কেন্দুুয়ায় চুরির অপবাদ দিয়ে কিশোরের মাথা ন্যাড়া : মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন
চাচা হয়ে ভাতিজার মাথা আমি কেমনে কামাই (ন্যাড়া করি)
মজিবুর রহমান :
নেত্রকোণার কেন্দুুয়ায় চুরির অপবাদে আবুলায়েছ নামে ১৩ বছরের এক কিশোরকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন ও মাথা ন্যাড়াসহ পরিবারের কাছ থেকে জরিমানাও আদায় করেছে গ্রামের মাতাব্বররা।
এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি গত মঙ্গলবার রাতে উপজেলার বলাইশিমুল ইউপির সরাপাড়া গ্রামে ঘটে। ভিকটিম আবুলায়েছ সরাপাড়া গ্রামের বাক প্রতিবন্ধী দিনমজুর আব্দুস সালামের একমাত্র ছেলে।
ঘটনার পর লজ্জায় ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ভিকটিম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। বেধড়ক প্রহারের শিকার ভিকটিম আবুলায়েছ গুরুতর আহত হলেও মাতাব্বরগণের ভয়ে চিকিৎসা নিতে পারেনি।
গতকাল গণমাধ্যমকর্মীরা এলাকায় গেছে নড়েচড়ে বসতে চাইছেন অনেকেই। ভিকটিম আবুলায়েছ জানান, তার নিকটাত্মীয় অসুস্থ থাকায় খোঁজখবর নিতে মা নুরেছা তাকে মিনিট কার্ড কেনার জন্য গ্রামের সরাপাড়া বাজারে পাঠায়। তখন রাত প্রায় বারোটা বাজে। মিনিট কার্ড কেনার জন্য শাহীন মিয়া দোকানে গিয়ে ডাকাডাকির সময় পেছন থেকে চা দোকানি মতিউর তাকে ধরে ফেলেন। পরে ওই চা দোকানি গ্রাম ও বাজারের লোকজনকে ডেকে আনেন।
বলাইশিমুল ইউপির ৩ নং ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া, সাবেক মেম্বার হাদিস মিয়া, আবু তাহেরসহ আরো কয়েকজনের নেতৃত্বে রাতভর মধ্যযুগীয় কায়দা অমানুষিক নির্যাতন চালায় তার ওপর। মেরে বস্তায় ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকীও দেয় তারা। এক পর্যায়ে প্রাণ রক্ষায় চুরির বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হয় সে। বিষয়টি পরেরদিন সকালে বাজারের ব্যবসায়ী ও গ্রামের মাতাব্বরগণ সরাপাড়া বাজারে বসেন এক সালিশ বৈঠকে। এতে সভাপতিত্ব করেন বর্তমান ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া। পরে বিচারের ৩টি রায় ঘোষণা করে বাস্তবায়ন করা হয়।
এক. আবুলায়েছ মাথা ন্যাড়া করা। দুই. ১০টি বেত্রাঘাত ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পরে ভিকটিম পরিবারিক অবস্থা বিবেচনা করে জরিমানার অঙ্ক কমিয়ে দুই হাজার টাকা আদায় করা হয়।
গতকাল শুক্রবার বেলা ১১ টার দিকে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভিকটিম আবুলায়েছের বসবাসের জন্য একমাত্র বসতঘরটি জরাজীর্ণ।
কাঠের চৌকিতে কাঁথা মোড়া দিয়ে শুয়ে আছেন আবুলায়েছ। বেধড়ক পিটুনীর ফলে গায়ে প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতর সে। গায়ে আঘাতে চিহ্ন স্পষ্ট রয়েছে। ভালভাবে কথাও বলতে পারছিল না। দুইজনে ধরে ঘর থেকে বের করে বাহিরে আনলে তার নির্মমতার বর্ণনা দেন ভিকটিম আবুলায়েছ।
তাঁর বাক প্রতিবন্ধী বাবা মূখে কথা বলতে না পারলেও ইশারা ছেলের করুণ অবস্থা দেখিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেন তিনি। ঘটনার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানাজানি হলে নেট দুনিয়ায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
