গল্প: মধ্য দুপুরের স্বপ্ন – আকিব শিকদার

প্রকাশিত: ১১:১৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২৫
গল্প:

মধ্য দুপুরের স্বপ্ন
-আকিব শিকদার

ঘেুটঘুটে অন্ধকার ঘরে দুটি জমজ শিশু যেন সামান্তার স্তন দুটি মুখে নিয়ে অনর্বরত চুষছে। বড্ড বেশি সুরসুরি লাগে সামান্তর স্তানে। এমনকি সারা দেহ জুড়ে। স্নয়বিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখে সে। অনভ্যস্ত শরীর। নিজের ঔরসজাত সন্তানের কঁচি ঠোটের অপটু লিকলিকানো তো প্রথম প্রথম এইরকমই লাগার কথা।

কই! তুহিন যখন নিপুন হাতের আঙ্গুলে কিংবা পৌরুষিক ঠোঁটের স্পর্শে আলতো ভাবে দলিত মতিথ করে, তখন তো এমন সুরসুরি লাগে না।

তুহিন সামান্তার স্বামী। শিশু দুটি পিপাসিত, সুরসুরি যতই লাগুক, এমন সময় এপাশ-ওপাশ করা যাবে না। একটু লড়তে গিয়ে যদি স্তন থেকে সন্তানদের মুখ ছুটে যায়, তবে ওরা ঘ্যানর ঘ্যানর করবে। ঘুম ভেঙ্গে যাবে পাশেই শুয়ে থাকা তুহিনের হয়তো বিরক্ত হবে। এসব বিষয়ে পুরুষেরা অসম্ভব রকম বিরক্ত হয়। সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব, সন্তানের যন্ত্রণা সহ্য করার দায়িত্ব যেন শুধু নারীদের, পুরুষদের নয়। তুহিনের বিরক্তির কথা ভেবে সামান্তা অনড় থাকে।

কলিংবেলের শব্দই তো! এই মাঝরাতে ঘুম ভাঙাতে আবার কে এলো! শব্দটার দিকে মনোযোগী হতে গিয়ে সামান্তার মনেহলো শব্দটা বুঝি কলিং বেলের নয়, মোবাইল ফোনের। পাখির কিচিরমিচিরের মতো সৃষ্ট শব্দটার দিকে আরেকটু বেশি মনোযোগী হতে গিয়ে ধরফরিয়ে জেগে উঠলো সামান্তা। ততক্ষণে বুকের উপর শুয়ে থেকে স্তন পানরত শিশু দুটি উধাও হয়ে গেল আর তুহিনও লাপাত্তা। চোখ জোড়া কচলাতে কচলাতে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল একি! বাইরে যে কাটাফাটা রোদ! এমন ভর দুপুরে কেউ স্বপ্ন দেখে! কিন্তু এটাত অবশ্যই স্বপ্ন। সামান্তার তো কোন সন্তানই নেই। সে আবার জমজ শিশু পেটে ধরল কখন! আর তার স্বামী তুহিন সেই যে সকাল আটটায় অফিসে গেছে, এই ভরদুপুরে তার তো সামান্তার সাথে শুয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না।

শব্দটা আবার যখন হলো, তখন সে দেখতে পেল বারান্দার গ্রিলে একজোড়া শালিক পাখির ছানা তাদের মায়ের ঠোঁট থেকে ঘাসফড়িং এর অংশ নিতে আপ্রাণ সংগ্রাম করছে। পাখিগুলো যতক্ষণ বারান্দার গ্রিলে ছিল, ততক্ষণই তাদের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল সামান্তা।

তুহিনের সাথে সমান্তার বিয়ে হয়েছে প্রায় এগারো বছর হতে চললো। এই এগারোটা বছরের মাঝে একটিবারও নিজের সন্তানের মুখে মা ডাক শোনার সৌভাগ্য তার হয়নি। তুহিন অফিসে চলে গেলে চার দেয়ালে বন্দী এই বিশাল বাসাটায় কথা বলার মতো মানুষটাও খুঁজে পায় না সামান্তা। তখন তাকে টিভি দেখে বই পড়ে আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় পার করতে হয়। এ সময় এক ধরনের নিঃসঙ্গতা দাতালো বিড়ালের মত কুরে কুরে খায় তাকে। চিন্তার চোরাকাটা যেন মস্তিষ্কের নরম ঝিল্লিতে ঘচঘচ করে বিঁধে। একটা শিশুই পাড়ে এই নিঃসঙ্গতা দূর করতে। খুব বেশি মা হতে ইচ্ছে জাগে তার।

