কালিমা তায়্যিবাহ এর গুরুত্ব, দাবি এবং ফজিলত

এই কালেমা ঈমান ও ইসলামের বিশাল বৃক্ষের শেকড় এবং আকাশ ছোঁয়া ভবনের মূলভিত্তি

প্রকাশিত: ৩:৩৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৬, ২০২৩

ইসলামিক জার্নাল ডেস্কঃ
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
এই কালিমায়ে তাইয়্যিবাহ্‌–ই হল ইসলামের প্রবেশদ্বার। ঈমান ইসলামের বিশাল বৃক্ষের শেকড় এবং আকাশ ছোঁয়া ভবনের মূলভিত্তি। এটাকে গ্রহণ করে এবং দৃঢ় বিশ্বাসে পাঠ করে পুরো জীবনের কাফির-মুশরিকও মুমিন-মুসলমান এবং মুক্তি ও সফলতার যোগ্য বনে যায়।

আরবি : لآ اِلَهَ اِلّا اللّهُ مُحَمَّدٌ رَسُوُل اللّهِ, উচ্চারণ: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।

বাংলা অর্থঃ আল্লাহ এক আর কোন মাবুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।

কিন্তু শর্ত হলো, এই কালিমাতে আল্লাহ্‌ তা’আলার তাওহীদ বা একত্ববাদ এবং হযরত মুহাম্মাদ ﷺ-এর নবুওয়াত-রিসালাতের যে স্বীকারোক্তি রয়েছে, এটাকে বুঝে-শুনে মানতে হবে ও গ্রহণ করতে হবে। যদি কেউ ‘একত্ববাদ’ ও ‘রিসালাত’-কে না বুঝে এর মানে-মতলব অনুধাবন না করে শুধু গড়গড় করে মৌখিক পাঠ করে নেয়, তবে সে আল্লাহ্‌ তা’আলার কাছে মুমিন-মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না। সুতরাং পূর্বশর্ত হলো, আমাদেরকে প্রথমে এই পবিত্র কালিমার অন্তর্নিহিত মর্মবাণী বুঝার চেষ্টা করতে করতে হবে।

এই পবিত্র কালিমাটির দুটো অংশ রয়েছে, কালিমার প্রথম অংশ لَا إِلٰهَ إِلَّا الله অর্থ: “আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন ইলাহ্‌ (উপাস্য) নেই।”

এই অংশে আল্লাহ্‌ তা’আলার তাওহিদ বা একত্ববাদের স্বীকারোক্তি ঘোষণা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ্‌ তা’আলা ছাড়া এমন আর কোন সত্তা নেই, যিনি ইবাদত বা উপাসনা, বন্দেগী বা দাসত্ব পাওয়ার যোগ্য। কেননা তিনিই আমাদের সকলের সৃষ্টিকর্তা ও প্রভু। তিনিই প্রতিপালক, তিনিই জীবিকা দানকারী। তিনিই মৃত্যুদাতা, তিনিই জীবনদাতা। সুস্থতা-অসুস্থতা, দারিদ্র-সচ্ছলতা, ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ সবকিছু একমাত্র তাঁরই ক্ষমতার কব্জায়।

আসমান-যমীনে তিনি ছাড়া সবাই — চাই সে মানুষ হোক বা ফেরেশতা — তাঁরই সৃষ্টজীব এবং তাঁরই গোলাম। তাঁর সৃষ্টিকাজে তাঁর সাথে কোন সাহায্যকারী ও অংশীদার নেই। তাঁর নির্দেশনাবলীকে ওলট-পালট করে দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। না তাঁর কাজে নাক গলানোর স্পর্ধাও কারো আছে। সুতরাং তিনি তো তিনিই। শুধু তাঁরই ইবাদত করা যায়। তাঁর সাথেই সম্পর্ক জুড়া যায়। দুঃখ-দুর্দশায় বা যে কোন প্রয়োজনে তাঁর কাছেই কেঁদে-কেঁদে হাত পাতা যায়। বুকভরা আশা নিয়ে ভিক্ষুক বেশে চাওয়া যায়।