সালিশকারীও একে অন্যকে দোষারোপ করছেন। আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর সদস্যরাও তৎপর হতে দেখা যায়। ঘটনাস্থলে ছুটে যান ইউএনও কাবেরী জালাল এবং ওসি আলী হোসেন পিপিএম।
এদিকে বিকালে ভিকটিম কিশোরকে শুক্রবার কেন্দুুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে সেখানই তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসা খোঁজখবর রাখছেন ইউএনও এবং ওসি।
মা নুরেছা জানান, বাজারে বারোটা-একটা পর্যন্ত দোকান পাঠ খোলা থাকে। এই ভেবে জরুরি প্রয়োজনে মিনিট কার্ড আনার জন্য ছেলেকে বাজারে পাঠাই। কিছুক্ষণ পরেই খবর আসে তাকে চোর ভেবে আটক করেছে। তাৎক্ষণিক ছুটে যাই বাজারে। আমার কোন কথাই তারা শোনেনি। রাতভর আমার ছেলেকে মারপিট করেছে তারা। জান বাঁচাইতে চুরির কথা স্বীকার করে সে।
ভাঙ্গা ঘরে থাকি। চালের ওপর পলিটিন দিয়ে ঢেকে রাখছি। বাতাসে পলিটিন উড়াইয়া নিলে বৃষ্টি পানিতে ভিজে রাত খাটাই। ৫ জনের সংসারে অভাব অনটনের শেষ নেই। চুরি অপবাদ দিয়ে ছেলেডারে ইচ্ছামত মারছে তারা। বিচার কইরা মাথাডা চিলাইছে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিনা। ঘরে ভাত এর নেই তার ওপর ৫ হাজার জরিমানা ধরলে কাকুতি মিনতি করে দুই হাজার টাকা দিয়েছি। তাও আরেকজনের কাছ থেকে হাওলাত করে এনে দিয়েছি। টাকার জন্য ছেলে চিকিৎসা করাতে পারছি না। এই ঘটনার দুঃখে ক্ষোভে ও লজ্জায় ছেলেডা কারো সাথে কথা কয়না ভাতও খায় না। আমার ছেলেডারে সবুজ মেম্বার, হাদিস মেম্বার ও আবু তাহেরসহ কয়েকজনে মিলে মেরে শেষ করে দিয়েছে। আমি এই ঘটনার সঠিক বিচার চাই।
চা দোকানি মতিউর রহমান জানান, বাজারে প্রায়শই চুরি হয়। সেজন্য তিনি সর্তক থাকেন। টিনের শব্দ পেয়ে শাহীন মিয়া ঘরের গিযে তাকে আটক করি। পরে সবাইকে খবর দেই। বিচারে জরিমানা ৫ হাজার টাকা ধরেছিল পরে দুই হাজার টাকা দিয়ে মাফ চাইছে। বিচারের রায়ে আমিও দুটি বেত্রাঘাত করেছি ঠিকই। তবে কষ্টে তার দুই চোখে পানি চলে এসেছিল দাবী করেন তিনি।
শাহীন মিয়া জানান, ঘটনার সময় তিনি দোকানে ছিলেন না। খবর পেয়ে বাজারে আসেন। তার দোকানের দরজায় তালা লাগানো ছিল। দোকানঘরের ভেড়ার একটি টিন খোলা ছিল বলে দাবী করেন তিনি।
ভিকটিম কিশোরের চাচা লাইচউদ্দিন জানান, তার ভাতিজাকে চুরির অপবাদ দিয়ে মেরেছে। সালিশ বৈঠকের বিচারকারীরা ভাতিজা মাথা আমাকে ন্যাড়া করার হুকুম দেয়। চাচা হয়ে ভাতিজার মাথা আমি কেমনে কামাই (ন্যাড়া করি)। পরে তারা নাপিত এনে মাথা কামাইছে। আমরা এখন এই লজ্জায় বাইরে যেতে পারি না। তারা প্রভাবশালী মানুষ।
এব্যাপারে ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া কিশোরের মাথা ন্যাড়া ও বিচারের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি গ্রামের মেম্বার। সব দরবার সালিশে আমাকে সভাপতি করে। বিচার করছে তো গ্রামের মানুষ।
বাজারের ব্যবসায়ী কয়েকজন জানান, আবুলায়েছ এর আগে এলাকায় এই রকম চুরি করার ঘটনা ঘটায়নি। তার এই ঘটনার দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এব্যাপারে কেন্দুুয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মো. হোসাইন মোহাম্মদ ফারাবী জানান, বিষয়টি জেনেছি এবং পদক্ষেপ নিচ্ছি দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।