বছর বছর সন্তান প্রসব করা মায়েদের উপর হিংসা লাগে সামন্তার। বিধাতা তাদের কি শক্তি দিয়েছে, যা তাকে দেয়নি! অবশ্য এজাতীয় মায়েদের কাছে পেলে সামান্তা প্রতিহিংসায় মনেমনে বলে – কাম নেই কাজ নেই বেটি প্রতিবছর একটা করে মানুষ বাড়ায়, আর এই দিকে জনবহুল পৃথিবীর কী দুর্দশা! কেন বাপু, এত কামোত্তেজনা কেন! স্বামীর কাছে না গেলে কী হয়! আর এতই যদি উত্তেজনা, তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ করলে কী হয়! দুনিয়াতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কি কম আছে!

সামান্তার প্রতি এক প্রকার করুনাপূর্ণ মনোভাবের প্রকাশ ঘটে ঐ সব মায়েদের। বিধাতা যাদেরকে তার অসীম দান থেকে বঞ্চিত করে রাখেন, পৃথিবীর মানুষেরা তাদেরকে দেখে করুনার দৃষ্টিতে। তারা বলে ধৈর্য ধরে থাকুন, সবুরে মেওয়া ফলে। সামান্তা ভাবে আর কত ধৈর্য ধরে থাকা! তার মেওয়া কি কোনদিন ফলবে না! নাকি মেওয়া অনেক আগেই ফলে গিয়ে ঝরে গেছে! কেউ কেউ অবশ্য খেয়াল ঠাট্টার বসে এমন সব কথা বলে বসেন যা শরীরে মাখতে গেলে ঝামার ঘষার মতো অমসৃণ ঠেকে – ুকেমন বেটার ঘর করেন গো আপনি, একটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারে না! পৌরষহীন পুরুষ।”

জবাবে সামান্তা ঠোঁটের ভেতর হাসি রেখে হাসে। চোখের পুত্তলি উদাস হয়ে যায়; মুখে কিছুই বলে না। এমন মুহূর্তে কৃত্রিম হাসি হাসাও যেন তার কাছে বাচ্চা প্রসব করার মতো কঠিন কাজ।

এইসব নির্দয় রসিকতার শেষে রসিকতাকারীগণ যখন চলে যায়, সামান্তার মনে তখন একটা প্রশ্নই বারবার উদয় হয়, কেমন পুরুষ বিয়ে করল সে! তুহিনের মাঝে পুরুষত্ব বলতে কি আসলেই কিছু নেই! তখন তার কিশোরীবেলার কথা মনে পড়ে। কিশোরীবেলার ভাদ্র মাসের কথা মনে পড়ে। ভাদ্রমাস মানেই কুকুরদের সঙ্গম মৌসুম। সামান্তা যখন কিশোরী ছিল, কুকুরদের সঙ্গম দেখতে তার খুব ভালো লাগতো। এক ধরনের গোপন উত্তেজনা নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে দাঁড়িয়ে কুকুরদের আদিমাচরণ দেখতো আর বিস্মিত হয়ে ভাবতো একটা মর্দা কুকুর কী করে পাঁচ পাঁচটা মাদী কুকুরকে নিয়ন্ত্রণে রাখে! পাঁচ পাঁচটা মাদী কুকুরের জন্য কি একটা মর্দ্দা কুকুরই যথেষ্ট! যথেষ্টই তো, না হলে নির্দিষ্ট সময় শেষে কুকুরগুলো তিনটে চারটে বাচ্চা প্রসব করে কি করে! শুধুই কি কুকুর! মোরগ মুরগির কথাই ভাবা যাক। একটা মোরগই নাকি হতে পারে সমস্ত পাড়ার মুরগিদের একমাত্র প্রণয়সঙ্গী। ভাবতে ভাবতে সামান্তার মনে আরেকটা ভাবনার উদয় হতো। একজন নারীর তুলনায় একজন পুরুষ কি তবে এতটাই বেশি শক্তিধর! তাই যদি হয় তবে একটা নারী একাই একজন পুরুষের ঘর করে কিভাবে! যে তার স্বামী হবে, সে যদি এত শক্তিধর হয় তবে তো সর্বনাশ! বছরান্তে তিনটা করে বাচ্চা প্রসব করতে হবে! বছরান্তে তিনটা বাচ্চার প্রসঙ্গ দূরে থাক, বিয়ের আগে যে পুরুষ জাতি সম্পর্কে তার এমন একটা মজবুত ধারণা ছিল, সেই পুরুষ জাতিরই একজন কি না বিয়ের এগারো বছরের সীমান্তে এসেও তার পেটে একটা শিশুর জন্ম দেওয়াতে পারল না। তখন তার মনে হতে থাকে তুহিন বুঝি সত্যি-সত্যিই পৌরষত্বহীন পুরুষ। তুহিনের মাঝে তেজদ্বীপ্ততা বলতে কিছু নেই, ঘুনে ধরা কাঠের দেবমূর্তি।

