বিধবা মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা অশেষ সওয়াবের কাজ

‘বিধবা ও মিসকিনের জন্য খাদ্য জোগাড়ে চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো অথবা রাতে সালাতে দণ্ডায়মান ও দিনে সিয়ামকারীর মতো।’

প্রকাশিত: ২:৩৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৯, ২০২৩

ইসলামিক জার্নাল ডেস্কঃ
“ইসলাম” নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেছে। সবচে’ বেশি অধিকার দিয়েছে। এটি কোন মুখরোচক স্লোগান নয়। জাজ্বল্যমান এক বাস্তব সত্য। নারী যখন ছিল কেবলি ভোগ্য পণ্য। শুধুই একজন দাসির সমতুল্য। ঠিক তখনি ইসলাম এল নারী জাতির জন্য আশির্বাদ হয়ে।

যেখানে ইহুদী খৃস্টান ধর্মের বিকৃত ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে নারীকে করেছে মিরাসি সম্পদ থেকে বঞ্চিত। করেছে নিকৃষ্ট প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। সেখানে ইসলাম নারীকে একদিকে দিয়েছে মেয়ে হিসেবে মর্যাদা ও পিতা থেকে মিরাস পাওয়ার অধিকার। দিয়েছে বোন হিসেবে মর্যাদা এবং ভাই থেকে মিরাস পাওয়ার অধিকার। দিয়েছে স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা ও স্বামী থেকে মিরাসি সম্পদ পাওয়ার অলঙ্ঘনীয় অধিকার। “মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত” বলে নারী জাতিকে যেমন দিয়েছে সম্মনের সর্বোচ্চ মাকাম তেমনি সন্তান থেকে মিরাস পাওয়ার অধিকার।

নারীর পূর্ণ জীবনের সুন্দর ব্যবস্থাপনা। শালীন ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার ইসলাম কতটা দিয়েছে তা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তাই সেদিকে যাচ্ছি না। বিধবা নারীকে ইসলাম কতটা মর্যাদা দিয়েছে, আর ইসলামের সুমহান নীতি অবলম্বন না করার কারণে বর্তমানে বিধবা নারীরা কতটা অসহায় জীবন যাপন করছেন এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য সেটিকে স্পষ্ট করে তোলা।

যে নারীর স্বামী মৃত, তাকে বিধবা বলা হয়। বৈধব্যের আরেক নাম যন্ত্রণা। এ কথা পৃথিবীর যে কোনো দেশের নারীর জন্যই প্রযোজ্য ও চিরন্তন সত্য।

ইহুদী ও খৃষ্ট ধর্মের বিকৃত ধর্মীয় গ্রন্থে বিধবাদের অধিকার চরমভাবে ক্ষুণœ করা হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ উদ্ধৃত করছি-

পুনঃ বিবাহঃ
বাইবেলে তালাক প্রাপ্তা নারীর পুনঃ বিবাহ সম্পর্কে স্ববিরোধী বক্তব্য বিরাজমান। বাইবেলে বলা হয়েছে: বিয়ে করার পরে যদি কেউ স্ত্রীর মধ্যে কোন দোষ দেখে তার উপর অসন্তুষ্ট হয় আর তালাক-নামা লিখে তার হাতে দিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বিদায় করে দেয়, আর স্ত্রীলোকটি তার বাড়ি থেকে চলে গিয়ে যদি অনন্য কাউকে বিয়ে করে এবং তার দ্বিতীয় স্বামীও যদি পরে তাকে অপছন্দ করে তার প্রতি তা-ই করে, কিংবা সেই স্বামী যদি মারা যায়, তবে তার প্রথম স্বামী যে তাকে বিদায় করে দিয়েছিল, সে তাকে আর বিয়ে করতে পারবে না, কারণ সে নাপাক হয়ে গেছে।

