ছোটনের কুরবানির ঈদ

প্রকাশিত: ১:৪০ অপরাহ্ণ, জুন ১৫, ২০২৪

কেবারে নিঃস্ব, গরীব, অভাবি, সহায়সম্বলহীন স্বামী হারা এক বিধবা নারী সকিনা বানু ।সে তার ছয় সাত বছরের একমাত্র ছেলে ছোটনকে নিয়ে থাকে যশোর ঝিকরগাছার কপতাক্ষ নদের পশ্চিম পাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা একটা পল্লী গাঁয়ে। স্বামীর রেখে যাওয়া টালির ছাউনির ভাঙ্গাচুরা ছ্যাঁবড়ানো ছোট্ট একটা মাটির ঘর তার। সেই ঘরেই ছেলে ছোটনকে নিয়ে থাকে সে। জায়গা জমি অর্থ সম্পদ বলতে তার কোনো কিছুই নেই। মৃত স্বামীর শতক দুই মতো ভিটে-টুকুই তার একমাত্র সম্বল। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে ছোটনকে নিয়ে বিধবা সকিনা সেই ভিটে টুকু আঁকড়ে ধরেই পড়ে আছে।

সে, গাঁয়ের গৃহস্থদের বাড়িতে কাজ করে যেটুকু পাই। তা- দিয়েই ছেলে ছোটনকে নিয়ে দু,বেলা দু,মুঠো খেয়ে-পরে কোনো রকমে বেঁচে আছে। আসলে সত্যিকার অর্থে কোন মানুষের এভাবে বেঁচে না থাকা-টাকে বাঁচা বলে না। সমাজে অনেক বিত্তশালী লোক আছে। ইচ্ছা করলে তারা
কমবেশি সহায়তা করতে পারে। কিন্তু কে-বা-কার
জন্য মরে? এইতো কয়দিন আগে সকিনার ঘরের
চালের রো-বাটাম গুলো সব খসে খসে পড়ছিল।
বৈশাখ জ্যোষ্ঠের এমন ঝড়বৃষ্টির মাসে বসবাসের একেবারে অনুপযোগী হয়ে উঠেছিল তার ঘরটি। আর না হয়েও বা- করবে কি? মাখন মারা যাওয়ার পর যে এই কয়বছরে একবেরের জন্যও ঘরটা মেরামত কর হয়নি। এবছর অনেক কষ্ট সকিনা এর ঝাড়ের একটা বাঁশ ওর ঝাড়ের একটা বাঁশ নিয়ে।তার ঘরটা সে মেরামত করেছে।
ছোটনের বাপ মাখন বেঁচে থাকতে তাদের অবশ্য এতো-টা কষ্ট ছিলো না। পরের ক্ষেতে জনমজুর খেটে গরীব-আনা হালে বেশ ভালোই চলতো ওদের ছোট-খাটো সংসারটা।

“কিন্তু কথায় আছে না…কপালে যদি দুঃখ থাকে, তবে যে সুখ ছেড়ে যায় তাকে” আর তাইতো এক অন্ধকার রাতে গাঁয়ের বাজার থেকে বাড়ি ফিরার সময়। বিষধর সাপের কামড়ে। অকালেই প্রাণটা হারিয়ে বউ আর এক বছরের ছেলে ছোটনকে চিরতরের জন্য দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে মাখন চলে গেলো পরপারে। তারপর থেকে প্রায় সময় সকিনা খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে এপর্যন্ত ছেলেটাকে বড় করেছে।

