বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ যুল-বিজাদাইন (রাঃ) এর একটি চমকপ্রদ ঘটনা

হে আল্লাহ! আজ সন্ধা পর্যন্ত আমি আব্দুল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলাম, তুমিও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও।

প্রকাশিত: ৬:৩৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩

ইসলামিক জার্নাল ডেস্কঃ
সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট; এ (প্রতিদান) তার জন্য, যে তার প্রতিপালককে ভয় করে। (সূরা বাইয়্যিনাহ আয়াত ৮)। অর্থাৎ, তাদের ঈমান, আনুগত্য এবং সৎকর্মের কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হল সব থেকে বড় জিনিস। মহান আল্লাহ বলেন, (وَرِضْوَانٌ مِنَ اللهِ أَكبَر) (সূরা তাওবাহ ৭২আয়াত)

সাহাবায়ে কেরাম রা. যেমন ছিলেন সত্যের মাপকাঠি, তেমনি তারা দুনিয়া থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টির ঘোষণাপ্রাপ্ত। ইসলামের সঠিক পথ নির্ণয়ের মাপকাঠি হলো, সাহাবায়ে কেরাম রা. এর অনুসৃত পথের অনুসরণ। যুগে যুগে যারাই সাহাবায়ে কেরাম রা. এর পথ থেকে দূরে সরে গিয়েছে, তারাই গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট হয়েছে। হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী হলেন সাহাবায়ে কেরাম। যারা সাহাবায়ে কেরামকে যথাযথ সম্মান করে, তাদের অনুসৃত পথে চলে,তারাই মুলত: কুরআন ও সুন্নাহের প্রকৃত অনুসারী। সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথ ব্যতীত লক্ষ-কোটি বারও কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণের দাবী করলেও তারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট।

(شهادة ذى البجادين من غير قتال)
তাবূকে অবস্থানকালীন সময়ে তরুণ ছাহাবী আব্দুল্লাহ যুল-বিজাদায়েন(عَبْدُ اللهِ ذُو الْبِجَادَيْنِ) এর মৃত্যু হয়। এই নিঃস্ব-বিতাড়িত শাহাদাত পিয়াসী মুহাজির তরুণের জীবন কাহিনী অতীব বেদনাময়, চমকপ্রদ ও শিক্ষাপ্রদ। শিশু অবস্থায় পিতৃহারা আব্দুল ‘উযযা মক্কায় তার চাচার কাছে প্রতিপালিত হন। তরুণ বয়সে চাচার উট-বকরী চরানোই ছিল তার কাজ। ইতিমধ্যে ইসলামের বাণী তার নিকটে পৌঁছে যায় এবং তিনি তাওহীদের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু চাচার ভয়ে প্রকাশ করেননি।

হঠাৎ মক্কা বিজয় সবকিছুকে ওলট-পালট করে দিল। যুবক আব্দুল ‘উয্যার লুক্কায়িত ঈমান ফল্গুস্রোত হয়ে বেরিয়ে এলো। চাচার সামনে গিয়ে ইসলাম কবুলের অনুমতি চাইলেন। চাচা তাকে সকল মাল-সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিলেন। এমনকি তার দেহের পরিহিত বস্ত্র পর্যন্ত ছিনিয়ে নিলেন।

মায়ের কাছে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এই অবস্থা কেনো? বললেন ঈমান আনার কারণে আমার এই অবস্থা মা! মাকে বললেন, মা আমাকে এক টুকরো কাপড় দিন যা গায়ে দিয়ে রাসূলের (সা.) দরবারে হাজির হতে পারি। মা তাঁকে একটি পুরনো কম্বল দিলেন, কম্বলটি দু’টকরো করে এক টুকরো গায়ে জড়িয়ে আর এক টুকরো লজ্জাস্থান আবরণ করে মদীনার পথে চললেন।

অনেক কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময় তিনি মদীনায় পৌঁছান। তিনি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে এক কোনে বসে পড়লেন। মসজিদে রাসূল (সা.) এসে দেখলেন মলিন চেহারা, অগুছালো চুল ক্লান্ত শরীর এক যুবক মসজিদের কোনে বসে আছে। নবীজী কাছে গিয়ে দরদী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি, তোমার বাড়ি কোথায়, তোমার এই অবস্থা কেন? আমি আব্দুল উজ্জাহ, আমি মক্কা থেকে এসেছি, ঈমান আনার কারণে আমাকে বাড়ি ঘর সহায় সম্পত্তি সব ছাড়তে হয়েছে। এমন কি পড়নের জামা কাপড়ও। আসার সময় মায়ের কাছ থেকে শুধু এই কম্বলটি নিয়ে এসেছি। রাসূল (সা.) তাঁকে আসহাবে সুফ্ফার অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। সাহাবাদের নির্দেশ দিলেন তাঁকে কুরআন শেখানোর জন্য। অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন তোমার নাম আজ থেকে আব্দুল্লাহ, আব্দুল উজ্জাহ নয়।

