ছোট গল্প: মেথর থেকে নেতা

প্রকাশিত: ৫:১৫ অপরাহ্ণ, জুন ৯, ২০২৪

ছোট গল্প: মেথর থেকে নেতা
লেখক: পঞ্চভূত

বহুদিন আগের কথা। এক হিন্দু ভদ্রলোক ঋণের দায়ে পড়ে তার ৪ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে দিবেন। এই সমস্যার কথা তার আশেপাশে প্রতিবেশীদের জানালেন। কিন্তু তার জায়গা রাখার মত সাধ্য কোন প্রতিবেশীর নেই। কারণ জমির মূল্য অনেক। তিনি তখন কি করবেন? একদিকে ঋণের চাপ, অন্যদিকে এত চড়া দামে জমি কেউ কিনতে চায়’না। নিরুপায় হয়ে তিনি বাহিরে প্রচার দিলেন। কিন্তু বাহিরের লোকেরাও এসে ফিরে যায় জমির দরদাম শুনে। মহা বিপদে পড়লেন ভদ্রলোক। এদিকে ঋণের চাপ বাড়তে থাকে।

হঠাৎ একদিন এক দলিত সম্প্রদায়ের লোক এসে জিজ্ঞেস করে , আমি আপনার জায়গাটি রাখতে চাই, যদি আপনি আমার কাছে বিক্রি করেন। ভদ্রলোক বললেন, জমির ন্যায্য মূল্য দিতে পারবে তুমি। মেথর লোকটি বললো কেন পারবো না। আমি আপনার জমির উপযুক্ত মূল্য দিয়েই ক্রয় করবো। ঠিক আছে। তাহলে তুমি টাকা নিয়ে এসো আমি দলিল করে দেবো।

ভদ্রলোকের এই কথা শুনে মেতর লোকটি পরের দিনেই টাকা নিয়ে হাজির হয় ভদ্রলোকের বাড়িতে। ভদ্রলোক টাকা পেয়ে আনন্দে মেতর লোকটিকে তার জমিটি দলিল করে দিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর মেথর লোকটি সপরিবার নিয়ে চলে এলেন তার ক্রয় করা জমিতে। সেখানে এসে একটি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করে বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার কাটতে লাগলো। দিন যেতে লাগলো মেতর এর পরিবার আশেপাশের প্রতিবেশীদের সাথে একটু একটু করে গভীর সখ্যতা গড়ে তুললো। এখন সে এই ভদ্র সমাজের এক প্রতিবেশী নামে পরিচিত লোক। সে এই সমাজে কারও সুখে দুঃখে বিপদে আপদে আচার উৎসব যেকোন অনুষ্ঠানে আগে আগে থাকে।

প্রতিবেশীরাও তাকে ছাড়া কোন উৎস অনুষ্ঠানে যায়না। এভাবেই জাত পাত ভুলে গিয়ে একটি অশিক্ষিত মেথর পরিবার এক পরিজন হয়ে মিশে গেল এই ভদ্র সমাজের শিখরে। এখন আর কেউ তারে বলেনা সে মেতর, সে হরিজন বা দলিত কোন সম্প্রদায়ের লোক। মুছে গেল তার জন্মের ইতিহাস। এখন সে এই সমাজের এক সমাজপতি। অনেকেই তাকে এখন বাবু নামে ডাকে। এভাবে এক যুগ কেটে গেল তার এই সমাজের ভেতর। এরই মধ্যে তার ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলো। অপর দিকে তখন ঘনিয়ে আসে স্থানীয় ইউপি নির্বাচন। প্রতিবেশীরা গুণগুণ করছে বাবুকে এইবার নির্বাচনে ধার করিয়ে দেবে। যেই না কথা অমনি একদিন সবাই মিলে এই বাবুকে ধরে নিয়ে শল্লা পরামর্শে বসে গেল। সিদ্ধান্ত হল, আমাদের বাবুকে নির্বাচিত করতে হবে। এক মাস কেটেকুটে পাশও করিয়ে দিল তাদের বাবুকে। বাবু এখন এই সমাজের নির্বাচিত মেম্বার সাব। সে এখন তাদের সবার নেতা। তারা এখন যেকোন বিষয় আশয়ে বাবুর কাছে ছুটে আসে সমাধান নিতে। বাবুও তাদের এক ডাকে সাড়া দেন।

যত দিন যেতে লাগলো বাবুর ভাগ্য তত প্রসন্ন হতে ছিল। এদিকে বাবুর একটি অপ্সরি মেয়ে ঘরে। পাশের এক প্রতিবেশী মাষ্টার মশাইয়ের এক ডিগ্রিধারী ছেলের সাথে পিরীত চলছিল। কেউ জানেনা এই পিরীতের কথা। খুব নিরবে চলছিল তাদের এই পিরীত। এদিকে বাবুর মেয়ে বড় হয়েছে অনত্রে বিয়ে দিয়ে দেবে বাবু। এই কথা শুনে মাষ্টার মশাই এর ছেলে বাবুর ঘরে গেল নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তার সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে চায় সে। বাবু তো আনন্দে আত্মাহারা। ছেলেকে বললো তোমার মা বাবা ও আশপাশের প্রতিবেশীদেরকে নিয়ে এসো। আমরা জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে আমাদের মেয়ে ছেলের বিয়ে দেবো। ছেলে তখন তার বাবার কাছে গিয়ে এ কথা জানালো, বাবা তো রেগে মেগে আগুন। কি! মেথরের মেয়েকে তুই বিয়ে করবি? আমি মরে গেলেও এই মেথরের মেয়েকে ঘরে আনবো না। মানুষ সারাজীবন বলবে মেথরের সাথে আত্মাীয় আমার। এই অপমান আমার সহ্য হবেনা। আমার বংশে এই দাগ লাগাতে চাইনা। একটি কথা মনে রেখো, পাশাপাশি বসবাস আর প্রতিবেশী হলেই জন্মের ইতিহাস মানুষ ভুলে যায়না। তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও, নইলে তোমাকে আমি মেরেই ফেলবো।

