ছোট গল্প : সুশ্চম

প্রকাশিত: ১০:৫৬ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ৫, ২০২৪

ছোট গল্প : সুশ্চম
লেখক : অ ভি ষে ক

কলকাতার এক কোণের ছিমছাম এলাকায় অবস্থিত একটি পুরোনো বাড়ি, ‘সুশ্চম’। যার অর্থ হলো সুন্দরতম। বাড়িটি বেশ কিছুদিন ধরেই ফাঁকা পড়ে ছিল। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে সেখানে হঠাৎ করে আলো জ্বলতে শুরু করেছে।

এলাকার মানুষ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে—
এ বাড়িতে নতুন কেউ নির্ঘাত এসেছে!

রাত্রি ৯টা। রুদ্র, একজন তরুণ সাংবাদিক, ঘরে বসে খবরের কাগজের কিছু পড়ে থাকা কাজ করছিলো এমন সময় হঠাৎ দরজায় শব্দ। দরজা খুলে দেখে, কেউ নেই। কিন্তু একটি খাম পড়ে আছে। খামের মধ্যে একটি নিমন্ত্রণপত্র।

তাতে লেখা:
‘‘আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে ‘সুশ্চম’-তে। কাল রাত ১১টায়। কারণ আপনি সত্য খুঁজতে চান।’’

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ভাবতে লাগল। এই বাড়ির কথা সে এর আগেও অনেকবার শুনেছে। একসময় বাড়ির মালিক, অমূল্য মুখার্জি, তার পুরো পরিবারসহ রহস্যজনকভাবে এই বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এত বছর পর এই নিমন্ত্রণ কেন?

রুদ্র পরদিন ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল ‘সুশ্চম’-এ। বাড়ির পরিবেশ বেশ ভয়ানক—জমাট অন্ধকার, ভাঙাচোরা আসবাব। দরজাটা একটু ঠেলতেই খটাস শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে রুদ্র হাঁটতে শুরু করল। হঠাৎ, ঘরের এক কোণে একটা মোমবাতি জ্বলতে দেখে তার বুক ধড়াস করে উঠল। একটি কাগজ রাখা। তাতে লেখা আছে: ‘‘প্রথম ধাপ শেষ। এখন দোতলায় যাও।’’

রুদ্রের শরীর শিউরে উঠল। কিন্তু সত্য খুঁজে বের করার তাগিদে সে এগিয়ে গেল। দোতলায় উঠতেই পেছন থেকে দরজায় শব্দ হল।

দোতলার ঘরে একটি বড় আয়না। তার সামনে একটি চেয়ার। রুদ্রের দিকে চেয়ারটি মুখ করে রাখা। আচমকা আয়নায় কিছু একটা নড়াচড়া করল। সে পিছনে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেল না। তবে আয়নায় সে একটি ছায়া দেখতে পেল, যা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

— ছায়াটি বলল, ‘‘তুমি কি জানো কেন এখানে এসেছ?’’
— রুদ্রের কণ্ঠ জড়িয়ে গেল, ‘‘কেৃ কে তুমি?’’
—ছায়াটি বলল, ‘‘আমি সেই পরিবারের অভিশাপ, যারা এই বাড়িতে থাকত। তুমি যে গল্প জানতে চাও, সেটা বলে দেবো। কিন্তু এর জন্য তোমাকে একটা খেলা খেলতে হবে। তুমি পারবে?’’

রুদ্র অত না ভেবে খেলতে রাজি হয়ে গেল। ছায়াটি রুদ্রকে তিনটি ধাঁধা দিল। প্রতিটি ধাঁধা সমাধান করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পুরোনো রহস্যগুলো সব তার সামনে খুলে যেতে লাগল।

প্রথম ধাঁধা তাকে নিয়ে গেল একটি লুকানো ঘরে। সেখানে সে দেখতে পেল একটি ছবি—অমূল্য মুখার্জি এবং তার স্ত্রী মাধুরীর। পেছনে লেখা: ‘‘ভুল মানুষকে বিশ্বাস করলেই সর্বনাশ।’’

দ্বিতীয় ধাঁধায় বের হল, অমূল্য মুখার্জি তার ব্যবসায়িক পার্টনারের দ্বারা প্রতারিত হন। কিন্তু কেন তারা পরিবারসহ নিখোঁজ হলেন, সেটা এখনও অস্পষ্ট।

শেষ ধাঁধার উত্তর দিতে গিয়ে রুদ্র বুঝতে পারে, তার নিজের পরিবারের সঙ্গেও এই বাড়ির রহস্যের যোগসূত্র রয়েছে। তার দাদু, যারা একসময় অমূল্য মুখার্জির ব্যবসার অংশীদার ছিলেন, তারাও এই ঘটনার সাথে জড়িত।

হঠাৎ ছায়াটি বলল, ‘‘তোমার পরিবার আমাদের সর্বনাশ করেছিল। কিন্তু তোমাকে আমি সতর্ক করতে চেয়েছি, কারণ তুমি আমাদের গল্প সবার সামনে আনতে পারো।’’

রুদ্র বুঝতে পারে, সে একটি বিশাল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। এই রহস্য উন্মোচন করতে গেলে তার নিজের জীবনও বিপদে পড়বে।

পরদিন বাড়ি ফিরে রুদ্র তার খবরের কাগজে একটি রিপোর্ট লিখে প্রকাশ করে, যেখানে অমূল্য মুখার্জির পরিবারের গল্প এবং তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা আছে। লেখার সময় কোনো তথ্য গোপন করেনি রুদ্র। ঘটনাটি চারিদিকে নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে যেতেই, ঘটনার সাথে জড়িত অপরাধীরা একে একে সব ধরা পড়তে থাকে।

কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। এক রাতে রুদ্র বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ পেছনে একটি ছায়া দেখতে পায়। সেই একই ছায়া। ছায়াটি বলছে- ‘‘আমাদের গল্প তুমি সবার সামনে এনেছ। কিন্তু যাদের সাথে সত্য মিশে আছে; তারা কখনো ছায়ার থেকে মুক্তি পায় না। কক্ষনো না।’’

কথাটি শোনার পর রুদ্রের গা দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে পেছনে তাকাল, কেউ সেখানে নেই। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রুদ্র দেখে ‘ সুশ্চম ’-এর ঘরে আলো জ্বলছে….