নামাজের ইকামতের সময় মুসল্লিরা কখন দাঁড়াবেন?
ইকামত শুরু হলে দাঁড়ানো থেকে বসে যাওয়া, এটাকে সুন্নাত মনে করা বিদআতি কর্ম।ত
ইসলামিক জার্নাল ডেস্কঃ
লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো মসজিদের নামাজের সময় দেখা যায় অনেকেই ইকামাতের জন্য ১/২ মিনিট আগে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরকম দাঁড়িয়ে থাকাটা শরীয়তের দৃষ্টিতে কেমন তা নিয়ে কিছু আলোচনা করব আজ ইনশাল্লাহ।
এ বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে বুঝার জন্য উক্ত বিষয় সম্পর্কিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রাঃ এর আমল আমরা দেখে নেই।
১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখার সাথে সাথেই হযরত বেলাল রাঃ ইকামত বলা শুরু করতেন। দেখার আগেই ইকামত বলতে শুরু করতেন না। ইকামত শুরু হতেই মুসল্লিগণ সকলে দাঁড়িয়ে কাতার সোজা করতে শুরু করতেন।
عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ، قَالَ: «كَانَ بِلَالٌ يُؤَذِّنُ إِذَا دَحَضَتْ، فَلَا يُقِيمُ حَتَّى يَخْرُجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَإِذَا خَرَجَ أَقَامَ الصَّلَاةَ حِينَ يَرَاهُ»
২। জাবির ইবনু সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে, তখন বিলাল (রাঃ) আযান দিতেন এবং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের না হওয়া পর্যন্ত ইকামাত দিতেন না। তিনি বের হলে তাকে দেখে ইকামাত দিতেন। [সহীহ মুসলিম-১/২২১, হাদীস নং-৬০৬, ইফাবা-১২৪৭]
بِأَنَّ بِلَالًا كَانَ يُرَاقِبُ خُرُوجَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأول مايراه يَشْرَعُ فِي الْإِقَامَةِ قَبْلَ أَنْ يَرَاهُ غَالِبُ النَّاسِ ثُمَّ إِذَا رَأَوْهُ قَامُوا فَلَا يَقُومُ فِي مَقَامِهِ حَتَّى تَعْتَدِلَ صُفُوفُهُمْ
৩। হযরত বেলাল রাঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বের হবার জন্য অপেক্ষা করতেন। তিনি অধিকাংশ লোকদের দেখার পূর্বে প্রথমে দেখেই ইকামত শুরু করে দিতেন। তারপর যখন সকলে নবীকে দেখতে পেতেন, তখন তারাও দাঁড়িয়ে যেতেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাতার সোজা হবার আগে স্বীয় স্থানে দাঁড়াতেন না। [ফাতহুল বারী, দারুল ফিকির বাইরূত-৩/১৪১, আশরাফিয়া দেওবন্দ-২/১৫৩, নং-৬৩৭, উমদাতুল কারী, বাইরূত-৫/১৫৩, যাকারিয়া-৪/২১৫, যুরকানী আলাল মুয়াত্তা-১/১৩৪]
৪। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জমানায় এটাই নিয়ম ও আমল ছিল যে, ইকামত শুরু হতেই সকলে দাঁড়িয়ে কাতার ঠিক করতে শুরু করতেন। ইকামত শেষ হবার জন্য বা হাইয়া আলাল ফালাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করে বসে থাকতেন না।
ক)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ: «أَنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ تُقَامُ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَيَأْخُذُ النَّاسُ مَصَافَّهُمْ، قَبْلَ أَنَّ يَقُومَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَقَامَهُ»
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য সালাতের ইকামাত বলা হতো। তিনি আপন জায়গায় দাঁড়াবার পূর্বেই লোকেরা নিজ নিজ কাতারে দাঁড়িয়ে যেত। [সহীহ মুসলিম-১/২২০, হাদীস নং-৬০৫, ইফাবা-১২৪৬]
খ)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: «أُقِيمَتِ الصَّلَاةُ، وَصَفَّ النَّاسُ صُفُوفَهُمْ، وَخَرَجَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَامَ مَقَامَهُ،
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার সালাতের ইকামাত হলো। লোকেরা তাদের কাতার করে দাঁড়ালেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বের হয়ে এসে তাঁর স্থানে গিয়ে দাঁড়ালেন। [সহীহ মুসলিম-১/২২০, হাদীস নং-৬০৫, ইফাবা-১২৪৫]
