটি সাগর দিঘী নামেও সুপরিচিত। প্রচলিত আছে, পনের শতকের শেষ ভাগে সুসং দুর্গাপুরের রাজা জানকি নাথ কমলা দেবী নামে এক সুন্দরী রমনীকে বিয়ে করেন। প্রজা হিতৈষী রাজা জানকি নাথের ঘরে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের নাম রাখা হয় রঘুনাথ। প্রজাদের পানির অভাব দূরীকরণের জন্য রাজা জানকি নাথ একটি পুকুর খনন করেন। তবে পুকুরে পানি না উঠায় রাজা চিন্তায় পড়ে গেলেন।
এরপর এক রাতে রাজা স্বপ্নে দেখতে পান রাণী কমলা দেবী যদি মাঝ পুকুরে গিয়ে পূজো দেন তাহলেই পুকুর পানিতে ভরে উঠবে। রাণীও প্রজাদের কথা ভেবে পুকুরের মাঝখানে পূজা দিতে সম্মত হলেন। হঠাৎ চারিদিক দিয়ে পানি উঠতে উঠতে রাণী কমলা দেবীকে ডুবিয়ে দিল। অনেকের মতে, বজ্রপাতের কারণে দীঘির তলার মাটি ফেটে পানিতে ভরে যায়। রাজা জানকি নাথ এমন ঘটনায় বিচলিত হয়ে গেলেন। সর্বদা রাজার সন্তান রঘুর জন্য দুশ্চিন্তা করতেন। আবারো এক রাত্রে রাজা স্বপ্নে দেখলেন তিনি যদি শিশু সন্তান রঘুকে পুকুরের পাড়ে রেখে আসেন তবে রাণী কমলা দেবী রঘুনাথকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। কিন্তু শর্ত হল যে, রাজা কোনক্রমে রাণীকে ছুঁতে পারবেন না।
রাজা জানকি নাথ রাতে তার সন্তানকে পুকুরের পাড়ে রেখে আসতেন। রাণী কমলা দেবী সন্তানকে বুকের দুধ খাইয়ে আবার পানিতে মিলিয়ে যেতেন। রাজা একদিন রানীকে ছোঁয়ার বাসনায় এগিয়ে গেলেন। কিন্তু রাণী পানির সাথে মিশে গেলেন। এরপর থেকে আর কোনদিন তার সন্তানকে দুধ খাওয়াতে আসলেন না।
রাজা স্বপ্নে দেখতে পান তার সন্তান রঘুনাথ যদি এভাবে আর ৭ দিন বুকের দুধ খেতে পারতো তাহলে সে দিক বিজয়ী ও প্রতাপি বীর হিসাবে গণ্য হত। ইতিহাস থেকে জানা যায় রাজা রঘুনাথের আমলে সুসং দুর্গাপুর শক্তিশালী পরগনা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা রঘুনাথই জঙ্গল বাড়ী দূর্গ আক্রমণ করেন এবং বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়, কেদার রায়কে পরাজিত করে মুঘল সম্রাটদের কাছ থেকে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত হন।
বর্তমানে কমলা রাণী দীঘির মাঝ দিয়ে সোমেশ্বরী নদী বয়ে গেছে। কালের সাক্ষী হয়ে দীঘির দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড় এখনো টিকে আছে। পুকুরের পাড়ের একাংশে বসতভিটা তৈরী করা হয়েছে, আর কিছু অংশ ফসলী জমি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি দুর্গাপুরের উদ্দেশ্যে সরকার এবং জিন্নাত পরিবহণের বাস ছেড়ে যায়। এ দুটি বাসে চড়ে দুর্গাপুর যেতে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা লাগে। দুর্গাপুর বলা হলেও সাধারণত এই বাসগুলো সুখনগরী পর্যন্ত যায়। সুখনগরী থেকে নৌকায় করে একটা ছোট নদী পার হয়ে রিকশা, বাস বা মোটর সাইকেলে দূর্গাপুর যেতে হয়। বাস যেতে ২০ টাকা, রিকশায় যেতে ৮০ থেকে ১০০ টাকা এবং মোটর সাইকেলে ২ জন ১০০ টাকা ভাড়ায় দুর্গাপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে রাত ১১ টা ৫০ মিনিটে হাওড় এক্সপ্রেস নামের ট্রেনে করে শ্যামগঞ্জ ট্রেন স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বাস বা সিএনজি ভাড়া নিয়ে বিরিশিরি বাজার যাওয়া যায়। কিংবা একটু সহজে যেতে চাইলে হাওড় এক্সপ্রেস ট্রেনে নেত্রকোনা এসে চল্লিশা বাজার থেকে মোটর সাইকেলে জনপ্রতি ৩০০ টাকা ভাড়ায় সব স্পট দেখে ফিরতে পারবেন। এছাড়া বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ভোর ৪.০০/৪.৩০ তে যাত্রা করা জারিয়া স্টেশনগামী ট্রেনে করে ৮০ থেকে ১০০ টাকায় জারিয়া এসে ট্রলার, অটো, সিএনজি বা মোটরসাইকেলে করে দূর্গাপুর যাওয়া যায়।
দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদের সামনে থেকে রিক্সা বা মোটর সাইকেলে বিরিশিরি ব্রীজ পার হয়ে বামপাশে গুজরীকোণার পাকা রাস্তা দিয়ে ১.৫ কিলোমিটার পরে কমলা রাণী দিঘীর পাড়।
কোথায় থাকবেনঃ
সুসং দুর্গাপুরে রাত্রিযাপনের জন্য জেলা পরিষদ ডাক বাংলো, বেশকিছু গেস্ট হাউস এবং মধ্যম মানের আবাসিক হোটেল আছে। প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন – জেলা পরিষদ ডাক বাংলো (01558-380383, 01725-571795), ইয়ুথ মেন খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমসিএ-এর রেস্ট হাউস(01818613496, 01716-277637, 01714-418039, 01743-306230, 01924-975935, 01727-833332), YWCA গেষ্ট হাউজ (01711-027901, 01712-042916), ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী গেষ্ট হাউজ (09525-56042, 01815482006)
দুর্গাপুরে মধ্যম মানের হোটেলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – স্বর্ণা গেস্ট হাউস (01712-28698, 01728-438712), হোটেল সুসং (01914-791254), হোটেল গুলশান (01711-150807), হোটেল জবা (01711-186708, 01753-154617), নদীবাংলা গেষ্ট হাউজ (01771-893570, 01713-540542)। এই হোটেলগুলোতে ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা রয়েছে।
কোথায় খাবেনঃ
বিরিশিরিতে ঘুরার সময় হালকা খাবার সাথে রাখতে পারেন কারণ যত্রতত্র খাবারের কিছু পাওয়া যায় না। এখানে মধ্যম মানের কিছু খাবার হোটেল বা রেস্টুরেন্ট রয়েছে যেখানে ভাত, ডাল, মাছ, মাংসের পাশাপাশি বকের মাংসও পাওয়া যায়। দূর্গাপুর বাজারে নেত্রকোণার বিখ্যাত বালিশ মিষ্টির স্বাধ নিতে ভুল করবেন না।