বিয়ের আগে তুহিনই বা কম ছিল কিসে! রাস্তায় বেরিয়ে যৌবনবতী নারী দেখলে মনেমনে বলতো – ুতোমার মতো নারীকে অজ্ঞান করে দেওয়া আমার জন্য পাঁচ মিনিটের কাজ।” কোলবালিশ জড়িয়ে না ধরলে ঘুমিয়ে আসতো না তার। আর মধ্যরাতে জেগে জেগে বালিশটাকে নগ্ন নারীর থলথলে শরীর আন্দাজ করে পুরুষসুলভ আচরণ। এমন মুহূর্তে রোমান্টিক দম্পতিদের মাঝে মুখের পাশে মুখে নিয়ে যেসব কথা হয় তারই অনুকরণে বালিশের কানে কানে ফিসফিস করে জানতে চাইতো সে- ুএই? বলো না গো, কখনো তুমি মা হবে আর আমি হব বাবা? আর যে দেরি সয় না।”

বালিশ তাকে বাবা বানাতে পারেনি। তারপর বালিশের সাথে কথা বলার দিন শেষ। জলজ্যান্ত মানুষ এলো সংসারে। সেই মানুষটাই কি পারলো তাকে বাবা বানাতে? যে লোকটা একটা নিস্প্রাণ বালিশের গর্ভে সন্তান জন্মদানের কথা ভাবতো, তাকেই কি না অফিস ঘরের টেবিলে সহকর্মীদের বিপরীত পাশে বসে শুনতে হয়- ুএগারোটা বছর কেটে গেল, এখনো পারলেন না বউকে সাইজ করতে? একটা মেয়ে মানুষ সাইজ করা কী এমন কঠিন কাজ!”

তুহিন কোনো জবাব দিতে পারে না। মাঘ মাসের বাঘ পালানো শীতে ভীষণ ঠোঁট ফাটা ব্যক্তির মতো হাসে। আর মনেমনে বলে – ুকেন শুধুই কথা বাড়ানো! পারলে কি আর এত কিছু!”
পুরুষ মানুষেরা শুধু বিষয় নিয়ে বোধ হয় কম ভাবে। তবু খোঁচা মেরে মনে করিয়ে দেওয়া আরকি। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষীদের দেওয়া এই খোচা খেয়ে মাঝে মাঝে জেগে উঠে তুহিন, জেগে ওঠে সামান্তা। দৈহিক ভালোবাসার সাথে যোগ করে নানা রকম বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মিস্রন। একটানা কয়েক দিন দাপাদাপির শেষে আবার পরিশ্রান্ত মানুষের মতো নেতিয়ে পড়ে পরবর্তী কোনো খোঁচা না খাওয়া পর্যন্ত। অথবা নতুন করে আশা না জাগা অবধি। যেমন আজ মধ্য দুপুরে এমন উদ্ভট একটা স্বপ্ন দেখে, মায়ের ঠোঁট থেকে ঘাসফড়িং এর অংশ নিতে আপ্রাণ সংগ্রামরত শালিক পাখির ছানাদের দেখে, সন্তানবতী হতে আখাঙ্কা জাগছে সামান্তার। অবশ্য ছানা দুটির প্রতি গভীর মমতা প্রদর্শনের জন্য মা শালিকটার উপর হিংসাও লাগছে তার। অপরের সুখ দেখে প্রতিহিংসায় জর্জরিত হওয়া মানুষের বড় দোষ।