তিনি তো রাজাধিরাজ। অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ সত্তা। তিনি সব বাদশাহ্‌দের বাদশাহ্‌। দুনিয়ার সব বিচারকদের উর্ধ্বে মহাবিচারপতি। সুতরাং এমন সত্তারই নির্দেশনাবলী মেনে চলা জরুরী। পূর্ণ আনুগত্যের সাথে তাঁর নির্দেশের অনুকরণ করা উচিত। তাঁর নির্দেশনাবলীর বিপরীতে অন্য কারো আইন কখনো মেনে নেয়া যায় না। চাই তিনি রাষ্ট্রপতি হোন বা কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি হোন, যদিও তিনি পিতা হোন বা বংশের চৌধুরী হোন, চাই তিনি কোন প্রিয়তম বন্ধু হোন অথবা হোক না তা নিজ প্রবৃত্তির একান্ত চাহিদা।

মোটকথা, আমরা যখন জেনে-শুনে মেনে নিয়েছি যে, এক আল্লাহ্‌ তা’আলাই ইবাদত-বন্দেগী লাভের উপযুক্ত, আমরা শুধুমাত্র তাঁরই গোলাম। সুতরাং আমাদের আমল বা কাজ-কর্মও সে মোতাবেক হওয়া উচিত। দুনিয়াবাসীরা আমাদেরকে দেখেই যেন বুঝে ফেলে যে, এরা শুধু আল্লাহ্‌রই গোলাম। এরা শুধু আল্লাহ্‌র আইনই মেনে চলে। আল্লাহ্‌র জন্যই বেঁচে থাকে। আল্লাহ্‌র জন্যি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। অতএব,

لَا إِلٰهَ إِلَّا الله — হোক আমাদের শপথ ও ঘোষণা।

لَا إِلٰهَ إِلَّا الله — হোক আমাদের বিশ্বাস ও ঈমান।

لَا إِلٰهَ إِلَّا الله — হোক আমাদের কর্মোদ্দীপনা ও মর্যাদা।

এই لَا إِلٰهَ إِلَّا الله দ্বীনী ভিত্তিমূলের প্রথম ইট। সকল নবির শেখানো সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সবক। দ্বীনের সব বিষয়ে এর মর্যাদা সর্বোচ্চে। প্রিয় নবির ﷺ বিখ্যাত হাদিস — তিনি ইরশাদ করেন –

ঈমানের সত্তরোর্ধ শাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও উন্নত শাখা হলো — لَا إِلٰهَ إِلَّا الله — এর স্বীকারোক্তি। (বুখারী, মুসলিম)

এজন্যই তো যিক্‌র সমূহের মধ্যে উত্তম হলো — لَا إِلٰهَ إِلَّا الله -এর যিক্‌র। যেমন অন্য এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে –

اَفْضَلُ الذِّكْرِ لَا إِلٰهَ إِلَّا الله

যিকির সমূহের মধ্যে উত্তম ও উন্নত যিক্‌র হলো لَا إِلٰهَ إِلَّا الله — এর যিক্‌র। (ইবনে মাজাহ, নাসাঈ)

অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ্‌ তা’আলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের এক প্রশ্নের জবাবে ইরশাদ করেন –হে মুসা! যদি সাত আকাশ ও সাত যমীন এবং এসবের মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছুকে এক পাল্লায় রাখা হয় আর لَا إِلٰهَ إِلَّا الله অন্য পাল্লায়, তবে لَا إِلٰهَ إِلَّا الله -এর পাল্লাই ভারি প্রমাণিত হবে। (শরহুস্‌ সুন্নাহ্‌)

মহান আল্লাহ তা’য়ালার প্রকৃত পরিচয় হলো তিনি এক-একক, অদ্বিতীয়, জীবন-মৃত্যুদাতা, লালন-পালনকারী, শ্রবণ-দর্শনকারী। তার আইন-হুকুম সর্বত্র বিরাজমান। তিনিই কুন-ফাইকুনের মালিক। তিনি সকল ব‘র পরে সর্ব শক্তিশালী। তিনিই সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি মানবজাতির জীবন পরিচালনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বিধান দিয়েছেন।

