ফ্যাসিস্ট বা ফ্যাসিজম কী?

প্রকাশিত: ৯:৫৭ অপরাহ্ণ, মে ৭, ২০২৫

ফ্যাসিস্ট বা ফ্যাসিজম বতর্মান সময়ের রাজনীতিতে অনেক আলোচিত একটি শব্দ। এর পূর্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা স্বৈরাচার শব্দটি খুব বলতেন, এখনও বলেন, বিশেষ করে এরশাদ সরকারের আমলকেই রাজনৈতিক নেতারা স্বৈরাচারের সময় বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই নির্বাচনে রাজনৈতিক দলসহ ও জনগণের সম্পৃক্ততা কমে যায়। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নাই। যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ পর পর দুইটি নির্বাচন প্রায় একা একাই সম্পন্ন করে। অনেকে এইসব নির্বাচনকে আমি আর ডামি নির্বাচনও বলেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের এমন স্বৈরাচারী মনোভাবকে কঠিন ভাবে বুঝাতে, তাছাড়া আরও বেশ কিছু কারণে রাজনৈতিক দলসমূহ এই সরকারকে ফ্যাসিস্ট সরকার বলতে শুরু করে।

ফ্যাসিস্ট বা ফ্যাসিজম শব্দটি কোন বাংলা শব্দ নয়। বিদেশি শব্দ হিসেবে বাংলাদেশে খুব ব্যবহৃত বা প্রচলিত কোন শব্দও না। তবে যারা রাষ্ট্র্রবিজ্ঞান বা ইতিহাস নিয়ে পড়ালেখা করেছেন কিংবা রাজনীতি চর্চা করেন তাদের কাছে এই শব্দটি পরিচিত। আমি একজন খোদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এই বিষয়টি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি মাত্র। তাছাড়া আমার অপারগতা স্বীকার করা উচিৎ যে, এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার মত বিজ্ঞজন আমি নই।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ফ্যাসিবাদ শব্দটি ইতালীয় শব্দ fascismo থেকে উদ্ভূত, যা “fascio” শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ লাঠির বান্ডিল’, যা প্রাচীন রোমান প্রতীক fasces থেকে উদ্ভূত। এই প্রতীকটি একাধিক লাঠির বান্ডিলের সাথে একটি কুড়ালকে ঘিরে রাখা হতো, যা শক্তি এবং ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ফ্যাসিবাদের মূল আদর্শ ছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যেখানে জাতীয়তাবাদ ও কর্তৃত্ববাদ ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন রোমান ফ্যাসেসের মতোই এটি শক্তি ও শৃঙ্খলার উপর জোর দেয়।

তবে আকন্দ নামক ব্লগে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট শব্দটি একটি ল্যাটিন শব্দ fascio থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি কুঠারকে এক বান্ডিল রড দিয়ে বেঁধে রাখা। অর্থাৎ এক বান্ডিল রডের মাঝ খানে একটা কুঠার, আর হাতলের চারিদিকের রডের বান্ডিল। এই প্রতীকটি ঐতিহাসিকভাবে রোমান ম্যাজিস্টে্রটরা তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যবহার করত। মুসোলিনি তার নিজের আন্দোলনের প্রতীক হিসাবে ফ্যাসেস গ্রহণ করেছিলেন, সেখান থেকে “ফ্যাসিবাদী” শব্দটি রাজনীতিতে চলে এসেছে।

ইতালির বেনিটো মুসোলিনি তার আন্দোলনের প্রতীক হিসাবে “ফ্যাসিস্ট” ব্যবহার করতে শুরু করলে ১৯১৫ সালে “ফ্যাসিবাদী” শব্দটি ইতালিতে চালু হয়ে যায়। মুসোলিনির আন্দোলনটির নাম ছিল ফ্যাসিডি ‘আজিওন রিভোলুজিওনারিয়া, বাংলা করলে দাঁড়ায়, বিপ্লবী অ্যাকশনের ফ্যাসেস। এই আন্দোলনটি ১৯২১ সালে পার্টিটো নাজিওনালে ফ্যাসিস্থা বা ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত হয়।

ফ্যাসিবাদ হল একটি কট্টর ডানপন্থী, কর্তৃত্ববাদী, গোঁড়া জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং আন্দোলন। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নিহার কুমার সরকারের ব্যপক পরিচিত একটি বই ছোটদের অর্থনীতি। বইটিতে ‘ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের প্রহরী’ শিরোনামে একটি লেখা রয়েছে। তুলনামূলকভাবে এই আলোচনাটি আমার নিকট খুব সহজবোধ্য মনে হয়েছে। লেখক সেখানে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, গত মহাযুদ্ধের আগে ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল অবধি আর একটা যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধ হয়েছিল প্রধানত কলোনীওয়ালা ইংরেজ ও ফরাসির সঙ্গে কলোনীহীন জার্মানির। ইংরেজ ও ফরাসিরা জয় লাভ করবে এই ভেবে রুশদেশ ও ইতালি, কলোনীর আশায় তাদের দলে যোগ দেয় এবং তুরস্ক যোগ দেয় জার্মানির দলে। যুদ্ধের শেষের দিকে আমেরিকা এসে যোগ দিয়েছিল ইংরেজ ও ফরাসিদের দলে। যুদ্ধে জার্মানি হেরে যায়। তার সব কলোনীগুলো ইংরেজ ও ফরাসিরা ভাগ—বাটোয়ারা করেনেয়।

ইতালির ভাগে বিশেষ কিছুই দেওয়া হয় না এবং রুশ দেশে তখন বিপ্লব হয়ে ক্যাপিটালিস্টদের (পূজিবাদীদের) হাত থেকে ক্ষমতা শ্রমিকদের হাতে চলে যাওয়াতে, রুশদেরকে ‘ভদ্র’ ক্যাপিটালিস্ট সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। এইরূপে ইতালি ও জার্মানি প্রায় কলোনীহীন দেশই থেকে যায়।

কিন্তু যুদ্ধের পর থেকেই ক্যাপিটালিস্ট দেশগুলোতে ভাঙন লাগে। যুদ্ধের পরই আরম্ভ হয় ব্যবসা সংকট। হাজারে হাজারে শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। কলোনীওয়ালা ক্যাপিটালিস্ট দেশগুলো কলোনী থাকায় অবস্থা কতকটা সামলে নেয়। কিন্তু কলোনীহীন ক্যাপিটালিস্ট দেশগুলোতে দূর্দশা চরম হতে থাকে। ইতালিতে শ্রমিকরা ক্ষেপে গিয়ে কল—মালিকদের তাড়িয়ে দিয়ে কল—কারখানা অধিকার করে বসে। শ্রমিকদের এই আন্দোলন দেখে ক্যাপিটালিস্টরা ঘাবড়ে যায়। তারা তখন শ্রমিকদের জব্দ করে নিজেদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য উঠে পড়ে লাগে। এই কাজের জন্য একজন উপযুক্ত লোকের সন্ধানও তারা পায়। তার নাম মুসোলিনী। মুসোলিনী আগে শ্রমিকদেরই একজন নেতা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ আরম্ভ হলে নিজে ক্যাপিটালিস্টদের পক্ষে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয় এবং শ্রমিকদের যুদ্ধে যোগ দিতে বলে। এর ফলে শ্রমিক দল থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ থেকে এসে কি করবে সে ভাবছিল। এমন সময় শ্রমিকদের আক্রোশ থেকে ক্যাপিটালিস্টদের রক্ষার ভার তার উপর এসে পড়ে। সে তখন শ্রমিকদের জব্দ করার জন্য একটা দল তৈরী করে। এই দলের নাম হল ফ্যাসিস্ট দল। দেশের সকল ধনীরা এই দলকে সাহায্য করতে থাকে। এর ফলে কিছু দিনের ভেতরে ফ্যসিস্ট দল বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। কিন্তু শ্রমিকরা এই ফ্যাসিস্ট দলকে শায়েস্তা করবার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারল না। কারণ তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ছিল সোসালিস্ট দলের, যার নেতারা ফ্যসিস্টদের আসল চেহারা কোন দিনই বুঝতে পারেনি। যারা এটা বুঝেছিল তারা ছিল সংখ্যায় কম।

ইতালিতে মুসোলিনীর উত্থানকে ঠেকাতে পারেনি শ্রমিক সংগঠনগুলো। শ্রমিক সংগঠনগুলোকে জোর করে ভেঙ্গে দিল। শ্রমিক নেতাদের মেরে ফেলা হল। আবার কাউকে জেলে পুরে দিল। কেউবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল। এইরূপ নৃশংসতার সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনকে পরাজিত করে ফ্যাসিস্টরা ধনী শ্রেণীর আশীর্বাদ লাভ করল এবং ধনীশ্রেণীর সম্পত্তি রক্ষার পাহারাদার হিসেবে ধনীরা ফ্যাসিস্টদের হাতে দেশের গভর্নমেন্ট তুলে দিল।

মুসোলিনী ফ্যাসিস্ট দলের নেতাদের নিয়ে ‘ফ্যাসিস্টগ্রান্ড কাউন্সিল’ নামে এক কমিটি করে একচ্ছত্র শাসক হয়ে উঠেছিল। শ্রমিক আন্দোলন যাতে আবার মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে এবং কৃষকদের ভেতরেও যাতে অসন্তোষ বেড়ে না যায় তার জন্য যা যা করার তাই করে, ক্ষমতা ধরে রেখেছে এই ফ্যাসিস্ট সরকার।’ তাছাড়াও লেখক নিহার কুমার সরকার এই বইয়ে আরও বলেন ফ্যাসিবাদের চরম রূপটিই হচ্ছে নাৎসীবাদ, যে শাসন ব্যবস্থা এডলফ হিটলার জার্মানিতে প্রতিষ্ঠা করেছিল।

পরবর্তীতে ইতালীতে ফ্যাসিস্টরা সর্বগ্রাসীবাদ ধারণাটিও তৈরি করেছিল। তারা সমাজের জন্য সর্বগ্রাসীবাদের ইতিবাচক দিক সমূহকে গুরুত্ব দিয়ে তার জয়গান করার চেষ্টা করেছে সবসময়। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশ সর্বগ্রাসীবাদের ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং আজও তা অব্যাহত রেখেছে।

সর্বগ্রাসী সরকারগুলির একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল একটি স্পষ্ট বা অন্তর্নিহিত জাতীয় আদর্শের অস্তিত্ব — সমগ্র সমাজকে অর্থ এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিশ্বাসের একটি সেট।

রাশিয়ান ইতিহাস বিশেষজ্ঞ এবং লেখক রিচার্ড পাইপসের মতে, ফ্যাসিস্ট ইতালিয়ান প্রধান মন্ত্রী বেনিটো মুসোলিনির সর্বগ্রাসীবাদের ভিত্তিকে সংক্ষেপে যেভাবে বর্ণনা করেছিলেন, তাহল “রাষ্টে্রর মধ্যে সবকিছু, রাষ্টে্রর বাইরে কিছুই নয়, রাষ্টে্রর বিরুদ্ধে কিছুই নয়।”

রাষ্ট্রবিজ্ঞানির মতে, একটি সর্বগ্রাসী রাষ্টে্র যে সব বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে তার উদাহরণ হল: একজন একক স্বৈরশাসকের দ্বারা প্রবর্তিত নিয়ম
* একক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি
* সংবাদপত্রের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ
* সরকারপন্থী প্রচারণার ক্রমাগত প্রচার
* সকল নাগরিকের জন্য সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক চাকরি
* বাধ্যতামূলক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
* নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং অনুশীলনের নিষেধাজ্ঞা
* সরকারের যে কোনো ধরণের প্রকাশ্য সমালোচনা নিষিদ্ধকরণ
* গোপন পুলিশ বাহিনী বা সামরিক বাহিনী কর্তৃক প্রয়োগকৃত আইন
আবারও ফিরতে চাই লেখক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নিহার কুমার সরকারের কথায় তিনি বলেছিলেন শ্রমিক বিপ্লব থেকে ক্যাপিটালিস্টদের বা ধনীশ্রেণীদের বাঁচানো হল ফ্যাসিজমের প্রথম কাজ। পরিশেষে যে ধারণা পেলাম তা হল অন্য মতকে, অন্য চিন্তাকে. অন্যকোন রাজনৈতিক দলকে দমনপীড়নের মাধ্যমে নিজেদের অর্থাৎ পুজিঁবাদীদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখাই হল ফ্যাসিস্টদের মূল লক্ষ্য। যেখানে সাধারণ মানুষের মতামতের কোন প্রকার সুযোগ থাকে না। মেহনতী, শ্রমজীবি মানুষ থাকে পরাধীন ও শোষিত।

লেখক: শাহ কামাল, যুবনেতা, সদস্য, সিপিবি, সুনামগঞ্জ