কেউ মরলে রশিদ ভাই ছুটতেন গোর খোদতে, আগে তিনি কোপ দিতেন, তার গোর খোদতে হবে আজ
ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে নেত্রকোণার কাপড় ব্যবসায়ী বিএনপি নেতা মো. রশিদ ঢালী মারা গেছেন
নেজা ডেস্ক রিপোর্টঃ
ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে নেত্রকোণার কাপড় ব্যবসায়ী বিএনপি নেতা মো. রশিদ ঢালী মারা গেছেন। এ ঘটনায় তার পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে নাশকতার আগুনে চারজন দগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় পুড়ে গেছে ট্রেনটির তিনটি বগি।
এছাড়াও দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে মা- ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় নেত্রকোনার গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। নিহতরা হলেন- নেত্রকোনার সদর উপজেলার দক্ষিন বিশিউড়া ইউনিয়নের বরুনা গ্রামের আবদুল মজিদের ছেলের বউ নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার ছেলে ইয়াসিন রহমান পিয়াস (৩)।
মৃত বশির মিয়া ও রাবেয়া আক্তারের ছেলে রশিদ ঢালী (৬৫) বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি নেত্রকোণা পৌর কমিটির সদস্য ছিলেন। শহরের বড় বাজারে তার কাপড়ের দোকান রয়েছে, তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে এনামুল ঢালী ও সামসুল ঢালীকে নিয়ে নাগড়া স্টাফ কোয়ার্টার রোডের নিজের বাসায় বসবাস করতেন।
অন্যদিকে নেত্রকোণা সদর উপজেলার বরুনা গ্রামের আবদুল মজিদের ছেলে মিজানুর রহমান ঢাকার কাওরন বাজারে হার্ডওয়ারে (পার্সের) ব্যবসা করেন। স্ত্রী নাদিরা আক্তার পপি ও দুই সন্তান ফাহিম ও ইয়াসিন আরাফাতকে নিয় কাওরন বাজারে বাসা ভাড়া করে থাকেন। গত ১১ ডিসেম্বর স্বামীর বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে আসেন। বেড়ানো শেষে গত সোমবার রাতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে ঢাকায় স্বামীর কাছে ফিরছিলেন পপি।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢালীর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, মূল রাস্তার পাশে দুই কক্ষের আধা পাকা বাড়ির উঠোনজুড়ে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা জড়ো হয়েছেন। ঘরের ভেতর নারীরা কান্নাকাটি করছিলেন। সেখানে মানুষের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।
পরিবারের লোকজন জানায়, ব্যবসার কাজে মাঝে মাঝেই ঢাকায় যাতায়াত করতেন রশিদ ঢালী। কোনোদিন কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হননি তিনি। সোমবার রাতে নেত্রকোণা বড় স্টেশন থেকে তিনি ঢাকা উদ্দেশে যাত্রা করেন। পরিবার এ নিয়ে কোনো চিন্তাও করেনি। মূলত কাপড় কিনতেই তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন।
রশিদ ঢালীর ছেলে মো. মামুন ঢালী বাড়ির উঠানে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, “আমার বাবা ব্যবসার কাজে ঢাকা গেছিল ট্রেইনে। বাবা, জীবনের লাইগ্যা গেছে গা। আর আইব না।”
তিনি বলছিলেন, “ভোরে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আব্বারে ফোন দিতাছি। আব্বা তো ওই ট্রেইনে আছিল। তারে পাইতাছি না। পরে আমরার মহাজনদের ফোন দিছি তারাও আব্বারে পাইতাছে না। তখন ঢাকায় আমার এক চাচাত ভাই থাকে তারে ফোন দিছি। সেই ভাই ঢাকা মেডিকেলে গিয়া লাশ পাইছে।”
নিহতদের মধ্যে তিনজনের বাড়ি নেত্রকোণায়। তারা হলেন- নেত্রকোণা সদর উপজেলার দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামের বরুনা গ্রামের মো. ফজলুল হকের মেয়ে নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন রহমান পিয়াস।
তবে বিএনপি নেতা রশিদ ঢালীর লাশ পরিবার শনাক্ত করলে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অন্য লাশটির পরিচয় এখনও শনাক্ত হয়নি। রশিদ ঢালীর পরিবার জানিয়েছে, ঢাকা থেকে মরদেহ আনতে লোকজন গিয়েছে। মরদেহ আসার পর জানাজা শেষে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
