নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধু: বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী

আমার কিশোর ও যুবক বয়সে নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধুকে বহুবার দেখেছি এবং তার সভায় গিয়ে বক্তৃতাও শুনেছি- লেখক

প্রকাশিত: ৩:৪৭ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৫, ২০২৩

নেজা ডেস্ক :
মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে উঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বাঙালি জাতির উন্মেষ ঘটিয়ে আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে যদি আমরা অস্বীকার না করি তাহলে দেখতে পাবো আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল হাজার বছর ধরে বাঙালি ভাষাভাষি মানুষের অবশ্যম্ভাবি পরিণতি ।বাংলা স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়েছে বিভিন্ন নায়কের হাত ধরে। এসব নায়করা কখনও সমাজ সংস্কারের ভূমিকায় মানবতার দূত হিসেবে, আবার কখনও রাজনৈতিক নেতার রূপ ধরে অবতীর্ণ হয়েছেন, হয়তবা সে সংস্কার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অথবা মানবিক। কিন্তু বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে।

দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন মুসলিমলীগের   রাজনীতির ছেদ ঘটিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী-এঁর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিমলীগ নামে নতুন রাজনৈতিক ধারায় জনতার স্বার্থে ও জনগণের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৎকালীন বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ববাংলার রাজনীতি ছিল প্রধানত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে কেন্দ্র করে। যার চূড়ান্ত  প্রকাশ ঘটে ছিল ছয় দফা দাবির মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবের নেতৃত্তে আন্দোলন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বদ্ধ করার বলিষ্ট নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি হলেন জাতিরজনক  শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসন ও শোষণ রাজনীতির বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে পূর্ববাংলার মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন জেল হাজতে।

পাকিস্তানের ২৩ বছরের প্রায় চৌদ্দ বছরেই জেলে থাকতে হয়েছে। বাংলা ও বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের দাবিকে সামনে রেখে শেখ মুজিবকে সারা বাংলায় আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে গিয়ে দেশের আনাচে কানাচে উল্কার মতো ছুটে বেরিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে ও জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের প্রতি জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে যেতে হয়েছে। অনেক কষ্ট ধৈর্য ও দিনের পর দিন আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বেগবান করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে সংগঠন ও জনমত সৃষ্টির কাজে তিনি বহুবার নেত্রকোণায় এসেছেন। তাই- ‘নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধু’ এ ধরণের একটি লিখার তাগিদ আমি বেশ কিছুদিন ধরেই অনুভব করছিলাম।

আমার কিশোর ও যুবক বয়সে নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধুকে বহুবার দেখেছি এবং তার সভায় গিয়ে বক্তৃতাও শুনেছি। যা এখনও আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। ১৯৫৭ সনের প্রথম দিকে তৎকালীন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী  হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে নেত্রকোণায় এসেছিলেন। নেত্রকোণার দক্ষিণ গুদারাঘাট (বর্তমান মোক্তারপাড়া ব্রীজ) এসে পৌঁছান। নৌকায় যখন নেতৃবৃন্দ পার হচ্ছিলেন তখন হাজার হাজার অভিনন্দনরত জনতা বঙ্গবন্ধু ও সোহরাওয়ার্দীসহ নেতৃবৃন্দকে স্বাগত জানিয়েছিল। নৌকায় থাকা অবস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ারর্দী তার মুভি ক্যামেরা দিয়ে নেত্রকোণায় অভিনন্দনরত জনতার ছবি তুলছিলেন।