এই রকমের বিয়ে ইশ্বর ঘৃণা করেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪ : ১-৪)। বিপরীতে বলা হয়েছে: বিধবা কিংবা স্বামী যাকে ছেড়ে দিয়েছে কিংবা বেশ্যা হয়ে যে নিজেকে নাপাক করেছে এমন কোন স্ত্রীলোককে বিয়ে করা চলবে না। (লেবীয় ২১: ১৪)

বাইবেলে বিধবার ক্ষেত্রে একদিকে বলা হচ্ছে বিবাহ করা নিষিদ্ধ। অপরদিকে তাদের সমুদয় সম্পদ স্বামীর জন্য সাব্যস্ত করে বিধবা নারীদের করে দেয়া হচ্ছে সর্বশান্ত। বাইবেলের মতে মৃতের স্ত্রী, মাতা, বোন, বিমাতা নারীর জ্ঞাতির সম্পত্তি পাবে না। তবে শর্ত সাপেক্ষে কন্যা সম্পত্তি পাবে, যা চূড়ান্তভাবে পুরুষের হাতেই চলে যায়।

লিখা হয়েছে- ‘কেউ যদি অপুত্রক হইয়া মরে, তবে তোমরা তাহার অধিকার (সম্পত্তি) তাহার কন্যাকে দিবে।’ (গণনা পুস্তক ২৭ : ৮)।

সুতরাং কি দাঁড়াল? যদি মেয়েটির কোন ভাই থাকে, তাহলে উক্ত মেয়ের কোন অংশ পিতা থেকে পাবে না।

বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (Old Testament) অনুযায়ী মহিলাকে উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার কারণে ইহুদী সমাজে বিধবারা হয় অত্যন্ত দরিদ্র ও অসহায়। স্বামীর আত্মীয় স্বজন তার খরচাদির ব্যবস্থা করলেও তার নিজের হাতে কোন শক্তি নেই তাদেরকে খরচে বাধ্য করার। বরং তাদের অনুগ্রহের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না। (ইশাইয়াঃ ৫৪/৪)

এজন্য ইসরাঈলে বিধবাগণ সমাজে সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণীভুক্ত হয়ে থাকে। কিন্তু বিধবাদের সমস্যার এখানেই শেষ নয়; বরং বাইবেলে (জেনেসিসঃ৩৮)

সাহাবীদের সময়ে একটা সুন্দর সিস্টেম ছিল। সাহাবারা কোনো নারীকে একা ফেলে রাখতেন না। সে বিধবা হোক, তালাকপ্রাপ্তা হোক, তার আবার বিয়ে হত।

আমরা দেখি, আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুগে কোনো কোনো সাহাবিয়াতের তিন-চার-পাঁচবারও বিয়ে হয়েছে! কিন্তু আমাদের বর্তমান সময়ে একজন মেয়ের এতবার বিয়ের কথা ভাবাই যায় না। ৪/৫ বার তো দূরের কথা ২য় বার বিয়েতেই কত সমস্যা।

আবু বকর, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুম, উনাদের মত সেরা সেরা সাহাবীরাও তালাক দিয়েছেন, একাধিক বিয়ে করেছেন। তাদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীদের আবার অন্য সাহাবীরা বিয়ে করে নিয়েছেন। কেউ এমন ভাবে নি, “নিশ্চয়ই অমুক মেয়ের দোষ আছে, নইলে কি আবু বকর-উমারের মত মানুষ তাকে তালাক দেয়! এমন মেয়েকে কে বিয়ে করে!” বরং তারা মানুষকে মানুষ-ই মনে করতেন, ফিরিশতা মনে করতেন না।

মানুষের কিছু চাহিদা বাবা-মা-ভাই-বোন-সন্তান-সন্ততি দ্বারা পুরা করা যায় না। একজন সঙ্গী লাগে। যে বিধবা তারও একজন সঙ্গীর প্রয়োজন। যে তালাকপ্রাপ্ত তারও একজন সঙ্গী দরকার। সাহাবীদের আমলে কেউ কোনো নারীকে একাকী নিঃসঙ্গ পড়ে থাকত না। মায়ের বয়সী হোক, দাদীর বয়সী হোক, তার আগে বাচ্চাকাচ্চা থাকুক — সব রকম নারীকেই বিয়ে করে নেওয়া হত।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ইসলাম দান করেছেন যেন আমাদের জীবনগুলো সুন্দর হয়, শান্তির হয়। একাকী পড়ে থাকার মত অসহনীয় জীবন আর কিছু নেই। তাই আল্লাহ তায়ালা বিয়ের বিধান দিয়েছেন।

