তাগুত কাকে বলে? তাগুত কত প্রকার?

প্রকাশিত: ৮:৪১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩

ইসলামিক জার্নাল ডেস্কঃ
আরবি طاغوت এর মূল অর্থ সীমালঙ্ঘন করা৷ লিসানুল আরব অভিধান মতে-
كُلُّ مُجَاوِزِ حَدَّهُ فِي الـعِصْيَانِ طَاغِِ

“যে বা যারা আনুগত্যের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করে তারাই তাগুত৷”তাগুত শব্দ এসেছে “তাগা” যার অর্থ “সীমা লংঘন করা”। ঈমানের পূর্ব শর্ত সমস্ত তাগূতকে অস্বীকার করা৷
فَمن َيَّكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَيُؤْمِنْ بِاللّٰهِ فَقَدِسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوسْقٰي ـ
“সুতরাং যারা তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে তারা আল্লাহর রজ্জুকে (দ্বীনকে) দৃরভাবে ধারণ করবে৷”
[সূরা বাক্বারা: ২৫৬]

এখানে প্রথমে তাগুতকে অস্বীকার করা, পরে ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে৷ অর্থাৎ যে তাগুতকে অস্বীকার করবে সে-ই ঈমান আনবে অন্যথায় নয়। আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর উপাসনা করা হয় এবং যে এতে রাজি-খুশি থাকে, তাকে তাগুত বলা হয়। প্রত্যেক অনুসৃত অথবা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য বাদ দিয়ে যাদের আনুগত্য করা হয় তাদেরকেও তাগুত বলা হয়।

পবিত্র কোরআনে মোট আট স্থানে ‘তাগুত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একজন মানুষ মুসলমান হওয়ার প্রথম ধাপ হলো ঈমান আনা।কিন্তু ঈমান আনার আগে তার জন্য জরুরি হলো ‘তাগুত’ বর্জন করা। এদিকে ইঙ্গিত করে প্রথমে ‘তাগুত’ ত্যাগ করতে বলা হয়েছে, পরে ঈমান আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে ও আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, অবশ্যই সে দৃঢ়তর রজ্জু আঁকড়ে ধরে, যা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়…।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫৬)

‘তাগুত’ শব্দের মূল অর্থ হলো সীমা লঙ্ঘন।পরিভাষায়, মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্য যা কিছু প্রভু ও উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে, তা-ই ‘তাগুত’। প্রতিটি যুগ, জায়গা ও সমাজে ‘তাগুত’ বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আসে। আসে নতুন রং, ভাষা ও পদ্ধতিতে। আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যে এ মর্মে রাসুল পাঠিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো ও ‘তাগুত’ বর্জন করো। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষকে আল্লাহ সৎ পথে পরিচালিত করেন এবং কিছুসংখ্যকের জন্য বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, মিথ্যা আরোপকারীদের কী পরিণতি হয়েছিল। [সুরা : নাহল, আয়াত : ৩৬

‘তাগুতে’র মূল কাজ হলো, মানুষকে ঈমানের পথ থেকে কুফরের দিকে নিয়ে যাওয়া। ইরশাদ হয়েছে, “যারা কুফরি করে, তাদের অভিভাবক হচ্ছে ‘তাগুত’। এরা তাদের আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়…।” (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫৭)

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (রহ.) তাঁর ‘মাজমুআহ আততাওহিদ’, পৃষ্ঠা ১৪ ও ১৫-তে লিখেছেন,‘তাগুত’ প্রধানত পাঁচ প্রকার।

এক. শয়তান। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বনি আদম, আমি কি তোমাদের নির্দেশ দিইনি যে তোমরা শয়তানের দাসত্ব কোরো না…?’ (সুরা: ইয়াসিন, আয়াত : ৬০)

দুই. আল্লাহর বিধান পরিহারকারী অত্যাচারী শাসক। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ করোনি, যারা দাবি করে যে তারা ঈমান এনেছে ওই বিষয়ে, যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার আগে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তার প্রতি। অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা (তাগুত) প্রত্যাখ্যান করার জন্য…।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৬০)