সামান্তর স্পষ্ট মনে আছে বিয়ের তৃতীয় বছর তারা যখন ঈদ উপলক্ষে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল, তখন তুহিনের দাদি সম্বন্ধীয় একজন নাতির বউকে একলা পেয়ে খোঁচা দিয়েছিল ু ুকি রে নাতি, তিন তিনটা বছর তো কেটে গেল। এবার তোর কবরবাসী দাদাকে ডাকতে হবে নাকি?”

দাদির এই ঠাট্টার জবাবে সামান্তা তিনগুণ শক্তি সম্পন্ন খামচিটা দিয়েছিল – ুডাকলে ডাকুন না, এই বুড়ো বয়সে এতই যদি শখ। নিজের জন্য ইচ্ছা হলে ডাকুন।”

নাত-বউয়ের কথা শুনে ফিরতি জবাব সাথে সাথে দিতে পারেনি বৃদ্ধা। ঠাট্টা করে স্বামীকে ডাকতে চেয়েছিলেন, অথচ সময়ের ব্যবধানে স্বামীর অদৃশ্য ডাকে তিনি নিজেই চলে গেলেন অন্ধকার কবরের বাসিন্দা হয়ে। নিয়তির কারোসাজি ফেরানো অসম্ভব।

পৃথিবীটাকে যদি একটা রঙ্গমঞ্চ ভাবা যায়, আর সব মানুষের জীবনটাকে যদি নাটকের সাথে তুলনা করা যায়, তবে মন্দ হয় না। এই নাটকের রচয়িতা একজন, তিনি বিশ্বকর্মা, বিধাতা। নাটকের চরিত্রগুলোও নাট্যকার দ্বারা সীমাবদ্ধ। কোথায় কখন কোন চরিত্রের আগমন ঘটবে, কোন চরিত্রের প্রস্তান ঘটবে, তিনিই তা নির্ধারণ করে দেন। মানুষের জন্ম মৃত্যুর হিসাব লেখা হয় সে অনুযায়ী। বিধাতা নামক সেই নাট্যকারের নাটক লেখার দক্ষতার উপর আকাশছোঁয়া সন্দেহ হয় সামান্তার। বড় বেশি কাণ্ডজ্ঞানহীন আর কৃপণ এই নাট্যকার। তিনি যদি কাণ্ডজ্ঞানহীনই না হবেন, তবে যার সন্তান ভরণ পোষণের সামর্থ্য নেই তার ঘাড়ে একটার পর একটা সন্তান চাপিয়ে দেন কেন! পেটের দায়ে যে জন নিজের নিষ্পাপ শিশুকে বিক্রি করে দেয়, তার উদরে বছরান্তে একটা করে নতুন প্রাণের সরবরাহ দেওয়া কিসের নমুনা! আর তিনি যদি কৃপণই না হবেন, তবে বিশ্ব ভরা এতগুলো প্রাণ থেকে একটা সামান্তাকে দান করলেই বা তার ক্ষতি কোথায়! বিধাতার উপর তো আর মানুষের হাত থাকতে পারে না, বরং বিধাতার হাতই সবার উপর থাকে।
যার যা নেই, তা প্রাপ্তিরই স্বাভাবিক আখাঙ্কা থাকে মানুষের। না পাওয়া ধনটাকেই পাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে মানুষের মন। যখনই সামান্তা আল্লাহকে ডাকে, তার প্রার্থনায় থাকে সন্তান কামনা। তার স্বামী তুহিন যে তা করে না, তা নয়। আল্লাহ তাদেও আবদার না শুনলেও সেই পথ ছাড়ে না দুজনের কেউই। পাশাপাশি অন্য শক্তির দ্বারস্থও হয় তারা। শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ মতো পানি পড়া, তাবিজ-কবজ, শিন্নী দান কোনটাই বাদ যায় না। সবচেয়ে বেশি আশা যোগায় ডাক্তার ও কবিরাজগণ। ওদের কথা শুনলে মনে হয় পৃথিবীতে কিছুই অসাধ্য নেই। শুধু দেখে শুনে পথ চিনে নিয়ে সঠিক পথে পা রাখতে পারলেই হলো।
এগারো বছরের সংসার জীবনে ওরা কতবারই না গেল ডাক্তারের কাছে। শুধু দেশীয় বড় বড় ডাক্তারই নয়, দেশের বাইরেও গিয়েছে বেশ কয়েকবার। ডাক্তারগণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যে সব তথ্য দেয়, তার মর্মার্থ দাড়ায় – সমস্যা আসলে কারোরই নেই। নির্দেশনা মোতাবেক নিয়মিত দু’চারাটা ওষুধ সেবন আর অপেক্ষাই পারে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে। তবু কেন যেন ডাক্তারের কথায় অবিশ্বাস লাগে সামান্তার। তার মনে হয় ডাক্তার তার কাছে কিছু লুকাতে চাইছে। তুহিনের সন্তান জন্মদান ক্ষমতা নেই, ডাক্তার সেটা সরাসরি বলে দিলেই পাওে, কেন শুধু শুধুই ওকে ইনজেকশন গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সামান্তা আবার ভাবে, এমনটাও তো হতে পারে বাচ্চা জন্মদিনের ক্ষমতা তারই নেই। ডাক্তার এটা গোপন রেখে পরীক্ষা মূলক উলটা তুহিনকে চিকিৎসা করে ফলাফল পাওয়ার আশা করছে।

