(মা’কে লেখা মেয়ের চিরকুট)
মা,
কেমন আছো তুমি? রাতে খেয়েছো কি? কি দিয়ে খেলে তুমি? বাবা কেমন আছেন? বাবা খেয়েছে তো? বাবাকে বলো খুব ঠান্ডা এখন, বাহিরে যেনো অযথা ঘুরাফেরা না করেন, সর্দি জ্বর হবে, তুমিও সাবধানে থেকো।
আমরা যে যেখানেই থাকি এই কয়েকটা কথা এক মিনিট ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারিনা আমাদের মা বাবাকে, আমাদের হাতে সময় থাকেনা।
কিন্তু মা, কি আশ্চর্যের বিষয়! যখন আমরা শিশু ছিলাম,শৈশব কৈশোরে ফিরে তাকাই , দেখি যে কত অশান্তি কত যন্ত্রণা কত সীমাহীন কষ্ট ভোগ করে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছো তুমি। এখানেই শেষ নয়, এরপরে পরম মাতৃস্নেহে আমাদেরকে কত মমতায় লালন পালন করেছো। আমরা যখন কোন কথা বলতে পারতাম’না, হাঁটতে পারতাম’না, খেতে পারতাম’না ; তখন সেই তুমি ছাড়া আমাদের কোন উপায় ছিলনা।
মা, আজও সেই শীতের রাত ফিরে এসেছে। কত শীতের রাত তুমি আমাদেরকে কুলে নিয়ে নির্ঘুম কাটিয়েছো। তোমার কুলে কতবার পায়খানা প্রশ্রাব করে দিয়েছি, তুমি এতটুকু বিরক্ত না হয়ে নিজে ভিজে আমাকে উষ্ণতায় রেখেছো, কৈ আমার না একটু ঠান্ডা লেগে যায় সেই ভয়ে।
অথচ দেখো মা, সেই তোমার একটি ছোট্ট পেটে এতগুলো সন্তানের জায়গা হয়েছিল, আজ তাদের কতগুলো ঘর, কিন্তু মা এই এতগুলো ঘরের কোন এক কোণেও তোমার একটু থাকার জায়গা হলো না। কত নির্মম পৃথিবী তাইনা মা। আজও তুমি সেই প্রাচীন জরাজীর্ণ পিতৃত্বের বাংলো ঘরেই পড়ে আছো। এ কথা জিজ্ঞেস করলে তুমি বলো এতেই আমার সুখ। আজ সেই তুমি আমাদের শিশুকালের মতই হয়ে গেছো!
একা একা কোথাও যেতে পারোনা, ভালোমন্দ কিছু খেতে পারোনা, স্নান করতে পারোনা, শুধু নিরব তাকিয়ে থাকো কে কখন এসে একটু সহানুভূতি দেখাবে তোমায়। অথচ কত সময় তুমি ব্যয় করেছো আমাদের জন্য, সেই মাতৃজটোর থেকে এই যৌবন,তার হিসেব রাখিনে। আর সেই আমরাই কিনা যার যার ঘর ঘরণী নিয়ে এতটাই ব্যস্ত তোমার দিকে ফিরে তাকাবার একটু সময় পাইনে। কিন্তু আজও যদি একটু ব্যথা পেয়ে মনের অজান্তে মাগো বলে ডেকে উঠি, তুমি মা’র সেই উদার মাতৃত্বের পরম কলিজাটা ফেটে যায়।
মাগো, হয়তো ভাবছো অযথা অসব নিয়ে এত ভাবছি কেন? মা, মাগো এ তো ভাবার বিষয়! পৃথিবীর সকল সন্তানের জায়গায় দাঁড়িয়ে চরম সত্যটাকে স্বীকার করতে হয়,এটা না বলার বিষয় নয়, এটা হ্নদয় দিয়ে উপলব্দির বিষয়। খোদার পরেই তুমি মা। আমি খোদাকে দেখিনি, তোমাকে দেখেছি। তুমি হয়তো আরও ভাবছো,লোকে কি বলবে? আরে এই লোকগুলো তো চরম অকৃতজ্ঞ! বড় স্বার্থপর!
তোমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বুঝতেই পারেনা; তুমি যে তারে আনার অভিযানে কত প্রসব ব্যথায় তোমার শরীরের বত্রিশটি পাজরের নাড়িভূরী ছিড়ে তারে এই পৃথিবীতে এনেছো। তুমি তো মরে যেতেও পারতে, মরণ থেকে বেঁচে গিয়ে পূর্ণ জীবন দিয়েছো তারে। আর এখন কিনা বলছো সে কি বলবে। বোকা বোদ্ধ মা আমার! তুমি কিচ্ছু বুঝোনা। সারা জীবন শুধু তুমি দিয়েই গেলে উজার করে, বিনিময়ে কি পেলে তুমি,একটু বলোনা? জানি বলবে না,কারণ তুমি যে মা! মহান এক ভালোবাসার নাম।
যে মা তার সন্তানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেনা, সেই মা’কে নিজের শরীরের চামড়া দিয়ে জুতো বানিয়ে দিলেও তোমার ঋণ শোধ হবেনা। অথচ দেখো, কত সন্তানের মা’বাবা কত ফুটপাতে শীতে কাঁপছে ,কত বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে আছে, কত অনাহারে অর্ধাহারে জীবন যাপন করছে। কৈ তুমি তো তখন ওই সন্তানদের ফেলে রেখে কোথাও চলে যাওনি; বুকে আগলে ধরে রেখেছো, তবে ওরা কেন বড় হয়ে তোমাকে ফেলে রেখে চলে যায়? এই কি ছিল প্রতিদান?
