প্রাকৃতজনের গবেষক: অধ্যাপক যতীন সরকার

যতীন সরকার সেই বিরলপ্রজ লেখক, যার তৃতীয় নয়ন আছে এবং ওই তৃতীয় নয়নের আলো ফেলে তিনি সর্বসাধারণের বোধাতীত জগৎকে স্পষ্ট করে দেখতে পান কিংবা সর্বসাধারণের চোখে যা ‘পরিত্যাজ্য’, তিনি এর মধ্যেও দেখতে পান অপার সম্ভাবনা।

প্রকাশিত: ২:৩৮ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০২৩

বাংলা কবিতাকে সর্বত্রগামী ও সর্বজনপ্রিয় করে তোলার অসাধারণ কৃতিত্বের দাবিদার কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যদিকে কম পঠিত প্রবন্ধ-সাহিত্যকে ‘সর্বজনপ্রিয়’ করে তোলার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন সুলেখক অধ্যাপক যতীন সরকার।

এ পথের পথিকৃৎ হিসেবে অবশ্যই আগে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথাও আসবে। ১৮ আগস্ট, ২০২৩ বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তক অধ্যাপক যতীন সরকারের ৮৮তম জন্মদিন। তাঁকে জন্মদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা।

যতীন সরকার প্রান্তিক জীবন-অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ, গণমানস-সচেতন লেখক। জীবনযাপন ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কল্যাণে কৃষক-শ্রমিকের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে নিবিড় অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। ওই অভিজ্ঞতার সঙ্গে ‘পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান’-এর তাত্ত্বিক পাঠ তাঁর ভাবনাকে বিশেষ দ্যুতি দান করেছে। তাঁর নিজের কথা, মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ‘ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’ এবং জোসেফ স্তালিনের ‘দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ পড়ে ‘যখন ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের মোটামুটি মর্ম গ্রহণে সক্ষম হলাম, তখন যথার্থই একটা অনির্বচনীয় তৃপ্তিতে সমস্ত মনপ্রাণ ভরে গেল। বলতে গেলে, একটা নতুন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম আমি।’

যতীন সরকার সেই বিরলপ্রজ লেখক, যার তৃতীয় নয়ন আছে এবং ওই তৃতীয় নয়নের আলো ফেলে তিনি সর্বসাধারণের বোধাতীত জগৎকে স্পষ্ট করে দেখতে পান কিংবা সর্বসাধারণের চোখে যা ‘পরিত্যাজ্য’, তিনি এর মধ্যেও দেখতে পান অপার সম্ভাবনা।

যতীন সরকার প্রায়ই বলে থাকেন, তাঁর কোনো প্রতিভা নেই; অনেক শ্রম-ঘাম ঢেলে, অনেক কষ্ট করে সাহিত্য রচনা করেন। তাই তাঁর অভিমত, তিনি ‘কষ্টলেখক’। আমরা তাঁর এ বক্তব্যকে সমর্থন করি, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিন্দু থেকে। যিনি তাঁর সাহিত্যে শ্রেণিসংগ্রাম, নিয়তিবাদ, বস্তুবাদের পাশাপাশি বিস্মৃতপ্রায় কবিগান ও লৌকিক ঐতিহ্য, মার্কস-লেনিনের রাজনৈতিক অভিমতের পাশাপাশি বাউল কবি দ্বিজ দাস, উকিল মুন্সী বা জালাল খাঁর সংগীততত্ত্ব, পাভলভীয় মনস্তত্ত্বের পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্র সফলভাবে উপস্থাপন করতে পারেন; যিনি তাঁরই সতীর্থদের দ্বারা ‘খারিজকৃত’ রবীন্দ্র রচনায় ‘মার্কসীয় মৌলসূত্র’-এর বিরল উপাদান খুঁজে পান এবং নবলব্ধ তত্ত্বকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার মতো বিরল প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য ধারণ করেন; বস্তুত অপরিমেয় কষ্ট ও শ্রম ব্যতীত এ কর্ম সম্পাদন সম্ভব নয়। তিনি অপরিসীম কষ্ট সয়ে তথ্যের সঙ্গে তত্ত্বের, বিদ্যার সঙ্গে মননের, নাগরিক বোধের সঙ্গে ব্রাত্যবোধের ঐক্যসূত্র আবিষ্কার করেন– এই অর্থে তিনি কষ্টলেখকই বটে। তাঁর লেখক প্রতিভা এবং লেখার স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা– এ দুয়ের গ্রহণযোগ্য সাক্ষী তাঁর বিপুল রচনাসম্ভার।

যতীন সরকারের লেখা প্রথম বই ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে। ওই প্রথম বইয়ের মধ্য দিয়েই তাঁর এবং পাঠকের মধ্যে যে ‘আশা-প্রত্যাশা’র নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে ওই সম্পর্কের বাঁধন দিনে দিনে আরও শক্ত ও গাঢ় হয়েছে। বেদ-পুরাণ-গীতার মহিমান্বিত সুর, ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের যুক্তি ও দীপ্তি, রবীন্দ্র-নজরুলের মানবতাবাদ এবং মার্কসবাদের সঙ্গে আমাদের লৌকিক জীবন-সংস্কৃতিকে মেলাতে পেরেছেন তিনি।

যতীন সরকারের রচনার একদিকে আছে সমাজ, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি-অর্থনীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ; অন্যদিকে আমাদের লৌকিক জীবনের মর্মান্বেষণ এবং বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যকে নতুন করে উপস্থাপনের সফল প্রচেষ্টা। আমরা মনে করি, প্রথম অংশ অপেক্ষা দ্বিতীয় অংশেই তিনি বেশি সফলতা পেয়েছেন।

আমাদের দেশে ‘লোকসাহিত্যের গবেষক’ যারা, তাদের কেউ কেউ এ সাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। কেউ কেউ এর বিশেষ কোনো দিক সম্পর্কে অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন। কেউবা লোকসাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাসকে ভাষারূপ দিয়েছেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আলোকে ‘লোকসাহিত্যের মনস্তত্ত্ব এবং এর শিল্পরূপ বিচার’– এ ক্ষেত্রে দুই বাংলার মধ্যে যতীন সরকারই প্রথম ও প্রধান গবেষক। তাঁর আত্মকথনমূলক গ্রন্থ ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ (২০০৫) এবং ‘পাকিস্তানের ভূত দর্শন’ (২০১৩) গ্রন্থ দুটোর নাম এবং প্রকাশকাল আলাদা হলেও বর্ণিত ঘটনাক্রমের নিবিড় ঐক্য ও ধারাবাহিকতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, এগুলো ‘এক’ই গ্রন্থের আলাদা খণ্ড মাত্র।

লেখক ও পাঠকের মধ্যে ‘সাঁকো’ তৈরি করার ক্ষেত্রে লেখকের ভূমিকাই প্রধান। লেখক তাঁর শব্দসম্ভার এবং বর্ণনাভঙ্গির মধ্যে ভাবের এমনই সম্মোহন জাল ছড়িয়ে দেন; পাঠক নাওয়া-খাওয়া ভুলে, ভাবের প্রবল আবেগে ওই জালের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে থাকেন।

এ সত্য কেবল গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতার ক্ষেত্রেই নয়; প্রবন্ধের বেলাতেও সমানভাবে প্রযোজ্য– এই বিরল দৃষ্টান্তের পথিকৃৎ লেখক অধ্যাপক যতীন সরকার। তাঁর প্রবন্ধ-সাহিত্যের বিশিষ্টতা সম্পর্কে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক ডক্টর রফিকউল্লাহ খানের অভিমত, ‘যতীন সরকার কেবল প্রান্তিক মানুষ নন, প্রান্তিক জীবনের বুদ্ধিজীবী নন, তিনি বাঙালির মননশীলতার প্রগতিশীল ধারার অন্যতম রূপকার।

…যতীন সরকার মূলত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী এবং প্রাকৃতজনের দার্শনিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যে-কোন দর্শন বাঙালি-জীবন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র রূপ নেয়।

আমার পঠিত লেখকদের মধ্যে যতীন সরকারের মধ্যেই আমি একমাত্র সেই স্বতন্ত্র চরিত্রের প্রাকৃত জীবনের দ্বান্দ্বিকতার স্বরূপ খুঁজে পেয়েছি।’

[ভূমিকা– ‘প্রাকৃতজনের সন্ত–যতীন সরকার’, গ্রন্থ: ‘জ্যোতির্ময় যতীন সরকার’, বিধান মিত্র ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, জুন ২০২১]

বিধান মিত্র: অধ্যক্ষ, নেত্রকোনা সরকারি মহিলা কলেজ; লেখক ও গবেষক।