এর আগে বেশ কয়েকদিন ধরেই শহরে টিনের তৈরী  চোঙা হর্ণদিয়ে নেত্রকোণা মোক্তার পড়ার জনসভায় জনগণকে উপস্থিত থাকার জন্য আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা আহবান জানান। তাই জনসভা শোনার জন্য দুপুর থেকেই মানুষ এসে মোক্তারপাড়া মাঠের দক্ষিণ কোণে  শিমুল গাছের তলে জমায়েত হতে লাগলো। বিকাল চারটার সময় নেতৃবৃন্দ এসে মঞ্চে আরোহণ করলেন। মঞ্চে তখন স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ভাষণ কিংবা স্লোগান  দিতে ছিলেন। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে তখনকার সময়ের স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা মজির উদ্দিন মোক্তার (আ: মজিদ তারা মিয়ার বাবা) জনসভার সভাপতিত্ব করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুসাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারর্দী, ময়মনসিংহের মনোরঞ্জন ধরকে নিয়ে মঞ্চে আরোহণ করেন এবং যথারীতি সভার কাজ শুরু হয়।

সেদিনের সেই আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন আ: রহিম উকিল, আ: সামাদ উকিল, ফুলে হোসেন, শামছুল হক তালুকদার, আব্দুল খালেক, ফজলুর রহমান খান, সত্যকিরণ আদিত্য, ওয়াজেদ আলীসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে সর্বজনাব ফুলে হোসেন,আব্দুল খালেক, ফজলুর রহমান খান প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা ও আওয়ামীলীগের কর্মী হিসেবে সভার যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আমি আমার কিশোর বয়সে ৪র্থশ্রেণির ছাত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি এবং তার ভাষণও  শুনেছি। বঙ্গবন্ধু খুবই সহজ সরল ভাষায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ইতিহাস তুলে ধরেন এবং বাঙালি জনগণকে পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী নেতাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহবান জানান।

এর আগে বঙ্গবন্ধু নেত্রকোণায় এসেছিলেন ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে। প্রবীণদের মুখ থেকে শোনা- সেদিন বঙ্গবন্ধুর সভা করার কথা ছিল নেত্রকোণা শহরের মোক্তার পাড়া মাঠে। সভা শুরুর প্রাক্কালে নেত্রকোণার তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিমলীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা গুন্ডা লেলিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সভা ভন্ডুল করে দেয়। বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিব ময়মনসিংহের হাসিম উদ্দিন আহমেদসহ অনেক নেতাই সেদিন উপস্থিত ছিলেন। এক পর্যায়ে মুসলিমলীগের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা নেতৃবৃন্দের উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে। তখন চকপাড়া এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি আব্বাস আলী খান ও সেকান্দর খানের মধ্যস্থতায় সভার স্থান পরিবর্তন করে স্থানীয় গরু হাট্টায় (বারহাট্টা রোড) মতান্তরে নিউটাউন পুকুরপাড় এ হয়। নেত্রকোণা আওয়ামীলীগ সভাপতি আ: রহিম উকিল সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিব, হাসিম উদ্দিনসহ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সভা শেষে বঙ্গবন্ধুসহ আব্বাস আলী খান তাঁর বাড়িতে দাওয়াত করেছিলেন খাওয়া-দাওয়ার জন্য। সেদিন শেখ মুজিব আব্বাস খানের বাড়ির দাওয়াত শর্তসাপেক্ষে কবুল করেন। শর্তছিল- আব্বাস খানকে আওয়ামীলীগ করতে হবে।

পরে আব্বাস আলী খান, গাজী গোলাম মোস্তফাসহ বেশ কিছুনেতাকর্মী আওয়ামীলীগে যোগ দেন। ৫৪ সনের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট পূর্বপাকিস্তানের সরকার গঠন করলেও পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থবাদীদের ষড়যন্ত্রে বেশীদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি আওয়ামীলীগ। পাকিস্তানের রাজনীতি চলে আসে সামরিক শাসকদের  হাতে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইসকান্দর মীর্জার নেতৃত্বে সারা পাকিস্তানে জারি করা হয় মার্শাল-ল’ (সামরিক পরবর্তীতে ইসকান্দর মীর্জাকে বিতাড়িত করে পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষনা দেন এবং দেশে রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ও নেতাকর্মীদের জেল হাজতে প্রেরণ করা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবও এসময় দীর্ঘদিন রাজবন্দী হিসেবে জেলহাজতে ছিলেন।