একা থাকা, ফুটপাত, বৃদ্ধাশ্রম যার ঠিকানা হয় এমন। হায়রে মা, তারপরেও তুমি বলো তোমার নাড়িছেঁড়া ধন। সেই বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি তারপরে সন্তানের বাড়ি; তোমার বাড়ি কোথায়? তিন তিনটি জ্যানারেশনের মাঝে তোমার একটি জীবন উৎসর্গ করেও তোমার ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম!?
মাগো, কম করে হলেও আড়াই বছরে তোমার উদরে থেকে নয়শত কেজি দুধ খেয়েছি। কৈ তুমি তো একদিনেও বারণ করোনি, একদিন যদি কোন কারণে না খেয়ে রয়েছি, তুমি পাগলের মত প্রলাপ করতে, কেন আমি দুধ খাচ্ছি না? কি হয়েছে আমার? আমার সোনা কেন দুধ খাচ্ছে না? তোমরা কে কোথায় আছো, ডেকে আনো ডাক্তার কবিরাজ। অথচ দেখো মা কত নির্মম পরিহাস! সেই তুমি যদি মাসের পর মাস না খেয়ে থাকো কোন অসুখ বিসুখে ভোগলেও তোমার সেই সন্তানেরা কেউ একবারও খবর নিয়ে দেখেনা কি খেয়েছে মা কেমন আছে মা।
তবুও তোমার অন্তর থেকে প্রার্থনা থাকে তোমার সেই সন্তানেরা যেনো ভালো থাকে। মাগো, তোমার এই মহান উদারতার কাছে পৃথিবীর সব কিছুই মিছে মনে হয়। কারণ তোমার শ্রেষ্ট্রত্বের কাছে পৃথিবীর সকল কিছুই হার মানায়। তুমি তো এক শ্রেষ্ট কারিগর! তুমি নিরক্ষর হলেও তোমার প্রতিটি সন্তানকে এক একটি ডিগ্রি উপহার দাও। তুমি মহান এক ডাক্তার, তোমার প্রতিটি সন্তানকে সুরক্ষা দাও। তুমি মস্ত বড় ইন্জিনিয়ার,বিশাল এই পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলো।
এই পৃথিবীর যা কিছু চির সুন্দর তার সূচনায় রচিয়তা তুমি।অথচ সেই তোমাকেই কি না কত অবহেলা করে তোমারই সন্তানেরা। মাগো, ছোট বেলায় কত বায়না ধরতাম, আমাকে এটা এনে দাও ওটা এনে দাও, তুমি না শুনে থাকতে পারতে না, এনে দিতে। অথচ দেখো মা, তোমার সন্তানেরা কতকিছু এনে খায়, কত কি করে, কৈ তোমাকে তো একবারও জিজ্ঞেস করেনা, মা তোমার কিছু লাগবে কি না? তবুও তুমি মা অসব দেখেও চুপটি করে থাকো কিচ্ছু বলো না।
জিজ্ঞেস করলে বলো থাক্ লাগবে না ছেলেটার টাকা ফুরিয়ে যাবে। মাগো, আমি জানতাম, পৃথিবীর সকল মা বাবা তার সন্তানকে পরম যত্নে বড় করবে, আর সন্তানেরা তার মা বাবাকে বয়োবৃদ্ধা কালে দেখাশুনা করবে এটাই তো বংশপরম্পরায় হয়ে আসছিল, তাহলে এমন নির্মম হয়ে যায় কেন সেই সন্তানেরা! বড় হয়ে দুরে চলে যায় কেন? তবুও তুমি মা সেই সন্তানেরে ভুলেও ভুল করে একবারও কোন অভিশাপ দাওনা, তবুও তুমি তার মঙ্গল কামনা করেই যাও। মাগো, এত ধৈর্য্য তোমার, কি করে এতকিছু সয়ে যাও তুমি, তোমার এত সয়বার ক্ষমতা কোত্থেকে পাও?
আসলেই তুমি মহান; তোমাকে স্যালুট মা! বিনম্র শ্রদ্ধাভরে তোমাকে স্মরণে রাখি; তুমি আমার পৃথিবী মা। আমার ভূবণে তুমি আজীবন বেঁচে থাকো মা।
“তোমারই অবাধ্য মেয়ে”
(পঞ্চভূতের ডায়েরি)