কাজের সুবিধার জন্য মোহনগঞ্জ ও নেত্রকোণা থেকে প্রচুর যাত্রী এই ট্রেনে যাতায়াত করেন। রাতে উঠে তারা সকালে ঢাকায় পৌঁছে সারাদিন কাজ করে আবার রাতেই ফিরে যেতে পারেন।
রশিদ ঢালীও এভাবেই যাতায়াত করতেন বলে জানান তার ভাগ্নে হানিফ খান। তিনি বলেন, “মামা ভালা মানুষ আছিল। আমরার অভিবাবক আছিল। মামা গেলোগা । আমরা এতিম অইয়া গেলাম। আমরা মামার মৃত্যুর বিচার চাই।”
এক প্রতিবেশী বলেন, “কেউ মারা গেলে রশিদ ভাই আগে ছুইট্যা যাইতেন গোর খোদার জন্য। তিনি সবার আগে কোদাল দিয়ে কোপ দিতেন। এখন আমাদের তার জন্য গোর খোদতে হবে। এমন একজন ভাল মানুষকে এভাবে জীবন দিতে হল, এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বজলুর রহমান পাঠান বলেন, “রশিদ ঢালী পৌর বিএনপির সদস্য ছিলেন। তিনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন। তার এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।”
আগুনে মা- ছেলের মৃত্যুর ঘটনাটি জানার পরই নেত্রকোণার গ্রামের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে উঠে। গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
দাদী শহর বানু বারবার বলছিলেন- “কি দোষ করেছিল আমার বৌমা ও ছোট্টা নাতী। কেন তাদের আগুনে পুড়ে মরতে হল। আমি আর আমার দাদা ভাইয়ের সোনা দেখতে পাইতাম না। দাদা ভাই যাওনের সময় আমাকে বলে গিছিল- দাদু যাই। আবার আইবামনে। বৌমা বলেছিল- মা শরীরের খেয়াল রাইখেন। আর কোন দিন তাদের ফিরে পাইতাম না। আগুন যরাই দিয়া থাকুক তাদের বিচার চাই”।
নাদিরা আক্তার পপির বাবা নেত্রকোনার পূর্বধলার আলমপুর গ্রামের ফজলুল হক খবর শুনে জামাইয়ের বাড়িতে যান এবং আহাজারি করছিলেন। তিনি বলেন, আমি কি অপরাধ করেছিলাম। কি দোষে আমার নিস্পাপ নাতী ও মেয়েকে আগুন দিয়ে পুড়ে মরতে হল। আমি আমার মেয়ে ও নাতীকে আর ফিরে পাব না। যারা আগুন দিে ছে তাদের বিচার চাই।
জানা গেছে, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে সোমবার রাত ১১টায় ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশন এসে থামলে তখন কিছু যাত্রী সেখান থেকে নেমে যায়। এসময় তাদের পেছনের ছিটে থাকা দুই ব্যক্তিও নেমে যায়। এরপর পিছনের ছিট থেকে আগুন জ্বলে উঠে। মুহূর্তেই আগুন পুরো বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ট্রেনের বগীতে থাকা হাবিবুর রহমান ও ফাহিমসহ অন্য যাত্রীরা নামতে পারলেও ভিতরে আটকা পড়েন ছোট ইয়াসিন ও তার মা নাদিরা আক্তার। তারা কোনভাবেই ট্রেন থেকে বের হতে পারেন নি। পরবর্তিতে ফায়ার সার্ভিস তাদের মরদেহ বের করেন।
এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া তাবাসসুম।
তিনি বলেন, “নিহতের স্বজনদের সঙ্গে ঘটনার পর থেকেই আমরা যোগাযোগ রাখছি। মরদেহ এলাকায় আসার পর সেখানে যাব।
“নিহতদের পরিবারদের প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করলে সে অনুযায়ী সহযোগিতা দেওয়া হবে”, বলেন ইউএনও।
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে নাশকতা এই প্রথম নয়। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর এই ট্রেনে নাশকতায় একজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
সেদিন গাজীপুরের ভাওয়াল ও রাজেন্দ্রপুর রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী বনখড়িয়া এলাকায় রেললাইন কেটে ফেলায় ভোর ৪টার দিকে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ট্রেনযাত্রী আসলাম মিয়া নিহত ও লোকো মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
এর আগে গত ২৩ নভেম্বর রাতে বিএনপির অবরোধের মধ্যে নেত্রকোণা-ময়মনসিংহ রেলপথের নেত্রকোণা সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর এলাকার মগড়া নদীর ওপর কমলগঞ্জ রেলসেতুর স্লিপারে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।
পরে স্থানীয়রা এসে সেই আগুন নিভিয়ে ফেলায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। ঢাকা-মোহনগঞ্জ পথে চলাচলকারী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস সেই পথ দিয়েই চলাচল করে।