ডাক্তারদের পাশাপাশি সমান তালে চলে কবিরাজদের কেরামতি। কোন এক কবিরাজ নাকি বলেছিল মুরগির ডিম আর ডিমওয়ালা মাছ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। যেদিন শুনলো সেদিন থেকে তুহিন সামান্তা কেউই মুরগির ডিম আর ডিমওয়ালা মাছ ছুঁয়ে দেখেনি। মুরগির ডিম আর ডিমওয়ালা মাছ খেলে মুরগি ও মাছদের বংশবৃদ্ধিতে চরম বিঘ্ন ঘটে। তখন তারা বংশবৃদ্ধিতে বেঘাত ঘটানোর অপরাধে মানুষরূপী অপরাধীদের অভিশাপ দেয়। তাদের অভিশাপে অভিষিক্তদের সন্তান না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে জানিয়েছেন কবিরাজ সাহেব। আরেকজন কবিরাজ তুহিনকে বলেছেন প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদের মিম্বরের পাঠাতনে তিনটা করে মোমবাতি প্রজ্বলন করতে। এতে নাকি মনোবাসনা পূর্ণ হবে। যা শুনে তা অগ্রাহ্য করে না তারা। কারণ তারা জানে বিশ্বাসেই মুক্তি। কিন্তু কোন পথে কার মুক্তি লেখা, তা তো কারও জানা নেই।

পাশের গলির মাসুদ মাস্টারের বউয়ের তো বাচ্চা হয় না হয় না করেও প্রায় পাঁচ বছর কাটল। তারপর একদিন এক ভিখারিনী ভিক্ষা করতে এসে উদ্ভট এক গাছের সন্ধান দিয়ে গেল। সেই গাছের বাকলে সুতা বাঁধলে নাকি কাজ হয়। মাসুদ মাস্টারের বউ গাছে সুতা বাধলেন। পরপর তিন বছর তিনটা মরা বাচ্চা জন্মালো। তারপর জীবিত বাচ্চা। কী আশ্চর্য! মাসুদ মাস্টারের দুইটা মেয়ে এখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। ব্যাগ কাঁধে হেসে খেলে স্কুলে যায়। সব গাছের গুনে। অথচ সামান্তারই শুধু কিছু হলো না। মাসুদ মাষ্টারের বউয়ের আশা যেখানে আলো দেখে, সামান্তা কেন সেখানেই পড়ে থাকে অমাবস্যার আধারে। এর জন্য দায়ী নাকি বিশ্বাসের পার্থক্য। সামান্যতম অবিশ্বাসও অকৃতকার্য করে তপস্বীদের। আর সে কারণে কেউ পায়, কেউ পায় না। ফলাফল মেলে না কারো সাথে কারোর।