তিন. যে ব্যক্তি আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুসারে ফয়সালা করে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘…আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, সে অনুযায়ী যারা ফয়সালা করে না তা আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা আপনার উপর যে কিতাব নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে বলে দাবী করে? তারা বিচার ফয়সালার জন্য তাগুত [খোদাদ্রোহী শক্তি] এর কাছে যায়, অথচ তা অস্বীকার করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর শয়তান তাদেরকে চরম গোমরাহীতে নিমজ্জিত করতে চায়।’’ (নিসা . ৬০)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, “তাগুত হচ্ছে ঐ সকল উপাস্য, নেতা-নেত্রী যাদের আনুগত্য করতে গিয়ে সীমালঙ্ঘন করা হয়। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে বাদ দিয়ে যাদের কাছে বিচার-ফায়সালা চাওয়া হয় অথবা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদাত করা হয়।

অথবা আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন দলিল-প্রমাণ ছাড়া যাদের আনুগত্য করা হয়। অথবা আল্লাহর আনুগত্য মনে করে যে সকল গাইরুল্লাহর আকীদাহ ইবাদাত করা হয়। এরাই হলাে পৃথিবীর বড় বড় তাগুত।

তুমি যদি এই তাগুতগুলাে এবং মানুষের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য কর তবে অধিকাংশ মানুষকেই দেখতে পাবে যে, তারা আল্লাহর ইবাদাতের পরিবর্তে তাগুতের ইবাদাত করে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কাছে (কুরআন ও সুন্নাহর কাছে) বিচারফায়সালা চাওয়ার পরিবর্তে তাগুতের কাছে বিচার-ফায়সালা নিয়ে যায়। আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করার পরিবর্তে তাগুতের আনুগত্য করে। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে তাগুতের নির্দেশ পালন করে।”

মুহাম্মাদ হামেদ আল-ফী (রহ.) বলেন, তাগুত সম্পর্কে সালাফদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে যা জানা যায় তার সারমর্ম হলাে:“আল্লাহর আনুগত্য, আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য ও ইবাদাত এবং আল্লাহর জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করার পরিবর্তে যাদের আনুগত্য ও ইবাদাত করা হয় অথবা আল্লাহর ইবাদাতের সঙ্গে যাদেরকে মাধ্যম হিসেবে অথবা আল্লাহর অংশীদার হিসেবে আনুগত্য করা হয় তারা সকলেই তাগুত।

এ তাগুত জিন শয়তান, মানুষ শয়তান, গাছ, পাথর ইত্যাদি সবই হতে পারে। এমনিভাবে আল্লাহর আইন বাতিল করে মানবরচিত সকল আইন-কানুন অবশ্যই এই তাগুতের অন্তর্ভুক্ত।

যেমন: আল্লাহর হুদুদ, হাদ্দল কিসাস (খুনের বদলে খুন), হাদুস সারিকা (চোরের হাত কাটার বিধান), হাদ্য যিনা (যিনা-ব্যভিচারের শাস্তি)। এমনিভাবে আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হালাল করা। যেমন, সুদকে হালাল করে দেয়া, যিনা-ব্যভিচারকে হালাল করে দেয়া।

মানবরচিত সকল আইন-কানুন যেমন তাগুত, তেমনিভাবে যারা এগুলাে তৈরি করেছে, যারা এ সকল মানবরচিত আইনে বিচার-ফায়সালা করে সেসব বিচারক এবং যারা মানবরচিত আইনের বিচার-ফায়সালাকে বাস্তবায়ন করে সে সকল বাহিনী এবং যারা এই মানবরচিত সংবিধান পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে জড়িত তারাও তাগুত।

এমনিভাবে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের পরিবর্তে যে সকল আইনের বই রচনা করা হয়েছে সে বইগুলাে এবং যারা এগুলাে রচনা করেছে চাই তারা জেনে-বুঝে রচনা করুক বা বুঝে করুক তারা সকলেই রাসূলুল্লাহ যে সত্য নিয়ে এসেছিলেন তা হতে লােকদেরকে ফিরিয়ে রাখার কারণে অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য থেকে ফিরিয়ে গায়রুল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্যের দিকে আহ্বান করার কারণে তাগুত বলে বিবেচিত।

সংকলন:
মাও: আবু তাহের নেত্রকোণী
প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম ক্বাওমি মাদ্রাসা।
ভূগী, পূর্বধলা, নেত্রকোণা।
নিয়মিত লেখক, ইসলামিক জার্নাল বিভাগ
নেত্রকোণা জার্নাল।