গ)
أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ: أُقِيمَتِ الصَّلَاةُ، فَقُمْنَا، فَعَدَّلْنَا الصُّفُوفَ، قَبْلَ أَنْ يَخْرُجَ إِلَيْنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ” فَأَتَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى إِذَا قَامَ فِي مُصَلَّاهُ،
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা সালাতের ইকামাত দেওয়া হয়। তখন আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে বের হয়ে আসার আগে আমরা কাতার গুলো সোজা করে নিলাম। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে তাঁর মূসাল্লায় গিয়ে দাঁড়ালেন। [সহীহ মুসলিম-১/২২০,হাদীস নং-৬০৫, ইফাবা-১২৪৪]
ঘ)
وَعَن سعيد بن الْمسيب وَعمر بن عبد الْعَزِيز: إِذا قَالَ الْمُؤَذّن: الله إكبر، وَجب الْقيام، وَإِذا قَالَ: حَيّ على الصَّلَاة، اعتدلت الصُّفُوف، وَإِذا قَالَ: لَا إِلَه إِلَّا الله، كبر الإِمَام. وَذَهَبت عَامَّة الْعلمَاء إِلَى أَنه: لَا يكبر حَتَّى يفرغ الْمُؤَذّن من الْإِقَامَة
হযরত সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব এবং উমর বিন আব্দুল আজীজ রহঃ থেকে বর্ণিত। যখন মুয়াজ্জিন আল্লাহু আকবার বলে, তখন নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া আবশ্যক। আর যখন ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ বলে ততক্ষণে কাতার সোজা হয়ে যাবে। আর যখন বলবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তখন ইমাম সাহেব তাকবীরে তাহরীমা বলবে। জমহুর উলামাগণ বলেন যে, তাকবীরে তাহরীমা ততক্ষণ বলবে না, যতক্ষণ না মুয়াজ্জিন ইকামত শেষ করে। [উমদাতুল কারী, বাইরূত-৫/১৫৩, যাকারিয়া-৪/২১৫, ফাতহুল বারী, দারুল ফিকির বাইরূত-৩/১৪১, আশরাফিয়া দেওবন্দ-২/১৫৩, নং-৬৩৭]
৫। ঘটনাক্রমে কখনো এমনো হয়েছে যে, হযরত বেলাল রাঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের পূর্বেই ইকামত দিয়ে দিয়েছেন। আর সাহাবাগণও ইকামত শুনে দাঁড়িয়ে নবীজীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দয়ার্দ্রতার কারণে বলে দেন যে, আমি বের হবার আগে ইকামত হয়ে গেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে না। বরং যখনি আমাকে দেখতে পাবে তখন নামাযের জন্য দাঁড়াবে।
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِذَا أُقِيمَتِ الصَّلَاةُ فَلَا تَقُومُوا حَتَّى تَرَوْنِي»
আবূ কাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন সালাতের ইকামাত দেওয়া হয় আমাকে না দেখা পর্যন্ত তোমরা দাঁড়াবে না। [সহীহ মুসলিম-১/২২০, হাদীস নং-৬০৪, ইফাবা-১২৪২]
এ হাদীস দ্বারা কখনোই এ উদ্দেশ্য নয় যে, হাইয়া আলাস সালাহ বলার আগ পর্যন্ত না দাঁড়িয়ে বসে থাকবে।
সারাংশঃ–
১- ইকামতের শুরুতেই মুসল্লিগণ নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে যাবে। এটাই নবীজী ও সাহাবাগণের আমলের অনূকুল।
২- শুরুতেই দাড়ানো উচিত। কারণ এতে কাতার সোজা করা সহজ হয়। আর কাতার সোজা করার নামায পূর্ণতার শর্ত।
৩- তবে যদি কেউ বসে থাকে, তাহলে হাইয়া আলাল ফালাহ পর্যন্ত বসে থাকার অনুমতি আছে। এরপর নয়।
৪- ইকামত শুরু হলে দাঁড়ানো থেকে বসে যাওয়া, এটাকে সুন্নাত মনে করা বিদআতি কর্ম।কারণ সাহাবাগণ ইকামত শুরু হলে দাঁড়াতেন।
সুতরাং ইকামত শুরু হলে বসাকে জরুরী মনে করা বা সুন্নত মনে করা বিদআত হবে। এমনিতে বসাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সুন্নত মনে করলে বিদআত হবে। (والله اعلم بالصواب)
সংকলন:
মাও: আবু তাহের নেত্রকোণী
প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম ক্বাওমি মাদ্রাসা।
ভূগী, পূর্বধলা, নেত্রকোণা।
নিয়মিত লেখক, ইসলামিক জার্নাল বিভাগ
নেত্রকোণা জার্নাল।