জেল থেকে বেড়িয়ে আলফা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানী লি: এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে কাজ শুরু করেন। সেই সময় তিনি গোপণে আওয়ামীলীগ নেতাদের খোঁজখবর নিতেন এবং নেতাদের সাথে গোপণে যোগাযোগ করতেন। পরবর্তীতে ৬২ সালে দেশের রাজনৈতিক বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ও মার্শাল-ল’ তুলে নেওয়ার পর আওয়ামীলীগকে পুনরুজ্জীবিত করে ও পুন:গঠণ করার কাজে হাত দেন। ৬২ সনের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টকে বাতিলের দাবিতে গড়ে উঠা পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যে বঙ্গবন্ধুর অবদান কোন অংশেই কম নয়। তৎকালীন হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনকে কেন্দ্র করে ছাত্র সমাজের আন্দোলনের ফলে সামরিক শাসক আইয়ুব খান রাজনীতির উপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহারসহ রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে থাকেন। পরবর্তীতে দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হলে ১৯৬৪ সনের জুলাই মাসের কোন এক সময়ে বঙ্গবন্ধু নেত্রকোণায় আসেন ।ইতোমধ্যেই নেত্রকোণাতেও রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু নেত্রকোণা আসার আগেই নেত্রকোণায় তৎকালীন  আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের এক সভা মোক্তারপাড়াস্থ আওয়ামীলীগ নেতা এন আই খান সাহেবের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। এসময় নেত্রকোণা মহকুমা আওয়ামীলীগ পুনর্গঠণসহ এন আই খান সাহেবকে আহবায়ক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহবায়ক কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ ছিলেন সর্বজনাব  কে.এম ফজলুল কাদের, আব্দুল খালেক, ফজলুর রহমান খান, আব্বাস আলী খান, আব্দুল মজিদ তারা মিয়া, শামসুল হক খালেকদাদ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান খান, গাজী গোলাম মোস্তফাসহ বেশ কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা আহবায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এই কমিটি গঠনের এক মাস পরেই ১৯ জুলাই মাসের কোন এক সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মওলানা আব্দুর রসিদ তর্কবাগীস সহ ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিক উদ্দিন ভূইয়া, হাতেম আলী এবং অনেক আওয়ামীলীগ নেতাই সেদিন নেত্রকোণায় এসেছিলেন।

ইতোমধ্যেই ১৯৬২ সালে নেত্রকোণার কিংবদন্তী ছাত্রনেতা জনাব  মেহের আলীকে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মো: শামসুজ্জোহাকে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক করে নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্রলীগ গঠন করা হয়ে গেছে ।ঐ কমিটির অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্যবৃন্দ যারা ছিলেন তারা হলেনঃসর্বজনাব জামাল উদ্দিন আহম্মেদ , বিপ্লব চক্রবর্তী, মতিয়র রহমান খান, শহিদ উদ্দিন আহমেদ,আব্দুল ওয়াহেদ, আ: মান্নান, আব্দুর রহমান, আলাউদ্দিন খান, আশরাফ আলী খান খসরু, হায়দার জাহান চৌধুরী (লেখক), ধীমান রঞ্জন বিশ্বাস (ভারত প্রবাসী)।

নেত্রকোণা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীসহ আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ কোর্টস্টেশন থেকে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে মিছিল সহকারে মোক্তারপাড়া এন আই খান সাহেবের বাসভবনে নিয়ে যান। দুপুরে খাওয়ার  পর মোক্তারপাড়ার মাঠে জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মওলানা আব্দুর রসিদ তর্কবাগীস সহ ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিক উদ্দিন ভূইয়া, হাতেম আলী মঞ্চে আরোহণ করেন। এন আই খান সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায়  জাতীয় ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহের আলী বক্তব্য প্রদান করেন। উক্ত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে ‘দুই ভাইয়ের একটি দুধালো গাভীর ও দুই ভাইয়ের একটি তালগাছ নিয়ে পূর্ব ও পাকিস্তানের বৈষম্যের যে উদাহরণের কিচ্ছা সেদিন জনসভায় বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল।’ ঐদিনের জনসভার ব্যবস্থাপনায় ছিল নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা।