হযরত আব্দুল্লাহ উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কোনো কোনো সাহাবী রাসূল (সঃ)-এর নিকট অভিযোগ করেন, যে ইয়া রাসূলাল্লাহ! আব্দুল্লাহ এতো জোরে কুরআন তেলাওয়াত করে যে অন্যান্যদের সমস্যা হয়। জবাবে রাসূল (সা.) বলেন; হে সাহাবাগণ! তাঁকে জোরে পড়তে দাও, বাঁধা দিওনা। তাঁর ঈমান যে বড় দামে কেনা! ঈমানের সওদায় সে সর্বস্ব হারিয়েছে।

তাবুকের যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। রাসূল (সা.) জিহাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। ৩০ হাজার মুজাহিদ সমেত রাসূল (সা.) তাবুকের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন। এর মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ এসে আরজ করলেন; ইয়া রাসূলাল্লাহ! আসন্ন জিহাদে নারী পুরুষ সকলে সামর্থানুযায়ী আপনাকে সহায়তা করেছে। কিন্তু আমি আল্লাহর এমন এক বান্দাহ, আমারতো দেওয়ার মত কিছুই নেই। আপনি আমার জন্য দোয়া করুন, যেন আমি এই জিহাদে আল্লাহর রাহে শহীদ হতে পারি। তাঁর কথা শোনে রাসূল (সা.) বললেন; তুমি গাছের একখানা ছাল নিয়ে এসো। গাছের ছাল আনা হলো। রাসূল (সা.) তা হযরত আব্দুল্লাহর হাতে দিয়ে বললেন; “হে আল্লাহ! আমি আব্দুল্লাহর রক্ত কাফেরদের জন্য হারাম ঘোষণা করলাম।

হযরত আব্দুল্লাহ কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন; হে আল্লাহর রাসূল! আমি শহীদ হবার দোয়া চাইলাম, আর আপনি আমার রক্ত কাফেরদের জন্য হারাম ঘোষণা করলেন! প্রিয় নবী তাঁকে শান্ত্বনা দিয়ে বললেন; “হে আব্দুল্লাহ এখন যদি তোমার মৃত্যু জ্বরে আক্রান্ত হয়েও হয়, তবুও আল্লাহ তোমাকে শহীদ হিসেবে পরিগণিত করবেন।”

কিছুদিন পর তাঁর নিকট সংবাদ এলো, আব্দুল্লাহ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশে তাঁর কাফন দাফনের ব্যবস্থা হলো। রাতের বেলা দাফন হবে। একজন লোক টিমটিম আলোর বাতি নিয়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন কবরের ভেতরে নেমেছেন, দু’জন লাশ বহন করে নিয়ে আসছেন। যিনি কবরের ভেতরে দাঁড়ানো তিনি বললেন, “হে লাশ বহনকারীগণ! সাবধান! লাশের সাথে বেআদবী করো না তোমাদের ভায়ের লাশের প্রতি আদব রক্ষা করো” এই বলে তিনি লাশটি ধরে কবরে সমাহিত করলেন। যিনি কবরে দাড়িয়ে লাশটি সমাহিত করলেন তিনি আর কেউ নন স্বয়ং বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। আর যে দু’জন লাশ বহন করে ছিলেন তারা হলেন হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা.)। আর যিনি চেরাগ নিয়ে কবরের পাশে দাড়িয়ে ছিলেন তিনি ছিলেন হযরত বেলাল।

রাসূল (সা.) লাশ কবরে সমাহিত করে দু’হাত দিয়ে কবরের মাটি ঠিক করতে করতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে আরজ করলেন; হে আল্লাহ! আজ সন্ধা পর্যন্ত আমি আব্দুল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলাম, তুমিও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও।” হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ পাশে দাঁড়ানো ছিলেন তিনি আফসোস করে বললেন; হায় এই কবরে যদি আব্দুল্লাহর লাশ না হয়ে আমার লাশ হতো, তাহলে আমার ভাগ্যটা খুলে যেতো। মহান আল্লাহ সাহাবিদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের তাওফিক দান করুন।

সংকলন:
মাও: আবু তাহের নেত্রকোণী
প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম ক্বাওমি মাদ্রাসা।
ভূগী, পূর্বধলা, নেত্রকোণা।
নিয়মিত লেখক, ইসলামিক জার্নাল বিভাগ
নেত্রকোণা জার্নাল