পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর আলোকে صَلٰوةَ বা নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত

‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ পড়বে, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকবে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৫৭)

প্রকাশিত: ২:২৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২৩

ইসলামিক জার্নাল ডেস্ক :
নামাজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয। প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজেরই আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কিছু ফজিলত দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ফজরের সালাত।

নামাজ কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং কায়েম করো ফজরের নামাজ। নিশ্চয়ই ফজরের নামাজ উপস্থিতির সময়। (সূরা: বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৭৮ (দ্বিতীয় পর্ব)।

নামাজের মধ্যে যেমন ফজরের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব, তেমনি সময়ের মধ্যে ফজরের সময়ের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। পবিত্র কোরআনে ‘ফজর’ নামে একটি সূরাও রয়েছে। ওই সূরার শুরুতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘শপথ ফজরের। ’ (সূরা: ফজর, আয়াত : ১)

হাদিসে ফজরের নামাজের বিশেষ তাগিদ রয়েছে। জুনদুব ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ পড়বে, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকবে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৫৭)

একমাত্র মুমিনই আল্লাহর কাছে মর্যাদাশীল। আর কুরআনে বহু জায়গায় মুমিনদের একটি গুণ এই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা নামায কায়েম করে। এর মধ্য দিয়ে আল্লাহ বস্তুত নামাযের উপর গুরুত্বারোপ করছেন যে, যদি মুমিন হও তাহলে নামায কায়েম কর।

যেমন আল্লাহ ইরশাদ করেন-
اِنَّمَا وَلِیُّكُمُ اللهُ وَرَسُوْلُهٗ وَالَّذِیْنَ اٰمَنُوا الَّذِیْنَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَیُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَهُمْ رٰكِعُوْنَ.

তোমাদের বন্ধু তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং তারা বিনয়ী।-সূরা মায়েদা (৫) : ৫৫

এখানে মুমিনদের বন্ধু কারা এ প্রসঙ্গে কেবল তিন শ্রেণির কথা উল্লেখ করা হয়েছে : ক. আল্লাহ। খ. রাসূল। গ. মুমিনগণ। তারপর এই মুমিনদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বলা হয়েছে তারা নামায কায়েম করে।

আল্লাহ আরো বলেন-
طٰسٓ تِلْكَ اٰیٰتُ الْقُرْاٰنِ وَكِتَابٍ مُّبِیْنٍ هُدًی وَّبُشْرٰی لِلْمُؤْمِنِیْنَ الَّذِیْنَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَیُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَهُمْ بِالْاٰخِرَةِ هُمْ یُوْقِنُوْنَ .

ত্ব-সীন। এ কুরআন ও সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত; মুমিনদের জন্য হেদায়েত ও সুসংবাদ- যারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং তারা আখেরাতে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।-সূরা নামল (২৭) : ১-৩

এ আয়াতেও মুমিনদের পরিচয় দিতে গিয়ে প্রথমে নামাযের কথা বলা হয়েছে।

আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন-
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِیْنَ اِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَاِذَا تُلِیَتْ عَلَیْهِمْ اٰیٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِیْمَانًا وَّعَلٰی رَبِّهِمْ یَتَوَكَّلُوْنَ الَّذِیْنَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجٰتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَّرِزْقٌ كَرِیْمٌ.

মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয় এবং যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দেয় এবং তারা তাদের রবেরই উপর ভরসা করে। যারা নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। তারাই সত্যিকার মুমিন। তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বহু মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক।-সূরা আনফাল (৮) : ২-৪

এখানে সত্যিকার মুমিনদের গুণাবলি কী তা আলোচনা করা হয়েছে। তাদের একটি গুণ হল তারা নামায কায়েম করে। এ থেকে বোঝা গেল সত্যিকার মুমিন হতে হলে নামায আদায় করতে হবে। নামায ছাড়া সত্যিকার মুমিন হওয়া যাবে না।

আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন-
قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ وَالَّذِیْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ وَالَّذِیْنَ هُمْ لِلزَّكٰوةِ فٰعِلُوْنَ وَالَّذِیْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حٰفِظُوْنَ اِلَّا عَلٰۤی اَزْوَاجِهِمْ اَوْ مَا مَلَكَتْ اَیْمَانُهُمْ فَاِنَّهُمْ غَیْرُ مَلُوْمِیْنَ فَمَنِ ابْتَغٰی وَرَآءَ ذٰلِكَ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْعٰدُوْنَ وَالَّذِیْنَ هُمْ لِاَمٰنٰتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رٰعُوْنَ وَالَّذِیْنَ هُمْ عَلٰی صَلَوٰتِهِمْ یُحَافِظُوْنَ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْوٰرِثُوْنَ الَّذِیْنَ یَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ.

নিশ্চয় সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ- যারা তাদের নামাযে বিনীত, যারা অহেতুক বিষয় থেকে বিরত থাকে, যারা যাকাত আদায়কারী, যারা নিজ লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, তবে নিজেদের স্ত্রী বা মালিকানাধীন দাসীদের থেকে নয়, কেননা (এতে) তারা নিন্দনীয় হবে না। আর যারা এ ছাড়া (অন্য পথ) অন্বেষণ করে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী এবং যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং যারা নিজেদের নামাযসমূহের প্রতি যত্নবান থাকে। তারাই উত্তরাধিকার লাভকারী, যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা তাতে সর্বদা থাকবে।-সূরা মুমিনুন (২৩) : ১-১১

এ আয়াতে সফল মুমিনদের গুণাবলি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। তাদের একটি গুণ হল তারা তাদের নামাযে বিনীত (خٰشِعُوْنَ)।

এ শব্দটি خُشُوْع থেকে নির্গত। خُشُوْع শব্দের অর্থ হচ্ছে বিনয়। কখনো ভয়, প্রশান্তি ও স্থিরতার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আসলে এ বিষয়গুলো কাছাকাছি।

বিনয় মানে কী আমরা সবাই জানি- নিজেকে ছোট মনে করা। তো বিনয়ের সঙ্গে নামায পড়ার অর্থ হল নিজেকে ছোট, দুর্বল, অসহায় ও মুখাপেক্ষী মনে করে আর আল্লাহকে সবচেয়ে বড় মনে করে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসার সঙ্গে তাঁর সম্মুখে নিজের বন্দেগী নিবেদন করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর জন্য দেহমনের উপস্থিতির বিকল্প নেই।

এই খুশূ-ই হচ্ছে নামাযের রূহ। আসলে খুশূ মুমিনের সবসময়কার অবস্থা। এখানে বিশেষভাবে নামাযের কথা বলা হয়েছে এজন্য যে, নামায হচ্ছে খুশূর প্রকাশের সর্বোত্তম জায়গা।

সফল মুমিনদের দ্বিতীয় গুণ হল তারা তাদের নামাযমূহের প্রতি যত্নবান থাকে। এই যত্নের মধ্যে সময়মত নামায পড়া, নিয়মিত নামায পড়া এবং নিয়মনীতি, হক ও আদবসমূহ লক্ষ করে নামায পড়া সবই শামিল।

নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে অবহেলা করলে, আখিরাতে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। হজরত নাওফেল ইবনে মুয়াবিয়া রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসূল সা: এরশাদ করেছেন, ‘যার এক ওয়াক্ত নামাজ ছুটে গেল তার যেন ঘরবাড়ি, পরিবার-পরিজন ও ধন-দৌলত সবকিছু ছিনিয়ে নেয়া হলো।’ (ইবনে হিব্বান-৪:৩৩০ পৃ.)। নামাজের গুরুত্ব এতটাই যে, মুসলমান ও অন্য ধর্মের লোকদের মধ্যে পার্থক্যই হলো নামাজ। হজরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসূল সা: এরশাদ করেছেন, ‘মানুষের শিরক এবং কুফরের মধ্যে পার্থক্য নামাজ ছেড়ে দেয়া।’ (মুসলিম:২৪৭)। হজরত হানজালা উসাঈদী রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসূল সা: এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাযথ পাবন্দীর সাথে আদায় করে, উত্তমরূপে অজু করে, সময়ের প্রতি খেয়াল রাখে, রুকু-সিজদা ঠিকমতো আদায় করে এবং এভাবে নামাজ আদায়কে নিজের ওপর আল্লাহ তায়ালার হক মনে করে, তবে জাহান্নামের আগুন তার জন্য হারাম করে দেয়া হবে। (মুসনাদে আহমাদ-৪: ২৬৭পৃ.)।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করার জন্য আল্লাহ সবাইকে তৌফিক দান করুন।