পূর্ববঙ্গ মৈমনসিংহ-গীতিকার একটি পালা ‘কমলা রাণী’

গভীর ভালবাসা আর মিলের মধ্যে কাটছিল রাজা জানকীনাথ ও তার অপরূপা- সুন্দরী স্ত্রী কমলা রাণীর দিনগুলি। -একদিন রাণী রাজাকে বললেন, “রাজা, তুমি যে আমাকে এত ভালবাস, আমি মরে গেলে এর কি কোন চিহ্ন থাকবে?”

প্রকাশিত: ৮:৪০ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২২, ২০২৩
[পূর্ববঙ্গ মৈমনসিংহ-গীতিকার একটি পালা]

পালা: কমলা রাণী

পালাকার- অধরচাঁদ
পালা সংগ্রাহক- চন্দ্রকুমার দে
সম্পাদনা- শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন
কাহিনী সংক্ষেপ- এমদাদ খান

প্রসঙ্গ কথা :
কমলা রাণী গানটি এক সময় ময়মনসিংহ অঞ্চলে খুব সমাদৃত ছিল। পালাগানটির রচয়িতার নাম অধরচাঁদ। রচনা কাল সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। পালাগানটি রচনা করা হয় একটি বাস্তব ঘটনার সাথে কল্পনা মিশিয়ে। পালায় বর্ণিত সুসং দুর্গাপুরের জমিদার জানকীনাথ মল্লিক, তার পত্নী কমলা রাণী, পুত্র রগুনাথ সিং ঐতিহাসিক ব্যাক্তি।

কমলা রাণীর দিঘিটিও বাস্তব এই নামে একটি দিঘির অস্তিত্ব এখনো আছে। দিঘিটি সোমেশ্বরী নদীতে মিশে গেলেও একটা পাড় এখনো অবশিষ্ট আছে। বিশাল এই দিঘিটি আমিও দেখেছি। দিঘিটি সত্যি দেখার মতো।
কমলা দেবী সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক। তার পুত্র রগুনাথ সিং সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিকট থেকে রাজা উপাধি লাভ করেছিলেন।

কমলা দেবীর স্বামী জানকীনাথ স্ত্রীর আবদার রক্ষার্থে এক বিশাল দিঘি খনন করে, এর নামকরণ করেন কমলা রাণীর দিঘি। স্বামীর স্বপ্নের মর্যদা দিতে গিয়ে খননকৃত দিঘিকে জল পূর্ণ করার জন্য দিঘিতে নেমে কমলা আত্মাহুতি দেন। কমলারাণীর আত্মাহুতি এই প্রবাদটি দেশজুড়ে বহুকাল ধরে প্রচলিত। সত্য আর কল্পনা মিলিয়েই এর কাহিণী।

রাজা তার পত্নীর নাম অক্ষয় করে রাখার জন্য পত্নীর ইচ্ছার মূল্যায়ন করতে গিয়ে এক বিশাল দিঘি খনন করেন। অপরদিকে রাণী দিঘিতে জল না উঠায়, স্বামীর চৌদ্দ পুরুষকে নরক থেকে রক্ষার জন্য দিঘিতে আত্মহুতিদেন। স্বামী স্ত্রীকে উপহার দিলেন দিঘি, স্ত্রী উপহার দিলেন তার অমূল্য জীবন। প্রাচীন ও মধ্যযুগ ছিল কুসংস্কারে আচ্ছন্ন । স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে তা বাস্তবায়ন বা পূরণ করা ছিল সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে সমাজে কত যে অঘটন ঘটেছে, কত যে অনাকাঙ্কিত ঘটনা ঘটছে, কত যে মূল্যবান জীবন ঝরে গেছে এর হিসেব নেই। কমলারাণীর পালাটিও এর ব্যতিক্রম নয়।

কাহিনী সংক্ষেপ :
গভীর ভালবাসা আর মিলের মধ্যে কাটছিল রাজা জানকীনাথ ও তার অপরূপা- সুন্দরী স্ত্রী কমলা রাণীর দিনগুলি।
-একদিন রাণী রাজাকে বললেন, “রাজা, তুমি যে আমাকে এত ভালবাস, আমি মরে গেলে এর কি কোন চিহ্ন থাকবে?”
-রাজা বললেন, “তোমার স্মৃতি চিহ্ন রক্ষার জন্য তুমি যা চাইবে আমি তাই করব”।
-রাণী বললেন “আমি চাই প্রজাদের জলের চাহিদা মিটাবার জন্য বিশাল এক দিঘি খনন করে তুমি আমার নামে নাম রাখবা।”