সভা শেষে রাত ৮ টার ট্রেনে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতৃবৃন্দকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বিদায় জানানো হয়। ১৯৬৪ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ববাংলার চলমান স্বায়ত্ত্ব শাসনের দাবিকে সামনে রেখে আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক তৎপরতাসহ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মির নিয়ে ১৭ দিনের যুদ্ধে পূর্ববাংলার অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে এবং যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে পাকিস্তানের বাঙালি অধ্যুসিত পূর্ববাংলার মানুষের জন্য দাবি সম্বলিত ‘ছয়দফা দাবি’ পাকিস্তান সরকারের নিকট পেশ করেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খান ছয়দফার বিরোধীতা করে অস্ত্রের ভাষায় প্রতিরোধের হুমকি দেন। ছয়দফা পূর্ব পকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠির কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। পূর্ববাংলার মানুষের মুক্তির সনদ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার দাবিগুলোকে মানুষ বাঁচার দাবি হিসেবে গ্রহণ করে। ছয়দফা দাবি পেশ করার পর বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগের উপর নেমে আসে  পাকিস্তান সরকারের অত্যাচারের স্ট্রিরম  রোলার। অত্যাচারের মাত্রা যতই বৃদ্ধি পাচ্ছিল ততই বাড়ছিল ছয় দফা ও বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা।

পাকিস্তান সরকার কোন কিছুর বিনিময়ে যখন শেখ মুজিব ও ছয়দফার আন্দোলন দমাতে না পেরে আগড়তলা ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফাসিতে ঝুলানোর অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র-জনতার তুমুল গণআন্দোলনের মুখে আয়ুব খান এর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য করা হয় – পাকিস্তান সরকারকে। কারাগার থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। আয়ুব খানের পতনের পর পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। সেইসাথে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য করে।

এতে গণআন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হলেও ছাত্র আন্দোলন চলতে থাকে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু আবারো নেত্রকোণা আসেন ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন এক তারিখে। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর নেত্রকোণা আসার তারিখ নির্ধারণ হওয়ার পর নেত্রকোণা আওয়ামীলীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। নেত্রকোণা মহকুমাসহ থানা সদর পর্যায়ে আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীগণ মাইকযোগে প্রচারাভিযান শুরু করে দেয়।  মোক্তারপাড়ার মাঠ সেদিন নির্ধারিত সময়ের অনেক পূর্বেই  লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। নেত্রকোণায় এই বৃহত্তম জনসভায় আসার পূর্বে নেত্রকোণা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এক বিরাট ট্রাক ও মটর সাইকেল মিছিলসহ বঙ্গবন্ধুকে শ্যামগঞ্জ থেকে নেত্রকোণা নিয়ে আসা হয়। দুপুর একটায় আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের বিরাট মিছিল নিয়ে মোক্তারপাড়া মাঠে বিশাল মঞ্চে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সফরসঙ্গী যথাক্রমে সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, আঃমান্নান, মোল্লা জালাল উদ্দিন, রফিক উদ্দিন ভূইয়া সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করানো হয়।

তৎকালীন মহকুমা আওয়ামীলীগের সভাপতি এডভোকেট আব্দুল মমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু আসন্ন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনকে সামনে রেখে নেত্রকোণার মানুষের প্রতি নৌকায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার আহবান জানান। সভার উপস্থিত লক্ষ জনতাকে নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য দু’হাত তুলে বঙ্গবন্ধু জনতার সমর্থন আদায় করেন। লক্ষ লোকের করতালির মধ্য দিয়ে নেত্রকোণার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে ! সভা চলাকালীন আটপাড়ার আওয়ামীলীগ নেতা সেকান্দর নূরীর নেতৃত্বে এক বিরাট মিছিল আট মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগদান করেন। জনসভা শেষে ঐদিন বঙ্গবন্ধু নেত্রকোণার ডাকবাংলোতে রাতে অবস্থান করেন।

