নেত্রকোণার আশীর্বাদ সোমেশ্বরী : এই নদী দখল-দূষণ ও অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে করণীয়

শুধু সরকার ও প্রশাসনের একার পক্ষে কোন সমস্যাই সমাধান হয়না। প্রয়োজন সকল নাগরিকদের সমান অংশগ্রহণ।

প্রকাশিত: ২:২৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩

নদীমাতৃক বাংলাদেশর নদীগুলোর সাথে অসংখ্য খাল-বিল, হাওর-বাওর এর সংযোগ থাকায় নদীগুলো একদিকে যেমন যোগাযোগের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করতো তেমনি আমাদের মাছে-ভাতে বাঙালি প্রবাদটাও সত্যতাও বহন করতো। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিষ্ণুরীছড়া, বাপ্পাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি। অবশ্য এক সময় সমগ্র নদীটি সিমসাং নামে পরিচিত ছিল। ৬৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ অত্রাঞ্চল দখল করে নেয়ার পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নদী নামে পরিচিতি পায়।

মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার (পূর্ব নাম বঙ বাজার) হয়ে বাংলাদেশের রাণীখং পাহাড়ের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাণীখং পাহাড়ের পাশ বেয়ে দক্ষিণ দিক বরাবর শিবগঞ্জ বাজারের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী নদী বরাবর পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। সেই পথে কুমুদগঞ্জ বাজার হয়ে কোনাপাড়া গ্রামের সামনে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাকলজোড়া, সিংলি, কলমাকান্দা, মধ্যনগর হয়ে ধনু নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে সোমেশ্বরী।

সোমেশ্বরীর মূলধারা তার উৎসস্থলে প্রায় বিলুপ্ত। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য কোন মৌসুমে পানি প্রবাহ থাকে না। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড়ীয়া ঢলে সোমেশ্বরী বরাবর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে নতুন গতিপথের সৃষ্টি করেছে। যা স্থানীয় ভাবে শিবাত ঢালা নামে খ্যাত। বর্তমানে এ ধারাটি সোমেশারীর মূল স্রোতধারা। এ স্রোতধারাটি চৈতালি হাওর হয়ে জারিয়া-রাজাইল বাজারের পশ্চিমদিক দিয়ে কংশ নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

১৯৮৮ সালে পাহাড়ীয়া লে আত্রাখালি নদী নামে সোমেশ্বরী নদীর একটি শাখা নদী সৃষ্টি হয়। আরখালী নদী সুসং দুর্গাপুর বাজারের উত্তর দিক দিয়ে সোমেশ্বরী নদী থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। কিছু দূর এগিয়ে সোমেশ্বরীর মূলধারা সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আত্রাখালি নদী এখন বেশ ক্ষরস্রোতা। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর আত্রাখালি থেকে নয়া গাছ নামের আরও একটি স্রোত ধারা উত্তর দিকে সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া, ভাটিতে সোমেশ্বরীর শাখা নদীর সৃষ্টি হয়েছে শুনাই, বালিয়া ও খারপাই।

এই নদীতেই পাওয়া যেতো মহাশোল নামক এক ধরনের মাছ, যে মাছ এখন বিলুপ্ত প্রায়। অতীতে দুর্গাপুরে মহাশোল মাছ দিয়েই অতিথিদের আপ্যায়ন করার রীতি ছিলো। তাই সোনালী রঙের দেখতে এই মাছ এখন আর পাওয়া যায় না। নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র্য এ নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে, এর অবস্থান পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ায় নদীটি নয়নাভিরাম। দুর্গাপুরের বিজয়পুর সাদামাটির পাহাড় আর পাশেই এই নদীটির অবস্থান থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন পর্যটকরা আসেন এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। ফলে এই নদী আর সাদামাটিকে ঘিরে অর্থনৈতিক পরিবেশগত ও প্রতিবেশগত দিক থেকে সোমেশ্বরী নদীটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে।

বর্তমানে সোমেশ্বরী নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার ব্যবহার করে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল বালু উত্তোলন করে আসছে, ফলে নদীটির দুপাশে ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। ব্লেজারের বিকট শব্দে এলাকাবাসীর প্রায় লোকই কানে কম শুনছে, তাদের শ্রবণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। বালু উত্তোলন করে বহন করার জন্য প্রতিদিন দূর্গাপুর ময়মনসিংহ সড়কে প্রায় ২০০০ ট্রাক চলাচল করে। ধুলা-বালুতে মারাত্মক ভাবে দুষিত হচ্ছে বায়ু। অপরিকল্পিত ভাবে বালি, পাথর উত্তোলনে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ ক নদীর মাঝখান থেকে ড্রেজার দিয়ে উত্তোলন করায় এবং পৌর শহরের ভিতর দিয়ে বালি সরবরাহ করার জনদুর্ভোগএখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এমনকি নবনির্মিত ৩১৬ কোটি টাকার রাস্তার ধ্বংসের পথে। সাধারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি না হলেও অবৈধ বালু উত্তোলনকারী মহলের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। অননুমোদিতভাবে ও নির্বিচারে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর নাব্যতা ও গতিপথ হারানোসহ এর জীববৈচিত্র, মৎস্য সম্পদ বিলুপ্তি ও নদী নির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা নানাবিধ হুমকির মুখে পড়েছে। উল্লেখ্য যে, নদী তীরবর্তী জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করায় নদী সংলগ্ন ডাকুমারা ইসলামপুর গ্রামের নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সু নেত্রকোণাসহ নদীর পাশ্ববর্তী অন্যান্য অঞ্চলের পরিবেশ, প্রতিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জনজীবন ভয়ংকর পরিণতির দিকে ধানিত হচ্ছে।