কবিরাজের কথা মত তুহিন অষ্টধাতুর আংটি ব্যবহার কওে, জাকের, গিরগিটির তেল ব্যবহার করে, আফ্রিকান বৃশ্চিকের মলম মালিশ করে। উৎকট গন্ধে ভোগতে হয়, কিন্তু বিনিময়ে ফলাফল কিছু হয় বলে বোঝা যায় না। তখন তুহিন মনেমনে ভাবে আর শুধু শুধু বিশ্বাস নিয়ে পড়ে থাকা নয়, অন্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

সামান্তা এই যে যমজ শিশুর স্বপ্নটা দেখল, এ স্বপ্নের অর্থ কী, তা কে জানে। নিশ্চয়ই হ্যা বোধক কিছু একটা হতে যাচ্ছে। তা না হলে এমন স্বপ্ন দেখবে কেন। লোকে বলে স্বপ্ন নাকি ভবিষ্যৎ দেখার একমাত্র মাধ্যম। ভবিষ্যতে কী হবে তার পূর্বাভাস পাওয়া যায় স্বপ্নের মাধ্যমে। মানুষ স্বপ্নের ফলাফল ব্যাখ্যা করে নিজের মত করে। কারও ব্যাখ্যার সাথে কারও ব্যাখ্যা মিলে না। তবু তারা নিজ নিজ ব্যাখ্যায় অটল থাকে। সামান্তা কার কাছে যেন শুনেছিল স্বপ্নের বর্ণনা কারও কাছে দিতে নেই, তবে নাকি স্বপ্ন সফল হয় না। তাই সে কারো সাথে তার স্বপ্নের কথা বলে না। এমনকি তুহিনের সাথেও না। এইতো গত সপ্তাহে সামান্তা স্বপ্ন দেখল সেই ঠাট্টার বয়সী মৃত দাদীমাকে। সামান্তা দেখলো দাদীমা তার কোলে একটা ফুটফুটে ছেলে শিশু তুলে দিতে দিতে বলছে – ুএই নে, তোর জন্য আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে আনলাম।” সামান্তা যে শিশুটাকে কোলে নিল অমনি তার মনে পরল যে দাদীমা তার কোলে শিশু তুলে দিচ্ছেন তিনি তো মারা গেছেন অনেক বছর আগেই। ধরফর করে ঘুম ভেঙে গেল সামান্তার। পাশেই ছিল তার স্বামী তুহিন। তুহিন জানতে চাইলো – ুকী হয়েছে? ভয়ের স্বপ্ন দেখেছো নাকি?” সামান্তা কোনো জবাব দিল না। কাঁপতে কাঁপতে তুহিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। আজকের স্বপ্নটা অবশ্য অন্যরকম। তুহিনকে স্বপ্নটা সম্পর্কে জানাবে কি না, তাই ভাবছিল সে।