রাতে নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্রলীগ কর্তৃক স্থানীয় পাবলিক হলে এক বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি মো: শামসুজ্জোহার সভাপতিত্বে, সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী খান খসরুর সঞ্চালনায় ও সাংগঠনিক সম্পাদক হায়দার জাহান চৌধুরীর (লেখক) মাল্যদান ও ছাত্রলীগ নেতা গোলাম এরশাদুর রহমান, গুলজার হোসেন সহ,  স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সর্বজনাব  কে.এম ফজলুল কাদের, আব্দুল খালেক, ফজলুর রহমান খান, আব্বাস আলী খান, আব্দুল মজিদ তারা মিয়া,জেলা শ্রমিকলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জেলা আওয়ামীলীগের শ্রম ও কৃষিবিষয়ক সম্পাদক জনাব মেহের আলীসহ অন্যান্যরা বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধুর প্রাণোচ্ছ্বল বক্তব্যের মাধ্যমে  সাফল্য মন্ডিত সভাটি ছাত্রলীগের উপর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেন এবং জনগণের পাশে থেকে লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়ে সভার পরিসমাপ্তি ঘটে। অনুষ্ঠানে স্থানীয় আওয়ামীলীগ-ছাত্রলীগ সহ অঙ্গ সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীগণ উপস্থিত ছিলেন।

রাতে যখন বঙ্গবন্ধু ডাকবাংলোতে বিশ্রামরত ছিলেন তখন আমরা কতিপয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুর কাছে মহান একুশের সংকলণের  বাণী আনার জন্য গিয়েছিলাম। আমরা যখন কাছে গেলাম তখন বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘কি চাস্ তরা’। আমরা বিনয়ের সাথে বললাম, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ‘কিংশুক’নামে একটি একুশের সংকলন এর জন্য আপনার একটি বাণী চাই। তখন তিনি শুভেচ্ছা বাণী দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে কাগজ-কলম চাইলেন। আমরা একটি খাতা এগিয়ে দিলাম। ভুলবশত: আমাদের খাতা ছিল না। তা দেখে বঙ্গবন্ধুহাসি-ঠাট্টার ছলে বললেন, ‘এই তোরা কি আমার বাড়িঘর নিয়ে যেতে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিতে চাস ?’ আমরা তখন সবাই লজ্জা পেয়ে গেলাম। এসময় উপস্থিত মওলানা  ফজলুর রহমান খান এসে আমাদেরকে শুভেচ্ছা বাণীটি লিখে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তা পড়ে স্বাক্ষর দিয়ে আমাদের হাতে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর মিশ্রিত বক্তব্যটি সেদিন আমাদেরকে প্রচুর আনন্দ দিয়েছিল; যা আজও স্মৃতি পটে ভাস্বর হয়ে আছে।