সুমেশ্বরী থেকে অবৈধ বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০১৫ সালে মহামান্য হাইকোর্টে জনস্বার্থে একটি রীট মামলা নং- ৫৩০২/২০১৫) দায়ের করে। মামলার প্রাথমিক শুনানী শেষে মহামান্য আদালত গত ২৯ জুলাই, ২০১৫ তারিখে রুল জারি করেন। উক্ত রুলে বালুমহাল ইজারা প্রদান সংক্রান্ত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবেনা তা জানতে চেয়েছেন। একইসাথে সোমেশ্বরী নদীকে কেন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হবেনা তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।

রুল জারির পাশাপাশি মহামান্য আদালত ৮ থেকে ১০ নং নোটিশ গ্রহীতাকে আইন অনুযায়ী উক্ত নদীর প্রতিবেশগত অবস্থা নিরূপণ করতে, আইন ও ইজারা অনুযায়ী কঠোরভাবে নদী থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ এবং বালু পাথর ও মাটি উত্তোলনে পাম্প ও ড্রেজার মেশিন ব্যবহার প্রতিরোধ করতে নির্দেশ প্রদান করেন। আদালত ৯ থেকে ১১ নং নোটিশ গ্রহীতাকে বালু, পাথর ও মাটি উত্তোলন নিয়মিত তদারকি করতে নির্দেশ প্রদান করেনে যাতে ইজারা গ্রহীতাগণ ইজারা চুক্তির বাইরে গিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে। ৭-১২নং নোটিশ গ্রহীতাগণকে আদালতের নির্দেশ পালন সাপেক্ষে কমপ্লায়েন্স দায়ের করার নির্দেশ প্রদান করেন।

মহামান্য আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সোমেশ্বরী নদী থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ এবং বালু, পাথর ও মাটি উত্তোলনে পাম্প ও ড্রেজার মেশিন ব্যবহার কঠোরভাবে প্রতিরোধে বিবাদীগণের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও সোমেশ্বরী নদীতে ৭০০ থেকে ৮০০ নিষিদ্ধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে মর্মে দেশের জাতীয় দৈনিকে বালু উত্তোলনের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী এসব যান্ত্রিক মেশিন দ্বারা ৫০ থেকে ৮০ ফুট পভার থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে

ইতোপূর্বে আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়ে বার বার নোটিশ প্রেরণ করা হলেও সোমেশ্বরী নদী থেকে বালু উত্তোলনের বর্তমান চিত্র বিবাদীগণ কর্তৃক আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার ও আদালতের আদেশের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও উদাসিনতার পরিচায়ক।

আমাদের দাবীঃ
১। নদীটি পুর্ণঃখনন করে নদীটির নাব্যতা ফিরিয়ে আনা।
২। অপরিকল্পিতভাবে ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।
৩। আদালতের নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪। নদীর দখলদার ও দুষণকারীদের বিরুক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন;
৫। নদীর এবং সংশ্লিষ্ট পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির পরিমান নির্ধারণপূর্বক তা বালু উত্তোলনকারীদের নিকট থেকে আদায় করতে হবে।
৬। সরকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় জনগোষ্ঠি, নাগরিক সমাজ ও এনজিও সমন্বয়ে নিরেপক্ষ কমিটি গঠন করে আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়নে নিয়মিত মনিটরিং করা।

পরামর্শঃ
১। আইন সংশোধন করে নদী রক্ষা কমিশনকে শক্তিশালী করা ও নদী আদালত গঠন করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
২। জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে মৎস্য অধিদপ্তরকে
৩। আন্তর্দেশীয় নদীতে পানির প্রবাহ বাড়াতে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে।
৪। দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।
৫। দৈনিক কতটি ট্রাক যাবে তার একটা রেজিস্ট্রার মেইনটেইন করতে হবে।
৬। বালুর ট্রাক ওজন করার স্কেল স্থাপন করে অতিরিক্ত বালু পরিবহন বন্ধ করতে হবে।
৭। পরিবেশ অধিদপ্তর, ভূমি মন্ত্রণালয়, মৎস অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বিত টাস্কফোর্স গঠন করে নিয়মিত মনিটরিং, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, প্লেকার্ড, লিফলেট বিলি ইত্যাদি কাজ করা।
৮। সিএস অনুযায়ী নদীর মোট প্রস্থের উপর ধনুকের মতো ব্রীজ নির্মাণ, যাতে পানির লেয়ার বৃদ্ধি পেলে নদী পথ বন্ধ না হয়।
৯।উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বালু উত্তোলনের পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে।
১০। বালু পরিবহনের জন্য বিকল্প রাস্তা নির্মাণ করে দেওয়া ইত্যাদি।

পরিশেষে একটা কথাই বলতে পারি, শুধু সরকার ও প্রশাসনের একার পক্ষে কোন সমস্যাই সমাধান হয়না। প্রয়োজন সকল নাগরিকদের সমান অংশগ্রহণ। তবে আমরা ফিরে পেতে পারি আমাদের আশীর্বাদ, আমাদের সোমেশ্বরী, আমাদের মহাশোল। আমাদের জীববৈচিত্র, আমাদের পরিবেশ, আমাদের প্রতিবেশ।

লেখকঃ
মুহা. জহিরুল ইসলাম অসীম
সাংবাদিক, পরিবেশবাদী উন্নয়ন কর্মী
md.ziosim2016@gmail.com