নেত্রকোনার শহীদ বুদ্ধিজীবিবৃন্দ : ইন্জীনিয়ার জামান
নেত্রকোনায় যারা ১৯৭১ সালে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন সে সকল বুদ্ধিজীবিদের তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলো
নেজা ডেস্ক :
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষের দিকে দেশের শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিকসহ নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পেশাজীবীদের টার্গেট করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় মিত্ররা। স্বাধীনতার পর থেকে তাঁদের স্মরণে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা অনুযায়ী যেসব সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক-সংগীত ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং ১৯৭১ সালে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁরা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন । নেত্রকোনায় যারা ১৯৭১ সালে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন সে সকল বুদ্ধিজীবিদের তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলো।
শহীদ ড. ফজলুর রহমান : শহীদ ড. ফজলুর রহমান ফজলুর রহমান খান একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ।তিনি শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযরে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকার সংগঠন আল বদর ও আল শামসের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিনি একজন। ফজলুর রহমান খান জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (বর্তমান বাংলাদেশের) নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার কজিযাটি গ্রামে। তার পিতার নাম আব্দুল হাকিম খান, এবং মাতার নাম ফিরোজা খাতুন। তিনি মোহনগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক) পরীক্ষায উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ভর্তি হন মযমনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে, এবং সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে আই.এসসি. (উচ্চমাধ্যমিক) পরীক্ষায উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযরে মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বি.এসসি. (স্নাতক) ও ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে পরের বছরই মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে পিএইচডি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলে, তিনি জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
জানা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ মেহের আলী সরাসরি তার ছাত্র ছিলেন। একই এলাকায় বাড়ী হওয়ায় তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। মেহের আলীর সাথে তিনি প্রথমে গোপনে ও পরে প্রকাশ্যে স্বাধীকার আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোর রাতে পাকিস্তানি সেনারা তাকে তার তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান জহুরুল হক হল) আবাসিক শিক্ষকদের বসবাসের ভবনের নিজ শযন কক্ষে গুলি করে হত্যা করে। প্রায দেড দিন সেখানে পডে থাকার পর ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে তার পরিবারের সদস্যগণ তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাধিস্থ করেন।১৯৭৫ সাল মোহনগঞ্জ পৌরসভা ড, ফজলুর রহমানের নামে মোহনগঞ্জ পৌরসভার প্রধান রাস্তাটির নামকরণ করে। ডাক বিভাগ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর ছবি দিয়ে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করে। ড. ফজলুর রহমান এর ছবি দিয়ে একটি স্মারক খাম একই সালে প্রকাশ হয়েছিল । মুক্তিযু্দ্ধে জীবন বিসর্জনের জন্য “বিজয় একাত্তর সম্মানা-২০২২” প্রদান করা হয়।
শহীদ মেহের আলী : শহীদ মেহের আলী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রীধারী তথা মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ( মো: মেহের আলী পেশাগতভাবে মৃত্তিকা বিজ্ঞাণী হলেও রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে তিনি ঐ পেশায় কাজ করতে পারেননি । তিনি ব্যবসায় মনোযোগী হন। শহীদ মেহের আলী ছিলেন নেত্রকোণার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে একমাত্র শহীদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অন্যতম (সরকার নির্ধারিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা অনুযায়ী) যিনি বীর মুক্তিমুযোদ্ধা হিসেবে ১৯৭১ সালের ১৭ই মে মহেষখলা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন কালে আততায়ীর গুলিতে শহীদ হন ।
শহীদ মেহের আলী সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. ফজলুর রহমানের ছাত্র ছিলেন।একই এলাকায় বাড়ী হওয়ায় তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। মেহের আলীর সাথে তিনি প্রথমে গোপনে ও পরে প্রকাশ্যে স্বাধীকার আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষার দাবীতে আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন শহীদ মেহের আলী দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ও ২৩ শে ফেব্রুয়ারী নেত্রকোণায় দত্ত উচচ বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মিছিলে অংশ গ্রহণ করেন।
“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই “ শ্লোগানে রাজপথ কাপিয়েছেন। মেহের আলী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে প্রথম শহীদ, নেত্রকোনা মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য,মহেষখলা ইয়ুৎ ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য(ছাত্র ও যুবনেতাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত),ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রনেতা,১৯৬০ সালে মার্শাল’‘ল’ বিরোধী আন্দোলনের সময় কিংবদন্তী ছাত্রনেতা জনাব মেহের আলী ছাত্র সংস্থা নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন,(যখন দেশে সামরিক আইনের কারনে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল তখন এই গোপন সংগঠনটি গড়ে তোলা হয় যার মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হতো),নেত্রকোনা মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি(জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন),জেলা শ্রমিকলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি,নেত্রকোনা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম স্থপতি,মধুমাছি কচিকাঁচার মেলার প্রধান উদ্যেক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক,যুবজাগরণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি(মালনী রোড-বর্তমানে সমিতি ঘরটিকে মসজিদে রুপান্তরিত করা হয়েছে) এবং জেলা আওয়ামীলীগের শ্রম ও কৃষিবিষয়ক সম্পাদক’৭১পর্যন্ত।(ষাটের দশকে ছাত্রদের পর শ্রমিক ও কৃষক গোষ্ঠী সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। এই দুটি গোষ্ঠী নেত্রকোনায় স্বাধীকার আন্দোলন,সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।)মেহের আলী ১৯৪১ সালে নেত্রকোণা মিউনিসিপ্যালিটির ইসলামপুরে জন্ম গ্রহন করেন । মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে তিনি অন্যতম যিনি প্রথম ১৯৭১ সালের ১৭ই মে মহেষখলায় শহীদ হন।
ষাটের দশকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান ও মুক্তিযু্দ্ধে জীবন বিসর্জনের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমতিক্রমে নেত্রকোণা পৌরসভায় ১৯৯৮ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামে অজহর রোডের মোড় থেকে পূর্বদিকে ইসলামপুর পর্যন্ত এই রাস্তাটির নামকরণ করেছে – মুক্তিযোদ্ধা মেহের আলী সড়ক। মুক্তিযু্দ্ধে জীবন বিসর্জনের জন্য “বিজয় একাত্তর সম্মাননা-২০২২” এবং ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন কলেজ ও লোকসাহিত্য গবেষণা একাডেমি সম্মাননা স্মারক ২০২২ প্রদান করা হয়। মাননীয় সংসদ সদস্য হাবিবা রহমান(শেফালী) ২০১৫ সালে নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ উচচ বিদ্যালয়ের স্কুলের একটি গেইটের নামকরন করেন “বীর মুক্তিযোদ্ধা মেহের আলী গেইট”, শহীদ মেহের আলী স্মৃতি পরিষদ ও শহীদ মেহের আলী স্মৃতি যুব জাগরণ সমিতি, মালনী রোড(বর্তমানে সমিতি ঘরটিকে মসজিদে রুপান্তরিত করা হয়েছে)। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে শহীদ মেহের আলীর পরিবারের জন্য এক হাজার টাকা সম্মানী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল।
শহীদ প্রভাষক আরজ আলী : দুর্গাপুরের গুজিরকোণার কুখ্যাত দালাল কিতাব আলীর কু-পরামর্শে একাত্তরের ১৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা নেত্রকোণা কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক আরজ আলী সাহেবকে কলেজের শিক্ষক হোস্টেল থেকে তাঁকে আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেনারা ১৬ আগস্ট তাঁকে হত্যা করে। এর আগে তাঁকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় অমানুষিক অত্যাচার করা হয়।মো. আরজ আলীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানিরা অভিযোগ এনেছিল যে তাঁর গ্রামের বাড়িতে মুক্তিবাহিনী লুকিয়ে ছিল। ১৬ আগস্ট বেলা ১০টায় দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর তীরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে এ ব্যাপারে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি জি সি দেবের ছাত্র। মিথ্যা বলতে শিখিনি।’ তার পরেই পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়।
এ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর বোন আরশেদা বেগমের রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘ভয়াবহ একাত্তরের ১৩ আগস্ট। সন্ধ্যাবেলা। আরজ ভাইকে প্রফেসর হোস্টেল থেকে ধরে মিলিটারি ক্যাম্পে নেওয়া হয়। আমার এক মামা, নাম ময়না। তিনি মিলিটারি ক্যাম্পের পাশে প্রাইমারি টিচার্স টেনিং কলেজের হোস্টেলে থাকতেন। তাঁর ঘর থেকে হায়েনাদের তাণ্ডব দেখা ও কথা শোনা যেত। মামা আমাকে বলেন, “নিস্তব্ধ রাত। আকাশে বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কী এক বীভৎস মর্মান্তিক দৃশ্য। আরজের পা দুটো বেঁধে ওপরে ছাদের রিংয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে।
পরনে আন্ডারওয়ার ভিন্ন আর কিছুই নেই। হানাদার বাহিনীর এক জল্লাদ আরজের গায়ে বেতের আঘাত করছে আর বলছে, শালা বল, মুক্তিদের কেন জায়গা দিয়েছিস, কেন ওদের খাবার দিয়েছিস, শুয়োরকা বাচ্চা।বেতের আঘাতে শরীর থেকে দরদর রক্ত ঝরছে। আর জল্লাদরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। আরজ ভাই বলেছে, সত্যি বলছি আমি কিছুই জানি না। আরজের কথায় হায়নার দল কর্ণপাত করছে না। ক্রমাগত অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে আরজের আর্তচিৎকার শুনতে না পেয়ে তাকিয়ে দেখি ওর অবশ দেহটা স্থির হয়ে ঝুলে আছে। একপর্যায়ে আরজ ভাই সংজ্ঞা ফিরে পেল। আবার বুটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল তাঁর সারা শরীর।”ডাক বিভাগ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এ দু’জন বুদ্ধিজীবীর ছবি দিয়ে পৃথক স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধে জীবন বিসর্জনের জন্য “বিজয় একাত্তর সম্মানা-২০২২” প্রদান করা হয়।
শহীদ ডা. মিহির সেন: ডা. মিহির সেন ছিলেন বর্তমান সদর উপজেলার ঠাকুড়াকোনা হাসপাতালের সরকারী চিকিৎসক। ২৫ এপ্রিল’৭১। বর্বর পাকিস্তানী আর্মি নেত্রকোণা শহরে প্রবেশ করে। নেত্রকোণার দালাল-রাজাকারদের সহায়তায় শুরু করে ধর-পাকড় ও হত্যাকান্ড। পুরাতন আদালত ভবনের (বর্তমান সাব-রেজিস্ট্রি অফিস) সামনে থেকে ধরে নিয়ে যায় অতপর তাঁদেরকে নেত্রকোণা-পূর্বধলা সড়কের ত্রিমোহণী ব্রীজের উপর নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।
শহীদ সিদ্ধার্থ সেন : শহীদ সিদ্ধার্থ সেন ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিথযশা শিল্পী। ৭১-এর ২৫ এপ্রিল নেত্রকোনা শহরে প্রথম পাকবাহিনী আসে। ওই দিনই ডা. মিহির ও সিদ্ধার্থ সেন বাসার খোঁজখবর নিতে গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে আসেন। হাঁটতে হাঁটতে পুরাতন জজকোর্টের সামনে এসে পাকবাহিনীর গাড়ির সামনে পড়েন তারা। গাড়িটি পাকিস্তানী আর্মি ক্যাপ্টেনের। তার নির্দেশে পাক সেনারা দু’জনকেই গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। এরপর রাতেই পূর্বধলা-নেত্রকোনা সড়কের ত্রিমোহনী সেতুর ওপর নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
শহীদ ফয়জুর রহমান : শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ ১৯২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলার কেন্দুয়া থানায় জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম আজিমুদ্দিন আহমেদ, মাতার নাম ফাতেমা বেগম। ৫ ভাই ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পিতা-মাতার জৈষ্ঠ সন্তান। তিনি ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ সালে আয়শা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরে জন্ম নেয় ০৩ ছেলে ও ০৩ মেয়ে সন্তান। সন্তানদের মধ্যে সাহিত্যিক ড.হুমায়ুন আহমেদ, লেখক ও শিক্ষাবিদ ড.মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব খ্যাতিমান।১৯৩৯ সালে কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৪১ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি ১৯৪৩ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৪৬ সালে এসআই পদে বেঙ্গল পুলিশে যোগদান করে সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষন শেষে সিলেট জেলায় নিযুক্ত হন। চাকরি জীবনে তিনি পঞ্চগড়, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও কুমিল্লায় দায়িত্ব পালন করেন।কর্মজীবনের একটি বড় অংশ ডিএসবি-তে অতিবাহিত করেন তিনি । ১৯৭১ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পিরোজপুর মহকুমার সাব ডিভিশনল পুলিশ অফিসার (এসডিপিও)হিসেবে কর্মরত ছিলেন।শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলা-বারুদ দিয়ে সহায়তা করেন। ৫ মে পিরোজপুরে পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হন। একই দিনে পাকবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আতিক ও ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বাধীন হানাদার বাহিনী ধলেশ্বরী নদীর তীরে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করেন। তার মৃতদেহ নদীতে নিক্ষেপ করেন। কয়েকদিন পর গ্রামবাসি কর্তৃক নদীর তীরে তাকে দাফন করা হয়।স্বাধীনতার পর তার মৃতদেহ কবর থেকে তুলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক জানাযা পরাসহ পূর্ণ মর্যাদায় পিরোজপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শহিদ ফয়জুর রহমান আহমেদকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে স্বধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর)প্রদান করেন।
শহীদ বদিউজ্জামান মুক্তা : নেত্রকোণা সদরে লক্ষীপুর ইউনয়িনের বিরামপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক জনাব বদিউজ্জামান মুক্তাকে আলবদর-রাজাকারেরা ধরে এনে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মম নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের মুখেও এই মহান শিক্ষক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকেন। বর্বর পাক আর্মিরা এই স্লোগান বন্ধ করার জন্য নানা অপকৌশল চালায়। কিন্তু জনাব বদিউজ্জামান মুক্তা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েই হায়নাদের গুলিতে প্রিয় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
দবির উদ্দিন : শহরের কুখ্যাত বিহারী সর্দার শেখ মদিনার অভিযানে ধরে নিয়ে আসা হয় নেত্রকোণার প্রখ্যাত ক্রিড়াবিদ বিএলএফ সদস্য জনাব দবির উদ্দিনকে জেলা পরিষদ ডাক বাংলোতে, সপ্তাহ খানেক বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। ১৯৮৬ সালে মোহননগঞ্জ পৌর শহরে রাস্তার নামকরণ করা হয।
শহীদ কামিনী চক্রবর্তী : শহীদ কামিনী কুমার চক্রবর্তী ছিলেন নির্লোভ, সদালাপী এক সহজ মানুষ। নেত্রকোনা শহরের চন্দ্রনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরেজি ও গণিত পড়াতেন। শিক্ষার্থীদের নিয়ে লেখাপড়ায় মেতে থাকাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। ছাত্রদের কাছে খুব প্রিয় ছিলেন এই ‘কামিনী স্যার’। পড়ানোর ফাঁকে নিজে লেখালেখির চর্চা করতেন, অংশ নিতেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে। স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। কামিনী চক্রবর্তীর বাড়ি নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার পাহাড়পুর এলাকায়। জন্ম ১৯০৫ সালের ১ ডিসেম্বর। বাবা গৌরচন্দ্র চক্রবর্তী। কামিনী ১৯২২ সালে নেত্রকোনা দত্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। কলকাতা রিপন কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি, ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৩৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি নেন। কিন্তু আইন পেশায় বা সরকারি চাকরিতে না গিয়ে তিনি গ্রামে ফিরে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন। গ্রামের মানুষদের শিক্ষার আওতায় আনা আপন কর্তব্য মনে করতেন তিনি। পাকিস্তানি হানাদাররা কামিনী চক্রবর্তীকে অমানুষিক নির্যাতন করেছিল। একাত্তরের ২৭ আগস্ট রাতে তাঁকেসহ আরও ২৫ জনকে পূর্বধলার ত্রিমোহনী সেতুতে নিয়ে যায় ঘাতকেরা। সেখানে হাত-পা, চোখ বেঁধে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে জখম করে। তারপর গুলি করে হত্যা করে মগড়া নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। কামিনী চক্রবর্তীর পরিবার তখন প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের শরণার্থীশিবিরে। স্থানীয় স্বজনেরা তাঁর মরদেহ খুঁজে পাননি। “বিজয় একাত্তর সম্মানা-২০২২”
শহীদ সুধীর দত্ত মজুমদার : একাত্তরের ২৭ মে। নেত্রকোনার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুধীর চন্দ্র মজুমদার গ্রামের বাড়ি ঠাকুরাকোনায় দুপুরের খাবার শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় স্থানীয় চৌকিদারকে নিয়ে পাকিস্তানপন্থী কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা ঘরে ঢোকে। অস্ত্রের মুখে তারা সুধীর চন্দ্রকে বাড়ি থেকে তুলে আনে হানাদার সেনা ক্যাম্পে। হায়েনার দল টানা তিন মাস তাঁকে নির্যাতন করে ১ সেপ্টেম্বর গুলি করে হত্যা করে। লাশ ভাসিয়ে দেয় মগড়া নদীতে। স্বজনেরা আর লাশের সন্ধান পাননি।সুধীর চন্দ্র মজুমদারের জন্ম ১৯০১ সালে নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা গ্রামে। উপেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ও অনঙ্গ সুন্দরীর একমাত্র সন্তান তিনি। নেত্রকোনা দত্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতায় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেন। সেখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কংগ্রেসে যোগদানের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। স্বদেশি আন্দোলনের কারণে ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালায়। তাঁকে বন্দী করে রাখা হয় দিল্লির কারাগারে। সেখানে ইংরেজ জেলারের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ালে সাজা হিসেবে তাঁকে আন্দামানে পাঠানো হয়। টানা ১১ বছর আন্দামানে কারাবন্দী থাকার পর ১৯৪৫ সালে তিনি মুক্তি পান।
শহীদ ধীরেন্দ্র দত্ত মজুমদার : ধীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার ছিলেন নেত্রকোনার খ্যাতিমান আইনজীবী। আইন পেশার পাশাপাশি লেখালেখিসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজ ও স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তিনি। একাত্তরের ২৭ মে পাকিস্তানপন্থী চিহ্নিত কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা অস্ত্রের মুখে তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তুলে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। হানাদার সেনারা ক্যাম্পে নিয়ে টানা তিন মাস দুর্বিষহ নির্যাতন চালিয়ে ১ সেপ্টেম্বর তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। লাশটি ভাসিয়ে দেয় মগড়া নদীতে। স্বজনেরা তাঁর লাশের সন্ধান পাননি। শহীদ ধীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদারের জন্ম ১৯০৫ সালে নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা গ্রামে। তাঁর বাবা কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদার ছিলেন জোতদার, মা সরলা বালা মজুমদার গৃহিণী। তাঁরা তিন ভাই ও এক বোন। কেউ বেঁচে নেই। ধীরেন্দ্র মজুমদার ১৯২৪ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা থেকে মোক্তারি সনদ নিয়ে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তাঁর স্ত্রীর নাম মুকুল রানী মজুমদার। তাঁদের একমাত্র ছেলে সুব্রত মজুমদার ২০১৯ সালে মারা যান। বড় মেয়ে শীলা রায় মজুমদার সুনামগঞ্জে এবং ছোট মেয়ে ইলা মজুমদার কলকাতায় বসবাস করছেন।
শহীদ ডা. খগেন্দ্রনাথ বিশ্বাস : জানা যায়, ১৯৭১ সনে ভাদ্র মাসে সাজিউড়া গ্রাম থেকে স্থানীয় আলবদর, রাজাকারদের সহায়তায় পাকহানাদার বাহিনী পিঠমুড়া দিয়ে বেধে ডা. খগেন্দ্রনাথ বিশ্বাস আরো ৪ জনকে ধরে এনে ধোপাগাতি গ্রামের পাশে কেন্দুয়া জয়হরি স্প্রাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান ভূঞার বাড়ির সামনে একটি ডুবায় দাড় করিয়ে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই ৪ জন শহিদ হলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হরিপদ সরকার দুঃখু। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তাদের স্মরণে নেত্রকোণা জেলা প্রশাসনের পরিকল্পনায় কেন্দুয়া উপজেলা প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় ওই স্থানে নির্মিত স্মৃতি ফলক চিরঞ্জীব উদ্বোধন করা হলো। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪ টায় চিরঞ্জীব স্মৃতি ফলকের উদ্বোধন করেন নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান।
আরও পড়ুন……
ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি ও ৭১’- র মুক্তিযুদ্ধ : বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
শহীদ মেহের আলী একটি নাম, একটি ইতিহাস : বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধু: বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
[ প্রখ্যাত সাহিত্যিক,ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযদ্ধ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক ননী গোপাল সরকারের প্রবন্ধ অগ্নিযুগের সূর্য সৈনিক : বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মেহের আলী, বিখ্যাত গ্রন্থ স্মরণে বঙ্গবন্ধু, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট সাবসেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিমুযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরীর প্রবন্ধ শহীদ মেহের আলী একটি নাম, একটি ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা,ভাষা সংগ্রামের জন্যে রাষ্ট্রিকিট হওয়া একমাত্র বাংগালী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দীন আহমেদ সাহেবের প্রবন্ধ “,অসমাপ্ত গল্প”, প্রখ্যাত সাংবাদিক কুন্তল বিশ্বাসের প্রবন্ধ “ নেত্রকোনায় ভাষা আন্দোলন”-ভাষা সংগ্রামে নেত্রকোনা ২০০৮ স্মারকগ্রন্থ, ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দীন আহমেদ সাহেবের প্রবন্ধ “একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলো”-আমাদের ময়মনসিংহ জনুয়ারী ২০১৬, মধ্যনগর থানা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জনাব মোঃ আকিকুর রেজা ভূইয়ার বই “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কথা”, বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা,টিভি সংবাদ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও,অডিও ও মেহের আলীর ডায়েরী অবলম্বনে লেখা হয়েছে।]