রাজা বিশাল এক দিঘি খনন করে এর নাম রাখলেন কমলা দিঘি। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় বিশাল গহীন দিঘির তলদেশ থেকে এক ফুটা পানিও উঠলোনা। রাজা পরলেন মহা দুশ্চিন্তায়। দিঘি থেকে পানি না উঠলে যে রাজার চৌদ্দ পুরুষ নরকে যাবে। একরাতে স্বপ্ন দেখলেন রাণী যদি ভরা কলসী নিয়ে দিঘির তলদেশে নামেন তাহলে দিঘিতে জল উঠবে। তিনি রাণীকে তার স্বপ্নের কথা বললেন –
“তুমি যদি নামগো রাণী পুষ্কন্নীর তলে,
ভরিয়া উঠীবে তালাব পাতালের জলে।”

-তিনি রাণীকে আরো বললেন,“ আমি আরো স্বপ্নে দেখলাম কলসী কাকে নিয়ে তুমি ধীরে ধীরে দিঘিতে নেমে গেছ। সাথে সাথে দিঘি ভরে গেছে জলে, আর তুমি ডুবে গেছ দিঘির অথৈ জলে। এই দুস্বপ্ন দেখে আমার বুক তরতর করে কাঁপছে। তোমাকে ছাড়া আমি বাচঁব কেমনে।
“রাজ্য না চাই রাণী, ধন নাই যে চাই
কী অইব রাজ্য ধনে যদি তোমারে না পাই।”

-রাজার কথা শুনে রাণী বললেন “আমি পুকুরে নামলে যদি প্রজাদের কল্যাণ হয়, তোমার চৌদ্দ পুরুষ যদি নরক থেকে রক্ষা পায়, আত্মাহুতিতেও আমার কোন আপত্তি নেই। এই কথা বলে রাণী দাসীদের নিয়ে সোমেশ্বরী নদীর ঘাটেতে গেলেন। নদীতে শ্নান শেষে নদীর কূলে মন্দিরে বসে দেবতার উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে পূজো দিলেন।
“ফুল বিল্লা দিলা রাণী দেবের চরনে
বর মাগে কমলা রাণী প্রভুর কারণে।”

বাড়িতে ফিরে রাণী তার দুগ্ধপোষ্য শিশু পুত্রকে বুকে নিয়ে কান্নাকাটি করলেন। তাকে বুকে ধরে আদর করে বললেন,
“শোন শোন পুত্র আরে অঙ্গের যে লরি
আজি হয়তে তোমায় ধনে যাইবাম ছাড়ি।”

অতঃপর রাণী তার স্বামী, দাসদাসী সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোনার কলসী কাঙ্কে নিয়ে দিঘির পাড়ে গেলেন পিছে পিছে গেলেন তার স্বামী। গেলো দাসদাসী, আরো কত শত প্রজা।
“কমলা রাণী কোন কাম করিল
ভরা সোনার কলসী কাঙ্কে তুইল্যা নিল”

ভরা কলসী নিয়ে রাণী তলায় নামলেন। নামার পর দেবতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
“যদি আমি সতী হই, মনে ধরম থাকে
শুকনা পুস্কুন্নীর জল, উঠুক পাকে পাকে।
যদি আমি সতী হই, ধর্ম থাকে মনে
পাড়ে পাড়ে উঠুক পানি, দেখুক সর্বজনে।
যদি আমি সতী হই, মনে ধরম থাকে
আমারে ভাসিয়ে তবে লও পাতাল পুরে।”

অতঃপর রাণী তার কলসীর পানি দিঘিতে ঢাললেন। পানি উঠতে শুরু করল। পানিতে পানিতে দিঘি ভরে গেল। রাণী তলিয়ে গেলেন অথৈ পানির নিচে।

এ দৃশ্য দেখে রাজা বিলাপ করতে লাগলেন-
“হায় হায় করিয়া রাজা কাইন্দা ভূমিত না পরে
রাজার কান্দন দেইখা না বৃক্ষের পাতা ঝুরে
সেই নারী আরাইয়া রাজা হইল বাউল
দিবা নিশি কান্দে রাজা ঐনা নদীর কূল।
এই মতো কান্দইন যে রাজা হইয়া পাগল
অন্ননা খাইনগো রাজা, না পিয়ইন জল।”