এখন পুরো একটা বছরেও মাংস ওদের ভাগ্যে জোটেনা কিনা তার ঠিক নেই।আগে যখন বয়লার কিম্বা পোল্ট্রির মাংসের দাম আশি, একশো,থেকে একশো বিশ টাকা ছিলো।আর গরুর মাংসের দাম ছিল দুইশো ষাট থেকে দুইশো আশি টাকা। তখন অল্প হলেও কষ্টের মধ্যে মাঝেমধ্যে তবুও ওরা মাংস কিনে খেতে পারতো।
কিন্তু এখন আর….
“মাংস ওদের মতো ছ্যাপোষা হতদরিদ্র মানুষদের
কেনার সাধ থাকলেও যে সাধ্য নেই। এখন ওসব
কেনা যে ওদের সাধ্যের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ওসব এখন শুধুই ওদের জন্য কল্পনা। বর্তমান মাংসের যে লাগামহীন চড়া দাম। স্বামী হারা এক বিধবা নারী তা- কিভাবে কিনে খাবে? আর তাইতো মা,ছেলে সারাটা বছর প্রায়
অপেক্ষায় থাকে। কবে আসবে ঈদুল আজহা? কবে আসবে সেই কুরবানির ঈদ? যেদিন ধনীদের গরু ছাগল কুরবানির বন্টন করা মাংস পেয়ে মা, ছেলে মিলে একটু পরাণ ভরে খাবে।এইতো কয়েকদিন আগের কথা, ছোটন ওর মায়ের সাথে বাজারে গিয়েছিল। রাস্তা দিয়ে মাংসের দোকানের পাশ দিয়ে আসার সময়। হঠাৎ মাংসের দোকানের দিকে নজর গেলো ছোটনের। ছোটন, খুব ছোট মানুষ কচি মন। আর তাইতো মাংসের দিকে ছোটনের নজর যেতেই মাকে ডেকে বললো ও মা, মাগো… ঐ দেখো গরুর গোশত ঝুলছে। মা, কতো দিন হলো মাংস খায়নি। আমার না, খুব গরুর মাংস খেতে ইচ্ছে করছে মা। অল্প একটু মাংস কিনবে?কয়েকদিন আগে থাকার ঘরটা ঠিক করে সকিনার হাত এখন পুরো শূন্য। কিভাবে সে মাংস কিনে ছোটনকে খাওয়াবে?

ছেলের মুখে অমন কথা শুনে সকিনার অন্তর কেঁদে উঠে।তার দু,চোখ ভরে যায় জলে।ছোটনের আড়াল করে শাড়ির আঁচল দিয়ে দু,চোখের জল মোছে সকিনা। তারপর একটু নিচু হয়ে বসে ছোটনকে কোলের কাছে টেনে নেয়। মুখে চুমু দিয়ে। ছোটনের সারা গায়, মাথায় হাত বুলিয়ে বললো। বাবা ছোটন, এইতো আর মাত্র কয়েক-
দিন বাকি। তার পরেই তো কুরবানির ঈদ।

ঈদে সমাজের বড়লোক মানুষেরা অনেক গরু ছাগল কুরবানি করবে। তাদের কুরবানি দেওয়া গরু ছাগলের বন্টন করা মাংস দেবে আমাদের। তখন তুমি পেট ভরে খেও বাবা ছোটন, এখন বাড়ি চলো আমার লক্ষ্মীটি।
ছোট হলেও তার মায়ের চোখের জল। অসহায়ত্ব মুখ দেখে ছোটন বুঝতে পারলো তার মায়ের কাছে টাকা নেই। সে হেসে ওঠে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো আচ্ছা ঠিক আছে মা, তাহলে চলো। ঈদের দিন যখন অনেক মাংস পাবো। পেট দেখিয়ে বললো, তখন পেট ভরে খাবো তুমি আর আমি ঠিক আছে মা? সকিনা বানু বললো, আচ্ছা খেও বাবা এখন চলো।তারপর ছোটন আড়চোখে বারবার গরুর মাংসের দিকে তাকাতে তাকাতে তার মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরে আসে।

কয়েক দিনের মধ্যে দেখতে দেখতে ঈদ চলে এলো। ছোটন যখন পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে খেলতে যায়। তখন ওদের বলতে শোনে গাঁয়ে কারা কারা গরু ছাগল কুরবানি দিবে। শুনে মনে মনে ছোটন খুব খুশি হয়। ভাবে সবাই যখন মাংস দেবে।তখন তাহলে আমাদের অনেক মাংস হবে। সেসব শুনে তা-আবার বাড়ি এসে ওর মায়ের সাথে কই। আর অনেক আনন্দ করে। বলে মা, ঈদে তাহলে আমাদের অনেক মাংস হবে তাইনা?