বিয়ের সময় কম-বয়সী, কুমারী নারীকে বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু সমাজের সার্বিক দিকের কথা চিন্তা করে বিধবা এবং তালাক-প্রাপ্ত, গরীব, অসহায় বোনদেরও তো কাউকে না কাউকে অন্তত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিয়ে করা উচিৎ।

স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। দুই-এক বছরের না, বেশ কয়েক বছরের বড়। এমনকি তাঁর আগে একাধিক বিয়েও হয়েছিল। অর্থাৎ তিনি কুমারী ছিলেন না। কাজেই পূর্ব বিবাহিত পাত্রীকে বিয়ের ব্যাপারে কোন ধরনের অস্বস্তিবোধের জায়গা ইসলাম দেয় না।

আমরা আসলেই গোঁড়া। একবিংশ শতাব্দিতে এসেও আমরা সাহাবীদের মত উন্নত মানসিকতা ধারণ করতে পারি না। সাহাবী-সাহাবিয়াতরা সব ক্ষেত্রেই সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত রাখতে পেরেছিলেন।

এবং তালাক প্রাপ্তাগণ তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে; এবং যদি তারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তাহলে আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন তা গোপন করা তাদের পক্ষে বৈধ হবেনা; এবং এর মধ্যে যদি তারা সন্ধি কামনা করে তাহলে তাদের স্বামীই তাদেরকে প্রতিগ্রহণ করতে সমধিক স্বত্ববান; আর নারীদের উপর তাদের স্বামীদের যেরূপ স্বত্ব আছে, স্ত্রীদেরও তাদের পুরুষদের (স্বামীর) উপর তদনুরূপ ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে; এবং তাদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে; আল্লাহ হচ্ছেন মহা পরাক্রান্ত, বিজ্ঞানময়।(সূরা বাকারা ২২৮)

স্বামীর মৃত্যু বা স্বামী তাকে তালাক দিলে সে স্বাধীন, কেউ তাকে কোন ব্যাপারে বাধ্য করতে পারে না। সেও তার নিকট আত্মীয়ের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তেমনি অংশীদার হয়, যেমন হয় পুরুষেরা। স্বামী তার নায্য অধিকার না দিলে, সে আইনের সাহায্যে তা আদায় করে নিতে পারে অথবা তার বিবাহ-বন্ধন ছিন্ন করে দিতে পারে। আবার ইসলাম নারীদেরকে বল্লাহীনভাবে ছেড়ে দেয়া এবং পুরুষের কর্তৃত্বের আওতা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করেও দেয়নি; কারণ তা নিরাপদ নয়। সন্তান-সন্ততি লালন-পালন ও ঘরের কাজ-কর্মের দায়িত্ব প্রকৃতিগতভাবেই তাদের উপর ন্যস্ত করে দেয়া হয়েছে। তারা এগুলোই বাস্তবায়নের উপযোগী। তাছাড়া স্ত্রীলোককে বৈষয়িক জীবনে পুরুষের আওতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দেয়াও নিতান্ত ভয়ের কারণ। এতে পৃথিবীতে রক্তপাত, ঝগড়া-বিবাদ এবং নানা রকমের ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি হয়।

এ জন্য কুরআনে এ কথাও ঘোষণা করা হয়েছে যে, “পুরুষের মর্যাদা স্ত্রীলোক অপেক্ষা এক স্তর উর্ধ্বে।” অন্য কথায় বলা যায় যে, পুরুষ তাদের তত্ত্বাবধায়ক ও জিম্মাদার। এ আয়াতে সামাজিক শান্তি-শৃংখলা মানব চরিত্রের স্বাভাবিক প্রবণতা, সর্বোপরি স্ত্রীলোকদের সুবিধার্থেই পুরুষকে স্ত্রীলোকদের উপর শুধু কিছুটা প্রাধান্যই দেয়া হয়নি বরং তা পালন করাও ফরয করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাই বলে সকল পুরুষই সকল স্ত্রীলোকের উপর মর্যাদার অধিকারী নয়। কেননা, আল্লাহর নিকট মর্যাদার নিরিখ হচ্ছে ঈমান ও নেক আমল। সেখানে মর্যাদার তারতম্য ঈমান ও নেক আমলের তারতম্যের উপরই হয়ে থাকে। তাই আখেরাতের ব্যাপারে দুনিয়ার মত স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করা হয় না। এ ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে যে, কোন কোন স্ত্রীলোক অনেক পুরুষের চাইতেও অধিক মর্যাদার যোগ্য। [মাআরিফুল কুরআন থেকে সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত]

স্বামীহারা ও বিধবা নারীরা শুধু পরিবারে অবহেলিত নয়; বরং অনেকে তাদের অপয়া মনে করে। তালাকপ্রাপ্ত নারীরাও বিভিন্ন অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হয়। অথচ ইসলাম স্বামীহারা, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের মানবিক সম্মান ও অধিকার দিয়েছে।

মহানবী (সা.) বিধবা নারীদের সামাজিক ও ধর্মীয় সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন তারা অপয়া ও অস্পৃশ্য নয়। চাচা আবু তালেব মহানবী (সা.) সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি শুভ্র, তার চেহারার অসিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করা হতো, তিনি এতিমদের খাবার পরিবেশনকারী আর বিধবাদের তত্ত্বাবধায়ক।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০০৮)

আত্মত্যাগী ও নিঃস্বার্থ বিধবার পুরস্কার
ইসলাম বিধবা নারীকে অবিবাহিত থাকতে নিরুৎসাহিত করে। এর পরও কোনো বিধবা নারী যদি তার সন্তানের জীবন ও ভবিষ্যতের চিন্তা করে নিজের স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দেয় এবং সন্তান প্রতিপালনে সততার সঙ্গে ধৈর্যের পরিচয় দেয়, তবে পরকালে সে পুরস্কৃত হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
আমি ও (নিজের যত্ন না নেওয়ায়) চেহারায় দাগ পড়া নারী পরকালে এভাবে থাকব অথবা শাহাদাত ও মধ্যমা আঙুলের চেয়ে বেশি দূরত্ব থাকবে আমাদের মধ্যে। সে হলো সেই নারী যার স্বামী মারা গেছে এবং তার বংশীয় মর্যাদা ও সৌন্দর্য থাকার পরও সে নিজেকে বিরত রাখে এতিম সন্তানদের জন্য—যতক্ষণ না সন্তানরা (স্বাবলম্বী হয়ে) পৃথক হয়ে যায় অথবা মারা যায়। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫২৪৯)

যে বিধবার দায়িত্ব গ্রহণ করবে ইসলাম বিধবা নারীর দায়িত্ব গ্রহণকারীর জন্য বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করেছে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘বিধবা ও মিসকিনের জন্য খাদ্য জোগাড়ে চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো অথবা রাতে সালাতে দণ্ডায়মান ও দিনে সিয়ামকারীর মতো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৫৩)। আল্লাহ আমাদের বিধবা ও অসহায় নারীদের প্রতি সদয় হওয়ার তাওফিক দিন। আমীন

সংকলন:
মাও: আবু তাহের নেত্রকোণী
প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম ক্বাওমি মাদ্রাসা।
ভূগী, পূর্বধলা, নেত্রকোণা।
নিয়মিত লেখক, ইসলামিক জার্নাল বিভাগ
নেত্রকোণা জার্নাল।