ছেলে নিরাশ হয়ে ফিরে যায় বাবুর কাছেই। বাবু আর কি করবে। নিশ্চুপ হয়ে রয়। কিন্তু তার মেয়ে তো আর নিশ্চুপ থাকার মেয়ে নয়। চলছে নীরবে তাদের দেখা সাক্ষাৎ। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ তাদের মধ্যে মেলামেশা গড়ে ওঠে। আর সেই মিলন থেকে গর্ভে চলে আসে তাদের সন্তান। এই খবর যখন রটে গেল তাদের সমাজে। এখন কি করবে মাস্টার মশাই? অপরদিকে বাবু তখন তার মেয়ের সম্মান বাচাতে গিয়ে তার প্রতিবেশীদের ডাক দিলেন। পরামর্শ চাইলেন বাবু, এই অবস্থায় আমি এখন কি করতে পারি আপনারা বলেন। তখন উপস্থিত সবাই সম্মসুরে বলে উঠল, ডাকো মাস্টার মশাইকে। মাস্টার মশাই দরবারে হাজির হলেন। দরবারের উদ্দ্যেশে মাষ্টার মশাই বললেন, আমার অপরাধ? আপনার ছেলে বাবুর কন্যেকে সর্বনাশ করেছে। এর বিচার চাই। বিচার কি হবে? এক সপ্তাহের মধ্যে এই মেয়েকে আপনার পুত্রবধু করে ঘরে তুলতে হবে। নইলে আমরা সবাই মিলে আপনার বিরুদ্ধে সালিসে যাবো। অথবা আপনাকে এই সমাজ থেকে দূর্রা মেড়ে উচ্ছেদ করবো। কি ভয়ংকর স্বীদ্ধান্ত! এই কি ছিল মাস্টার মশাইয়ের কপালের লিখন। এই মেথরের কাছে তার সম্মান বিসর্জণ দিতে হবে। মাষ্টার মশাই মনে মনে ভাবলেন, আমি এখন কি করবো,কার কাছে যাবো, কে আছে এমন আমার দুঃখটা বুঝবে। এমন কুপুত্র কেউ জন্ম দেয়, আমি কেন দিলাম? দরবারে নিরব নিশ্চুপ বসে আছেন মাস্টার মশাই। আজ তার পাশে কেউ নেই। সবাই বাবুর সুরে সুর মিলাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মাস্টার মশাই নিরবতা ভেঙে দিয়ে সাহসে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,আমি মরে গেলেও এই মেয়েকে ঘরে তুলতে পারবো না। যেইনা এই কথা তিনি বললেন, অম্নি সবাই সম্মসুরে ধর, ধর, ধর ওরে। ওরে জুতাপিটা কর, ন্যাড়া করে দেয় ওর মাথা। তাৎক্ষনিক কয়েকজন ধরে নিয়ে একটি গাছের সাথে বেঁধে ফেললো মাস্টার মশাইকে। দরবারের মধ্যমণিরা হুকুম দিলেন, আগে ওর মাথাটা ন্যাড়া কর, পরে আর যতক্ষণ পর্যন্ত রাজী না হবে ততক্ষণ ওরে পাথর মারেতে থাক। একটা সময় পাথর মারতে মারতে রক্তাক্ত অবস্থায় মাস্টার মশাইকে রেখে সবাই চলে যায়! কি নির্মম প্রহার! এই অপমান আর আঘাতের যন্ত্রনা নিয়ে ঘরে ফিরে মাস্টার মশাই, এর পরদিন মারা যান তিনি। তাতেও পাষন্ড ছেলের মনে বিন্দুমাত্র চির ধরেনি। উল্টো কিছু দিন যেতে না যেতেই বাবুর কন্যেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘরে আনলেন তার শিক্ষিত ছেলে। তাদের সংসার তখন ভালোই চলছিল আশেপাশের প্রতিবেশীদের নিয়ে। পিতার এমন অপমানজনক মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে মাতাও কিছুদিন পর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান পরপারে। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে তাদের সন্তান। বাহির লোকের সমবয়সী ছেলে মেয়েরা তার ছেলেকে দেখলেই মেথরের নাতি বলে ডাকে। এই যে মেথর শব্দটি তার কানে বিষের মত লাগে। কিন্তু কি করবে সে। এ কথা তো সত্য, তার ছেলে সত্যিই মেথরের নাতি। পাড়া প্রতিবেশীদের বারণ করে দিলেন তার ছেলেকে যেনো এ নামে কেউ না ডাকে আর, মাস্টার মশাইয়ের নাতি বলে ডাকতে হবে, কিন্তু কে শুনে কার কথা। যেদিকেই যায় মেথরের নাতি বলেই ডাকে। এই যে প্রচলন তা মুছবে কি করে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় অন্যত্রে চলে যাবে এই সমাজ ছেড়ে। নিরবে বাসা বাড়ি বিক্রি করে একদিন স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে অন্যত্রে চলে যায়।।