ছোট গল্প: নীলিমার নীলে
লেখকঃ অভিষেক
নভেম্বরের এক বিকেল। শীতের মৃদু পরশে প্রকৃতি যেন নরম আলিঙ্গন দিচ্ছে। ঢাকার ব্যস্ত শহরের কোলাহল পেরিয়ে শান্ত এক পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে নীল। একটি পুরানো খাতা আর কলম তার হাতে। পার্কের বাতাসে গোলাপের মৃদু গন্ধ মিশে আছে, যা নীলকে প্রতিবারের মতোই মনে করিয়ে দেয় এক বিশেষ মানুষের কথা—নীলিমা
নীলিমা, নীলের জীবনের সেই গল্প যা লেখা হয়নি, বলা হয়নি। কিন্তু তবু প্রতিটি নিঃশ্বাসে বেঁচে আছে।
নীল আর নীলিমার প্রথম দেখা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বইমেলায়। দুজনেরই পছন্দ বই, আর সেই ভালোবাসার সূত্র ধরেই তাদের পরিচয়। সেদিন নীলিমা তার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের বই খুঁজছিল। দোকানের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা নীল তার হাতে তুলে দিয়েছিল “বনলতা সেন”।
– “ধন্যবাদ” বলেছিল নীলিমা।
– “জীবনানন্দের কবিতা ভালোবাসেন?” জিজ্ঞেস করেছিল নীল।
– খুব। আপনারও পছন্দ?”
– “পছন্দ না, বলতে পারেন ভালোবাসা।”
সেই ছোট্ট কথোপকথন থেকেই শুরু হয় তাদের বন্ধুত্ব। একসঙ্গে পড়তে যাওয়া, সিনেমা দেখা, গানের আসরে যাওয়া—সময় যেন ডানায় ভর করে উড়ছিল। নীলের মনে গভীর এক ভালোবাসা জন্ম নিচ্ছিল। কিন্তু নীলিমা যেন ছিল অন্য জগতে। তার চোখে ছিল স্বপ্নের রাজ্য।
একদিন, সন্ধ্যার নরম আলোয়, হাতের এক চিঠি নিয়ে নীল হাজির হয় নীলিমার সামনে। চিঠিতে লেখা ছিল— “নীলিমা, তোমাকে প্রথম দিন থেকে ভালোবাসি। তোমার হাসি, তোমার কথা, তোমার চোখ—সবকিছু আমাকে ঘিরে রেখেছে। আমি জানি না তুমি কী ভাববে, তবে আমার এই কথাগুলো জানানো দরকার। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়।”
নীলিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “নীল, আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু আমি তোমাকে একা করে যেতে চাই না। আমার ভবিষ্যৎটা এখনো পরিষ্কার নয়। সময় দাও আমাকে।”
নীল জানত, অপেক্ষা তার জন্য কঠিন হবে। কিন্তু নীলিমার চোখে আশা ছিল। তাই সে সম্মতি দিল। দিন গড়াতে লাগল। নীলিমা নিজেকে ব্যস্ত রাখত পড়াশোনায় আর কাজের মাঝে। অন্যদিকে, নীল প্রতিদিন সেই পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসত, যেন নীলিমার কথা শোনা যায় বাতাসে। একদিন নীলিমার ফোন এল।
– “নীল, আমি একটা প্রজেক্ট নিয়ে লন্ডনে যাচ্ছি।”
– “কতদিনের জন্য?”
– “ছয় মাস। কিন্তু জানি না, এরপর কী হবে।”
নীল থমকে গেল। ছয় মাস—তার মনে হলো ছয় বছর! কিন্তু নীল কিছু বলল না। শুধু বলল, “তুমি ভালো থেকো। আর যদি সময় হয়, ফিরে এসো আমার কাছে।”
ছয় মাস কেটে গেল। নীল প্রতিদিন নীলিমার খোঁজ পেত শুধু তার চিঠিতে। নীলিমা প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখত। চিঠির শব্দগুলো যেন নীলের পৃথিবীকে আলোকিত করত।
একদিন, এক গরম বিকেলে, নীলিমার চিঠি এল। কিন্তু এই চিঠি অন্যরকম।
– “নীল, আমি হয়তো আর ফিরে আসব না। আমি জানি, আমার স্বপ্ন আর তোমার স্বপ্ন ভিন্ন। কিন্তু তুমি আমার জীবনের এক অপূর্ব অংশ হয়ে থাকবে। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ।”
নীলের পৃথিবী ভেঙে গেল। সেই পার্ক, সেই বেঞ্চিটা, সেই গোলাপের গন্ধ, সবকিছু অর্থহীন হয়ে গেল তার কাছে। নীল নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখল। দিন বদলাতে লাগল, ঋতু বদলালো। কিন্তু নীলের হৃদয়ে একরকম শূন্যতা থেকেই গেল।
দু’বছর পর, একদিন নীল আবার সেই পুরোনো পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছিল। ঠিক যেখানে বসে নীলিমার জন্য চিঠি লিখেছিল। হঠাৎ শুনতে পেলো পরিচিত এক কণ্ঠস্বর।
– “নীল?” নীল তাকিয়ে দেখল—নীলিমা!
– নীলিমা বলল, “তুমি জানো, আমি কখনো পুরোপুরি চলে যাইনি। তোমার চিঠিগুলো আমাকে ধরে রেখেছিল। আর ফিরে আসার সাহস জুগিয়েছিল।”
নীল চুপ করে রইল। তারপর বলল, “তুমি জানো, আমি কখনো তোমাকে ভুলিনি। তুমি কি এবার থেকে যাবে?”
নীলিমা হাসল। সেই হাসি, যা নীলের মনে ঝড় তুলে দিত।
– “হ্যাঁ, এবার থেকে আমি আর যাব না। তুমি আমার চিরকালের নীল।”
নীল আর নীলিমার গল্প যেন জীবনানন্দের কবিতার মতো সুন্দর আর মুগ্ধকর। তাদের ভালোবাসা ছিল অপেক্ষা, ত্যাগ আর একে অপরের জন্য অগাধ বিশ্বাসের প্রতীক।
নীল আর নীলিমা নতুনভাবে শুরু করল তাদের জীবনের অধ্যায়। আর সেই পার্ক, সেই বেঞ্চি, গোলাপের গন্ধে মাখা সেই জায়গা এসব সাক্ষী হয়ে রইল তাদের প্রেমের। নীল নীলিমার চিঠি কোনো শেষ নয়, বরং এক চিরন্তন ভালোবাসার গল্প, যা সময়কে অতিক্রম করে যায়।
লেখক : অভিষেক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত