তরুণদের প্রতি ইসলামের প্রত্যাশা

পাঁচটি বস্ত্তকে পাঁচটি বস্ত্তর পূর্বে গুরুত্ব দিবে এবং মূল্যবান মনে করবে। (১) বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে (২) অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে (৩) দরিদ্যতার পূর্বে সচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে

প্রকাশিত: ২:১৭ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২২, ২০২৩

ইসলামিক জার্নাল ডেস্কঃঃ
এ পৃথিবীতে মানুষের জীবনকে মোটামুটি তিনটি স্তরে বিভক্ত করা যায়। শৈশব, কৈশোর ও বার্ধক্য। শৈশব ও কৈশোর অবস্থায় তেমন কোন সুষ্ঠু চিন্তার বিকাশ ঘটে না। পক্ষান্তরে বার্ধক্য অবস্থায় আবার চিন্তা শক্তির বিলোপ ঘটে। কিন্তু যৌবনকাল এ দুইয়ের ব্যতিক্রম। যৌবনকাল মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বা সম্পদ।

এ সময় মানুষের মাঝে বহুমুখী প্রতিভার সমাবেশ ঘটে। যৌবনকালে মানুষের চিন্তাশক্তি, ইচ্ছা শক্তি, মননশক্তি, কর্মশক্তি, প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। এক কথায় এ সময় মানুষের প্রতিভা, সাহস, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি গুণের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। এ সময়েই মানুষ অসাধ্য সাধনে আত্মনিয়োগ করতে পারে। যৌবনের তরতাজা রক্ত ও বাহুবলে শত ঝড়-ঝাঞ্ঝা উপেক্ষা করে বীর বিক্রমে সামনে অগ্রসর হয়।

এ বয়সে মানুষ সাধারণত পূর্ণ সুস্থ ও অবসর থাকে। তাই এটাই হচ্ছে আল্লাহর পথে নিজেকে কুরবানীর উপযুক্ত সময়। ডাঃ লুৎফর রহমান বলেন, ‘গৃহ এবং বিশ্রাম বার্ধক্যের আশ্রয়। যৌবনকালে পৃথিবীর সর্বত্র ছুটে বেড়াও, রত্নমাণিক্য আহরণ করে সঞ্চিত কর, যাতে বৃদ্ধকালে সুখে থাকতে পার’। জর্জ গ্রসলিভ বলেন, ‘যৌবন যার সৎ ও সুন্দর এবং কর্মময় তার বৃদ্ধ বয়সকে স্বর্ণযুগ বলা যায়’। তাই যৌবনকালকে নে‘মত বলে গণ্য করা যায়।

এই অমূল্য নে‘মতের যথাযথ সংরক্ষণ এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করা সকল মুসলিম যুবকের নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) মূল্যবান উপদেশ দিয়ে গেছেন। রাসূল (ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,

اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفِرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ-

‘পাঁচটি বস্ত্তকে পাঁচটি বস্ত্তর পূর্বে গুরুত্ব দিবে এবং মূল্যবান মনে করবে। (১) বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে (২) অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে (৩) দরিদ্যতার পূর্বে সচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে’।

(তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৭৪; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩৩৫৫; ছহীহুল জামে‘ হা/১০৭৭।)

যৌবনের ইবাদতকারীর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কঠিন হাশরের ময়দানে আরশের ছায়ায় স্থান দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। হাদিসে এসেছে-‘কেয়ামতের কঠিন ময়দানে আরশের ছায়ায় ৭ শ্রেণির ব্যক্তিরা স্থান পাবে। তন্মধ্যে একশ্রেণির ব্যক্তি হলো তারা- যারা যৌবনে আল্লাহর ইবাদত করতো বা আল্লাহর ভয়ে যাদের চোখ থেকে পানি ঝরতো।’

যৌবনকালের গুরুত্ব কত বেশি তা হজরত ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কথা থেকেই প্রমাণিত। তিনি বলতেন-‘যৌবনকাল হলো এমন এক বস্তু যা হাতের তালুতে রাখা ছিল কিন্তু পড়ে গেল। ইবাদতে সময় দেওয়ার উপযুক্ত কাল হচ্ছে তোমার যৌবকন কালের দিনগুলো। তুমি কি জান; যৌবনের দিনগুলো তোমার কাছে আগত মেহমানের মতো! খুব দ্রুত তা তোমার কাছ থেকে বিদায় নেবে। আর তাই যা করার তা যদি এখনি না কর, তবে অনুশোচনা তোমাকে দীর্ঘদিন দগ্ধ করবে।’

ইসলামের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে তরুণ ও যুবকদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ফলে দেখা যায়, ইসলামের একেবারে প্রথম দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের বেশির ভাগই ছিলেন কিশোর ও যুবক। প্রসিদ্ধ সাহাবিগণ ১০ থেকে ৩৭ বছর বয়সের আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। যদিও বয়সের ব্যাপারটা ঐতিহাসিকদের মতে কমবেশি হতে পারে।

যুদ্ধের নেতৃত্ব অগ্রাধিকার : ইসলামের প্রতিটি যুদ্ধে মুসলিম যুবকরা যে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে তা অদ্যাবধি মুসলিম ইতিহাসে অলংকৃত হয়ে আছে। যায়দ ইবনে হারিসা রা:, জাফর ইবনে আবি তালিব রা:, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা:কে মুতার যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব দেন। তারা সবাই ছিলেন যুবক। উসামাহ বিন যায়েদকে কাফেলার আমির বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সে। উততাব বিন উসায়েদকে হুনাইন যাওয়ার আগে মক্কায় দায়িত্বশীল বানিয়েছেন যখন তার বয়স বিশের কিছু বেশি। মুআয ইবনে জাবাল রা:কে ৩০ বছরের কম বয়সে ইয়েমেনের গভর্নর নিয়োগ করেন। তরুণ বয়সেই আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র রা: বালকদের বাইয়াতের জন্য নেতৃত্ব প্রদান ও মুসআব ইবনে উমাইর রা:কে মদিনায় দাঈ হিসেবে পাঠানো হয়।

এ ছাড়া কুরআন ও হাদিস সংরক্ষণে যুবাদের দায়িত্ব দেয়াসহ রাসূল সা: অন্যান্য কাজেও যুবাদের গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি ইতিহাস থেকে জানা যায়।

বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মাদ (সা.) বিশ্বমানবতার কল্যাণে তরুণদের নিয়েই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংগঠন ‘হিলফুল ফুযুল যুব সংঘ’ গঠন করেছিলেন। হজরত মোহাম্মাদ (সা.) যখন দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে মাঠে নেমেছেন সর্বাগ্রে তরুণরাই এগিয়ে এসেছেন। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত উমর (রা.) তরুণ বয়সে ইসলাম কবুল করেন। আসহাবে কাহাফে যারা ছিলেন তারাও ছিলেন তরুণ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, হে নবী! আপনার কাছে আমি তাদের আসহাফে কাহাফ’র ইতিবৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করেছি, তাঁরা ছিল কয়েকজন তরুণ। তাঁরা তাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছিল এবং আমি তাদেরকে সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করে দিয়েছি। (সূরা কাহাফ : ১৩)।

ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হজরত বেলাল (রা.) ছিলেন তরুণ। হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পাষন্ড নমরুদের তৈরিকৃত আগুনে নিক্ষিপ্তি হয়ে ছিলেন তিনি ছিলেন তরুণ। হজরত ইউসুফ (আ.) যখন কারাগারে ছিলেন তখন তিনি তরুণ ছিলেন। হজরত ইউনুস-কে (আ.) যখন সমুদ্রের মাছ গিলে ফেলে তখন তিনি ছিলেন তরুণ। হজরত দাউদ (আ.) যখন জালিম শাসক জালুতকে হত্যা করেন তখন তিনিও ছিলেন তরুণ।

যুুদ্ধের ময়দানে তরুণরা : যুদ্ধের ময়দানেও তরুণরা ছিলেন সক্রিয়। বদরের যুদ্ধে হজরত মাআজ ও মুআজ (রা.) নামক দু’জন তরুণ সাহাবি ইসলামের ঘোর দুশমন আবু জাহিলকে হত্যা করেন। খায়বার বিজয়ী বীর সেনানী শেরে খোদা হজত আলী (রা.) যিনি কামূছ দুর্গের লৌহ কপাট উপড়িয়ে ফেলে এক মুষ্টিতে নিয়ে এটাকে যুদ্ধের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন তখন তিনিও ছিলেন তরুণ। মুতার যুদ্ধের সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ তিনিও ছিলেন তরুণ। স্পেন বিজয়ী সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদ তিনিও ছিলেন তরুণ। এছাড়া অন্যান্য যুদ্ধের সেনাপতি হজরত আবু বকর (রা.), হজরত আলী (রা.), হজরত উমর (রা.), হজরত উসমান (রা.), হজরত জাফর (রা.), হজরত যায়েদ ইবনে হারিসা (রা.) হজরত তাইয়ার (রা.), হজরত যুবায়ের (রা.), হজরত তালহা (রা.), হজরত অব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.), হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদসহ (রা.) প্রায় সাহবায়ে কেরামগণ ছিলেন তরুণ।

ভারত বিজয়ী সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসেম যখন ভারতে ইসলাম প্রচার করেন তখন তিনিও ছিলেন তরুণ। কুতাইবা বিন মুসলিম যিনি এশিয়ার মধ্যে ইসলামের বিজয় ঘটান তখন তিনিও ছিলেন তরুণ। বাংলাদেশেও অনেক আলেম-উলামা, ওলী-আওলিয়াগণ ইসলামের প্রচার-প্রসার করেন তাদের প্রায়ই ছিলেন তরুণ।

১৯২৯ সালে যখন ভারতের কুখ্যাত কাফির ‘রাজপাল ‘রঙ্গিলা রাসূল’ নামে একটি বই প্রকাশ করে এবং এ বইটিতে মহানবী (সা.)-এর চরিত্র হনন এবং রাসুল (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করে তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আলিম উদ্দিন নামে এক ভাই শহীদ হন তিনিও ছিলেন তরুণ। আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়েকটি সংগ্রাম হয়েছে, বিশেষ করে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্র ভাষার সংগ্রাম, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ১৯৯২ এর বাবরী মসজিদ রক্ষার আন্দোলন, ১৯৯৪-এর নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলন, ২০০১-এর ফাতওয়া বিরোধী আন্দোলন, ২০১১-এর কুরআন বিরোধী রায় বাতিলের প্রতিবাদে আন্দোলন, ২০১৩ সালে নব্য নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনসহ সব আন্দোলনেই তরুণরাই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছেন। সবগুলোর পেছনে রয়েছে তরুণদের বলিষ্ঠ ভূমিকা।

এখনও তরুণরাই ইসলাম, নবী, দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের তরুণদের পদচারণায় আজও মুখরিত। বিশ্বজুড়ে চলছে আজ তরুণদের জয়-জয়কার। জাতির প্রাণের স্পন্দন তরুণ সমাজ। তরুণরা যে উদ্দেশ্যেই জেগেছে সে উদ্দেশ্যই অর্জন করেছে। এমনিভাবে ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে তরুণদের আত্মত্যাগর কথা। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে তরুণদেরই জেগে উঠতে হবে, জাগাতে হবে জাতিকে। মায়ের আঁচলে লুকিয়ে নয়, বোনের স্নেহের ডোরে বাঁধা পড়ে নয়, বাবার শক্ত চাহনিতে ঘরের আড়ালে লুকিয়ে নয়। ইসলাম-মানবতা এবং জাতির কল্যাণে তরুণদের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের কান্ডারী ছাত্রনেতাদের হতে হবে সুশিক্ষিত, আদর্শবান এবং ধার্মিক চেতনার অধিকারী।

 

সংকলন:
মাও: আবু তাহের নেত্রকোণী
প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম ক্বাওমি মাদ্রাসা।
ভূগী, পূর্বধলা, নেত্রকোণা।
নিয়মিত লেখক, ইসলামিক জার্নাল বিভাগ
নেত্রকোণা জার্নাল।