সামান্তর সিথানে বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। সামান্তা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল অচেনা নাম্বার।
ুহ্যালো… কে বলছেন প্লিজ…”
ুভাবি, আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।”
ুশুভাকাঙ্ক্ষি তে বুঝলাম। কিন্তু নামটা কী?”
অপর প্রান্ত থেকে জবাব এলো – ুএই অধমের নাম রাজন। আপনার মঙ্গল কামনাকরী।”
ুরাজন” নামটা শোনা মাত্র সামান্তার গা জ্বলে উঠলো। ুআপনাকে না নিষেধ করলাম, আমার কাছে আর একবারও কল করবেন না।”
ুনিষেধ তো করলেন, কিন্তু নিষেধ মানা তো কঠিন। তার চেয়ে বড় কথা ভাবীর উপকারে যদি দেবরই না লাগবে, তবে লাগবে টা কে? শুনলাম আপনারা নাকি টেস্টটিউব বেবি নিতে চাচ্ছেন?”
ুহ্যা, নিতে চাচ্ছি। তাতে আপনার কী?”
ুনা, কিছু না। তবু যদি কোনো উপকারে লাগতে পারি, এই আর কি। এই যেমন ধরুন শুক্রাণু দেওয়া। তুহিন ভাইয়ের শুক্রানু তো আবার টেস্ট টিউবে দেওয়া দূরে থাক, দেহের বাইরে আনতে না আনতেই নষ্ট হয়ে যায়। পৌরষহীন পুরুষ, বাঘের চামড়া পরা মেছো বিড়াল।”
ুআপনি ভাবলেন কিভাবে, আপনার মত একটা রাসকেলের শুক্রাণু নেব আমি! ডাক্তারখানায় শুক্রাণুর কি অভাব আছে!”
ুনা, তা নেই। তবে অচেনা মানুষের শুক্রাণু নেওয়াটা কি নিরাপদ? হয়তো দেখা যাবে শুক্রাণু দানকারী লোকটা ডেঞ্জারাস কোন সিরিয়াল কিলার ছিল। নবজাতকের মাঝে সেই রক্তরস ছড়াবে। শিশু বড় হয়ে হবে ডেঞ্জারাস কিলার। তার চেয়ে চেনা জানা লোক দিয়ে কাজটা করিয়ে নিলেই তো ভালো হয়। কথা শুধু সেইটাই নয়, আমি থাকতে টাকা পয়সা খরচ করে ওসব টেস্টটিউব ফেস্টটিউবের কী প্রয়োজন! তুহিন ভাই তো সকাল আটটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত অফিস করে। আমি না হয় সপ্তাহে দুদিন আপনাকে বাসায় সময় দিলাম। লাভ তো আপনারই, আমার নয়।” ুআপনার সাহস তো কম নয়! আমাকে শুধু শুধু বিরক্ত করেন কেন? ফোন করা বন্ধ করবেন, নাকি তুহিনকে বলবো আপনার কথা?”
ুনা থাক, বলতে হবে না। এই যে ফোন রেখে দিচ্ছি। আর কখনো করবো না। তবে একটা কথা বলে রাখি। আমার নাম্বারটা সেভ করে রাখবেন। আপনার সামান্যতম প্রয়োজন মেটাতেও এই অধম জীবন দিয়ে দিতে পারে। আরেকটা কথা বলি; ওসব টেস্টটিউব ফ্যাস্টটিউব ভালো জিনিস না। বোতলের পেটের মানুষ, নিজের পেটের তো আর না। নিজের পেটে সন্তান ধরনের আনন্দই অন্যরকম। রক্ত মাংস আত্মার সাথে যে শিশুর বসবাস, বোতলজাত শিশুর সাথে তার তুলনা কোথায়! টেস্টটিউব বেবি পালন আর পুষ্য সন্তান পালনের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।”

রাস্কেলটার কথা শুনে সামান্তা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। খট করে মোবাইল ফোনের লাইন কেটে দিয়ে বিছানায় বালিশের নিচে রেখে দিলো। উত্তেজনায় মুখ ঘেমে উঠেছে তার। আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে। বারান্দার গ্রিলগুলোর ভেতর নিজেকে পিঞ্জিরাবন্দি পাখির মতো লাগলো। তাই সেখান থেকে মুক্ত হতে এক দৌড়ে ওঠে গেল ছাদে। কাঠ ফাটা রোদ। খা খা করছে চারপাশ। মধ্য দুপুরের মেঘহীন আকাশে প্রজ্বলিত সূর্যটা যেমন সাথীহীন, বিশাল বড় ছাদটার মাঝে সামান্তাও তেমনি একা। সমান্তর কেন যেন মনে হলো পৃথিবীতে বিশ্বাস বলতে কিছুই নেই। আল্লাহকে বিশ্বাস করো, ফল নেই। কবিরাজকে বিশ্বাস করো, ফল নেই। ডাক্তারকে বিশ্বাস করো, ফল নেই। টেস্টটিউবকে বিশ্বাস করবে, সেখানেই বা ফলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা কোথায়! এভাবে আর চলা যায় না। কিছু একটা করতেই হবে। তখন তার মনেহয় রাজনের যুক্তিগুলো তো একটাও অযৌক্তিক নয়। টেস্টটিউবের সাথে ঔরসজাত সন্তানের তুলনা মেলে! একা থাকার চেয়ে মাঝে মাঝে রাজনকে ডেকে আনলে কিবা সমস্যা! আর বিকাল বেলায় সোনালী আলোতে চা খেতে খেতে রাজন যদি সমান্তার হাতটা একটু ধরতে চায়, তাতেই বা কী ক্ষতি!