মা, সকিনা বানু বলে হ্যাঁ, অনেক মাংস হবে বাবা।
রাত পোহালেই ঈদের দিন। কাল মাংস খাবে সেই আনন্দে ছোটনের দু, চোখে যেনো ঘুম নেই। রাতে মাকে বলে মা, কাল কিন্তু ঈদের পর সারাদিন আমি কুরবানির বন্টনের মাংস তুলে বেড়াবো। সকিনা ছেলের মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস দেখে মনে মনে সেও খুশি হয়। বলে ঠিক আছে বাবা এখন ঘুমাও। সকালে ছোটনের ঘুম ভেঙ্গতেই দ্রুত দাঁত মেজে মাকে বললো মা গোসল করিয়ে আমাকে গুছিয়ে দাও। সকিনা বানু ছেলে ছোটনকে গোসল করিয়ে পুরোনো যে জামা কাপড় টুপি জুতা আছে তা পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো।তারপর বিশটি টাকা হাতে দিয়ে বললো ছোটন এটা রাখো বাবা, ঈদের মাঠে গিয়ে মিষ্টি কিনে খেও। ছোটন খুশিতে মায়ের মুখে ছোট্ট করে একটা চুমু দিলো। সকিনা বানুও ছেলে ছোটনের কপালটাতে আদর মাখা চুম্বন দিলো। ছোটন ঈদের নামাজ পড়তে ঈদগাহে চলে গেলো। নামাজ শেষে মিষ্টি কিনলো ছোটন। সে মিষ্টি নিজে খেয়ে মায়ের জন্যও আনলো বাড়িতে। তারপর মায়ের হাতে রান্না করা মিষ্টি ফিরনী সেমাই খেয়ে মাকে বলে চলে গেলো কুরবানির বন্টন করা মাংস ধরতে। গাঁয়ের বিভিন্ন জায়গায় গরু ছাগল জবেহ করে ছুলা কুটা করছে। তা- দেখে ছোটনের যেনো মনে আর আনন্দ ধরে না। সেসব ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকতে থাকে ছোটন।একসময় অপেক্ষার পর মাংস বন্টন
শুরু হলো। ছোটন কুরবানির সে বন্টন করা মাংস ধরে অল্প বেলায় বাড়ি ফিরলো। এসে হাসি মুখে সেই মাংস তার মায়ের হাতে দিয়ে বললো। দ্যাখো মা, আমাদের আজ কতো মাংস হয়েছে। তাড়াতাড়ি তুমি রান্না করো মা। আজ তুমি আর আমি পেট ভরে মাংস দিয়ে ভাত খাবো। সকিনা ছোটনের হাত থেকে মাংস নিয়ে বললো, এইতো
এক্ষুনি রান্না করছি। তারপর সকিনা বানু সে মাংস ধুয়ে রান্না শুরু করলো। ছোটন অপেক্ষা করতে লাগলো কখন তার মায়ের গোশত রান্না করা শেষ হবে। ছোটন মাঝেমাঝে ঘুরে ফিরে রান্না করার চুলার কাছে গিয়ে তার মায়ের মাংস রান্না দেখছে।

আর বলছে মা, গরুর মাংস রান্নার কি সুন্দর গন্ধ বলো? সকিনা বললো হুম, খেতে আরো ভালো লাগবে বাবা ছোটন। কিছুক্ষণ পর সকিনার মাংস রান্না শেষ হলো। প্লেটে ভাত বেড়ে গরুর মাংস দিয়ে ছোটনকে দিলো। ছোটন বললো, মা তুমিও নাও একসাথে খায়। সকিনা বললো, নিচ্ছি তুমি খাও বাবা ছোটন। তারপর সকিনা নিজের জন্য অন্য একটি প্লেটে ভাত গোশত নিলো। ছোটন ইচ্ছা মতো তৃপ্ত সহকারে খেতে লাগলো। আর. মা, সকিনা বানু। তা-দু, চোখ ভরে দেখে যেনো মনে শান্তি অনুভব করতে লাগলো।

লেখকঃ ফারুক আহম্মেদ জীবন
নারাংগালী, ঝিকরগাছা, যশোর, বাংলাদেশ।