১৯৬৬ সালে ছয়দফা দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৬৯’র সর্বদলীয় ছাত্র সমাজের ১১ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্ট গণ-আন্দোলনে পাকিস্তানের একনায়ক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের পতন ঘটে। প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন এবং  ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। জেনারেল এহিয়া খানের ‘আইনগত কাঠামো আদেশ (Legal Frame Work Order) অনুসারে ডিসেম্বরের ৭ তারিখে জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ তারিখে  প্রাদেশিক পরিষদের ভোট গ্রহণের তারিখ ধার্য হয়। কিন্তু ১২ নভেম্বর উপকূলে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলোতে ১৯৭১ সালের ১৭ জানু করা হয়। এতে পাকিস্তানের সবকটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের সর্বাত্বক প্রস্ততি নিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ দেশব্যাপী ব্যাপক নির্বাচনী-প্রচার শুরু করেন। ৭০’র নির্বাচনকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু  দেশব্যাপী তাঁর প্রচারের অংশ হিসেবে ১০ অক্টোবর আবারো নেত্রকোণায় এসেছিলেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সিলেট, সুনামগঞ্জের ভাটি এ নির্বাচনী সফর শেষে ধর্মপাশা ও মোহনগঞ্জে সভা করে ট্রেনযোগে ঢাকা যাওয়ার পথে নেত্রকোণা বড় রেল স্টেশনে এক বিরাট জনসভায় বক্তব্য প্রদান করেন। এই বিশাল জনসভার দায়িত্ত্বে ছিলেন আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। ১০ অক্টোবর সকাল ৮টায় মোহনগঞ্জে আওয়ামীলীগ আয়োজিত লুহিয়ার মাঠে এক ঐতিহাসিক জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন। মোহনগঞ্জে আওয়ামীলীগ সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং মোহনগঞ্জ থানা ছাত্রলীগ নেতা গোলাম এরশাদুর রহমানের সঞ্চালনায় উক্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এতে আওয়ামীলগের জাতীয় পরিষদে মনোনয়নপ্রাপ্ত জনাব আব্দুল মোমিন এবং প্রাদেশিক পরিষদে মনোনীত প্রার্থী  ডা: জনাব আখলাকুল হোসাইন আহমেদ, আব্দুল কদ্দুছ আজাদ, আমির উদ্দিন ও মীর্জা উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। সভা শেষে ট্রেন যোগে মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে বারহাট্টা, ঠাকুরাকোণা এবং নেত্রকোণায় প্রতিটি স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে বঙ্গবন্ধু উৎসুখি জনতার উদ্দেশ্যে নৌকায় ভোট দেয়ার আহবান জানিয়ে তাঁর সম্মোহনী বক্তব্য প্রদান করেন। নেত্রকোণা কোর্টস্টেশনে ট্রেন থামিয়ে বিপুল জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর অপূর্বভাষার যাদুতে আবারো উদ্বুদ্ধকরণ মূলক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। এ সময় চকপাড়ার বিখ্যাত খান পরিবারের কৃতি সন্তান, প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী জনাব আব্বাস আলী খান বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সফরসঙ্গীদের সকালের খাবার জন্য অনুরোধ জানান। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুর আগমনের সংবাদ পেয়ে তিনি পূর্বেই ঘটা করেই রান্নাবান্নার আয়োজন নিজ বাড়িতে করিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই চলতি ট্রেনেই ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা যাবেন বিধায় তিনি বললেন, খাবারের আয়োজন এই ট্রেনেই নিয়ে আসো। অত:পর ছাত্রলীগ নেতা হায়দার জাহান চৌধুরী, আলাউদ্দিন খান, আব্দুর রহিম এবং আব্বাস আলী খানের ছেলে বাবুল-নজরুলসহ খাবারের আয়োজন নিয়ে এসে ডেকছি-পাতিল, প্লেট-গ্লাস ও পানি সহ বঙ্গবন্ধুর পাশের একটি কামরায় উঠে পড়েন।

বঙ্গবন্ধু কোর্টস্টেশনে বক্তব্য প্রদান শেষে নেত্রকোণা বড় স্টেশনে পৌঁছান। সেখানে পূর্ব থেকেই বিশাল  মঞ্চের সামনে  হাজার হাজার জনতা উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ এই বিশাল জনসভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত আবেগময়ী বক্তব্য প্রদান করেন। এত উপস্থিত জনগণ ছয়দফা ভিত্তিক আমাদের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা ভিত্তিক জ্বালাময়ী বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হন এবং আবারো দু’হাত তুলে বিপুল করতালির মাধ্যমে সমর্থন জানায়। সভাশেষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীগণ হিরণপুর সভা করে শ্যামগঞ্জে পৌঁছান। শ্যামগঞ্জে অপেক্ষমান জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করে স্থানীয় ডাকবাংলোয় নেত্রকোণা থেকে নেওয়া খাবার গ্রহণ করেন।