দেখতে দেখতে চলে গেল একমাস। রাণী যে অথৈ জলে ডুবে গেলেন, আর তো এলেন না ফিরে। রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন দিঘির পানি সেচে রাণীকে দিঘি থেকে উপরে তুলে আনবেন। সাড়ে ছয় হাজার কামলা নয় দিন পর্যন্ত দিঘির পানি সিঞ্চন করল, কিন্তু দিঘির পানি চুল পরিমাণও কমল না। ব্যর্থ হয়ে কামলারা রাতের আধারে পালিয়ে গেল। রাজার মন অশান্তিতে ভরে গেল।

একরাতে রাজা আবার আশ্চর্য এক স্বপ্ন দেখলেন। রাণী তার শিয়রের পাশে বসে তাকে বলছেন, “আমি পাতাল পুরে বড় দুঃখে আছি। আমার চিত্তে নাই সুখ, চোখে নাই ঘুম। আমার কলিজার টুকরো শিশুকে ছাড়া কী করে ঘুমাই। রাজা, তুমি দিঘির পাড়ে একটা সুন্দর, পরিপাটি ঘর তৈরি করে দাও। সেই ঘরে প্রতি রাতে শুয়া দাসী আমার পুত্রকে নিয়ে আসবে। আমি প্রতি রাতে প্রিয় শিশু পুত্রকে আমার বুকের দুধ খাইয়ে যাব। সে মায়ের দুধ না পেয়ে কি যে কষ্টে আছে! এই কথা ভাবলে আমার বুক ফেটে যায়। রাজা, তুমি আর কান্নাকাটি কর না। দৈর্য্য ধরো। এক বছর পর আমাদের মিলন হবে। এপর্যন্ত যদি সন্তান দুগ্ধ পান করে সে হবে দেবতার সমান।”

রাজা তার লোক লস্কর দিয়ে দিঘির পাড়ে সুন্দর, ছিমছাম একটা ঘর তৈরি করে দিলেন। সেখানে খাট- পালং, বিছানা সহ সকল সরঞ্জামের ব্যবস্থা করলেন। শুয়া দাসী প্রতি রাতে রাজপুত্রকে নিয়ে সে ঘরে এসে ভোর পর্যন্ত অবস্থান করে। রাণী সেই ঘরে এসে তার শিশু পুত্রকে প্রতি রাতে বুকের দুধ খাইয়ে ভোর হবার আগেই চলে যান। একদিন রাজা শুয়া দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তুমি যে আমার শিশু পুত্রকে নিয়ে দিঘির পাড়ের ঘরে রাতে অবস্থান কর, সেখানে তুমি কী দেখতে পাও? -শুয়া দাসী বলল, “রাণী প্রতি রাতে এসে তার পুত্রকে দুধ খাইয়ে, তাকে বুকে নিয়ে আদর করেন, ঘুম পারান। ভোরে কখন চলে যান আমি টের পাইনা।

এই কথা শোনে রাজা রাণীকে স্বচক্ষে দেখার খুব ইচ্ছে হল। একদিন ভোর রাতে সেই ঘরে দরজার সামনে গিয়ে রাজা দাঁড়ালেন। দাসীকে ডেকে বললেন,“দাসী দরজা খোল, আমি রাণী কে দেখব”।
“দোয়ার খোল শুয়া দাসী, বাচাও আমারে
রজনী হইল ভোর , দেখাও রাণীরে।”

রাজার উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাবার জন্য রাণী ঘরের দরজা খোললেন। খুলেই দেখতে পেলেন রাজা সামনে দাড়িয়ে আছেন। রাণীকে দেখেই রাজা আর স্থির থাকতে পারলেন না। রাণীকে তিনি ঝাপটে ধরলেন।
-রাণী চিৎকার করে বললেন-
“ছাইরা দাও প্রাণের পথিগো, ছাইরা দাও আমারে
শাপত হইলো মোচন যাইবাম দেবপুরে”

এই কথা বলে রাণী শূণ্যে উড়া দিলেন। রাণীর শাড়ির একটা অংশ ছিড়ে রাজার হাতে রয়ে গেল। রাজা নিজের দোষে সব হারালেন। আর একটা দিন অতিবাহিত হলে রাজার সাথে রাণীর হত মিলন। আর পুত্রও হতো দেবতার সমান।
“অধর চাঁদ কাইন্দা কয়, রাজা করিলে কি কাম
তা না অইলে অইত পুত্র ইন্দ্রের সমান।”