কালেমা তাইয়্যেবার শিক্ষাঃ কালেমা তাইয়্যেবা একটি বিরাট বিপ্লবী ঘোষণা। যারা এই কালেমা গ্রহণ করে, তারা একমাত্র আল্লাহর উপাশন ও তারই দাসত্ব স্বীকার করে। যেমন- আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর তার নৈকট্য লাভের উপায় তালাশ কর এবং আল্লাহর পথে জিহাদ কর, আশা করা যায় যে, তোমরা সফলকাম হবে।’ আল কোরআন, সূরা মায়িদাহ, আয়াত-৩৫।

বস্তুত এই কালেমা তাইয়্যেবার প্রতি যারা বিশ্বাস স্থাপন কর তারা ইসলামী বিধান ব্যতীত অন্য কোন ইজম স্বীকার করতে পারে না। আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাহারো সার্বভৌমত্ব মানতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রে ও মুসলিম দেশে মানব রচিত কোন আইন চলতে পারে না। তাই যে কোন ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলাম ও কোরআন বিরোধী যে কোন নেতা/রাজশক্তির স্বরচিত আইন চলতে পারে না।
কালেমার পরিপূর্ণতাঃ হযরত আদম আঃ থেকে শুরু করে মুহাম্মদ সাঃ পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণের পরে যে আসমানী কিতাব নাজিল হয়েছে, তা বিশ্বাস করা ফরজ। কালেমার প্রথম অংশ ‘লাইলা-হা ইল্লাল্লাহু’ মানা যেমন-ফরজ, কালেমার শেষ অংশ ‘মুহাম্মাদুর রাসূলল্লাহ মানাও তেমন ফরজ। বর্তমান বিশ্বে সুখ-শান্তির জন্য মহাগ্রন্থ আল কোরআনের আইন/বিধান এবং মুহাম্মাদ সাঃ আদর্শ জীবন বিধানকে মেনে নেয়া ছাড়া অন্যকোন উপায় নেই। আল্লাহর কোরআন যেমন অপরিবর্তীত, তেমন রাসূল সাঃ’র আদর্শ চরিত্র অলঙ্গনীয়। মুসলমানদের জন্য চিরন্তন আদর্শ নেতা হলেন মুহাম্মাদ সাঃ।

কালেমা তাইয়্যেবা পাঠের ফজিলতঃ কালেমা তাইয়্যেবা পাঠ করার ফলে পাঠকারীর জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। যদি তার মাঝে গুনাহ না থাকে, তবে তার পরিবারবর্গের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। তাফসিরে রুহুল বয়ানে বর্ণিত আছে যে, রাসুল সাঃ’র যুগে দাহিয়া কালবী নামে এক ব্যক্তি ছিল। সে বিনা অপরাধে ৭০ জন মেয়ে সন্তানকে হত্যা করেছে। রাসূল সাঃ’র পরামর্শে কালেমা তাইয়্যেবা পাঠ করে মুসলমান হলে তার ৬০ বছর বয়সের সমস্ত গুনা মাফ করে দেয়া হয়। হযরত আনাছ রাঃ হতে বর্ণিত আছে যে, যে কোন ব্যক্তি দিনে/রাতে কালেমা তাইয়্যেবা পাঠ করবে সঙ্গে সঙ্গে তার আমল নামা থেকে সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেয়া হবে। আর তার গুনাহ সমপরিমাণ নেক তার আমল নামায় লিপিবদ্ধ করে দেয়া হবে।

সংকলন:
মাও: আবু তাহের নেত্রকোণী
প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম ক্বাওমি মাদ্রাসা।
ভূগী, পূর্বধলা, নেত্রকোণা।
নিয়মিত লেখক, ইসলামিক জার্নাল বিভাগ
নেত্রকোণা জার্নাল।