ডাকবাংলোতে খাবার শেষে আব্বাস আলী খান নজরুল ইসলাম খান (বর্তমান মেয়র) কে সন্তান হিসেবে  বঙ্গবন্ধুর সংগে পরিচয় করিয়ে দিলে বঙ্গবন্ধু আদর করে নজরুল ইসলাম খানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। পরে বঙ্গবন্ধু সফরসঙ্গীদের নিয়ে ট্রেনে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন । উল্লেখ্য যে, ময়মনসিংহ থেকে আগত ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সফরসঙ্গীদেরকে নিরাপদে ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক অনাবিল আনন্দ ও পরবর্তী কার্যক্রমে উদ্দোগী হয়ে নেত্রকোণার ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ নেত্রকোণায় ফিরে আসেন

লাখো শহীদের আত্মত্যাগে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি। বিশ্বের মানচিত্রে স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।মাত্র নয় মাসেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধাণ প্রণীত হয়। সংবিধান অনুসারে ১৯৭৩ সালে স্বাধীন  বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়। এরই প্রেক্ষিতে দেশব্যাপী নির্বাচনী সফরে আবারো বেরিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। এ পর্যায়ে পঞ্চম বারের মত নেত্রকোণায় শুভ পদার্পণ করেন বঙ্গবন্ধু। নেত্রকোণা তখন উৎসবে মুখরিত। আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বিশাল আয়োজনে নেত্রকোণা কলেজ মাঠে জনসভার মঞ্চ তৈরী করা হয়। দিকে দিকে সাজ সাজ প্রতিটি থানা থেকে জনতার মিছিল এসে সমাবেত হয় কলেজ মাঠে।

মুখে মুখে জয় বাংলা – জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান। নেত্রকোণা সেদিন মিছিলের নগরীতে রূপান্তরিত হয়। দুপুরের মধ্যে জনতায় পরিপূর্ণ হয়ে পড়ে। অনেকেই মাঠে জায়গা না পেয়ে আশপাশের ঘরবাড়ি এবং কলেজের ছাদে উঠে অবস্থান নেয়।সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কখন আসবেন  আমাদের প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর গাড়ি বহরটি  নেত্রকোণার ডাকবাংলো থেকে ধীরগতিতে এগিয়ে চলে সভা মঞ্চের দিকে। পথের দু’ধারে জনতার সারি আর মুহুর্মুহ করতালি। বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে এগিয়ে চলেন। সাতপাই সদ্য প্রতিষ্ঠিত উচ্চ বিদ্যালয়টির উদ্বোধন করে কলেজ মাঠে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন।

সাথে আওয়ামীলীগ, অঙ্গ সংসঠন এবং জনতার বিপুল করতালির মাধ্যমে তিনি মঞ্চে আরোহণ করেন। সে অভাবনীয় দৃশ্য। নেত্রকোণা স্মুতি পটে চিরকাল জাগরূক এই সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব আব্দুল মোমিন এবং সভা সঞ্চালনা করেন বীর জনাব মো: শামছুজ্জোহা। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর সম্মোহনী বক্তব্য রাখছিলেন তখন জনতার ভীড় ও চাপে কলেজ ভবনের  ছাদের একাংশ ভেঙ্গে পড়ে। এতে অনেক লোকজন আহত হন এবং বঙ্গবন্ধু তাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে প্রশাসনকে দেখভাল করার নির্দেশ দেন।  সভাশেষে বঙ্গবন্ধু নেত্রকোনা আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে শেষে  ঢাকায় ফিরে যান।

এই লেখকের লেখা আরও পড়ুন……
শহীদ মেহের আলী একটি নাম, একটি ইতিহাস : বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী

বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী:
(নেত্রকোনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি, সাবসেক্টর কমান্ডার,মুজিব বাহিনী বা বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স সংক্ষেপে (বি এল এফ), নেত্রকোনা প্রেস ক্লাবের সহ সভাপতি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ-৭১, নেত্রকোণা জেলা-এর সহ সভাপতি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট)