মাহে রবিউল আউয়ালের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য : কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও নিরসন

‘যে অন্য লোকের দুনিয়া বানানোর জন্য নিজের অখিরাত নষ্ট করে, কিয়ামতের দিন সে সবচেয়ে বেশি নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে। ’

প্রকাশিত: ২:২১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৩

ইসলামিক জার্নাল ডেস্কঃ
রাহমাতুললিল আলামিন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি প্রিয় নাম যা প্রত্যেক মুসলিম তার অন্তরে মহব্বতের সঙ্গে স্মরণ করে থাকে।আজ বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩) ১২ রবিউল আউয়াল, প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ৫৭০ সালের এই দিনে মানব জাতির জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর শুভ আবির্ভাব ঘটে।

রবিউল আউয়াল মাসে আরবের মক্কা নগরীর সভ্রান্ত কুরাইশ বংশে আমিনার কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। আমলের দিক দিয়ে কারো মধ্যে যত কমতিই থাকুক, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বত তার অন্তরে ততই গভীর। এ মহব্বতের কোন তুলনা নেই।

মুমিনের দিলে যে কারণে আল্লাহতা আলার মহব্বত গভীর, সে কারণেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বত গভীর হওয়া স্বাভাবিক। আল্লাহপাক বলেন, ‘যারা ঈমানদার তাদের মহব্বত গভীর হওয়া স্বাভাবিক’ (সূরা বাকারা: ১৬৫)।

রবিউল আউয়াল ইসলামী ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে আগমন করেছেন। এই মাসেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এবং একই মাসে উনার জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ- হিজরত সম্পন্ন হয়েছিল। নবী (সাঃ) সার্বক্ষণিক চর্চার বিষয়। কিন্তু ইস্যুভিত্তিক আলোচনাকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। মুহাররম আসলে আপনি আশুরা নিয়েই কথা বলবেন, তখন নিশ্চয়ই কুরবানীর ফযীলত বয়ান করবেন না। রবিউল আউয়াল মাসে নবীকে নিয়ে কথা হবেই । মাস বিবেচনায় বিশেষ সওয়াব আছে মনে না করলে তা হতেই পারে। দ্বীনী মজলিসের খরার যুগে এই তাখসিসটা অবধারিতই ছিল।

সেই আলোচনা যেমন নবীর (সাঃ) পূর্নাঙ্গ জীবনকেন্দ্রিক হতে পারে, জীবনের বিশেষ পার্টকে কেন্দ্র করেও হতে পারে। ছোটবেলা নিয়ে শিশু মুহাম্মাদ (সা), রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে বিশ্বনেতা মুহাম্মদ (সা) বা শুধু মৃত্যুকে টপিক ধরে যেভাবে আলোচনা হতে পারে; তদ্রুপ জন্মকে কেন্দ্র করে মিলাদুন্নবী (সা) মাহফিলও হতে পারে। এই ধরণের মীলাদ মাহফিল পুণ্যের কাজ। একে বিদআত বলা চরম ধৃষ্টতা।

তবে বাস্তবতাকে আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। বাস্তবতা হল, এত সলিট মিলাদুন্নবী খুব কম লোকই পালন করে। লোকে বরং এই মিলাদুন্নবীর নাম দিয়ে অজস্র আপত্তিকর কথাবার্তা ও নিষিদ্ধ কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে! সিরাতুন্নবির নাম দিয়েও একটু আধটু হওয়া শুরু হইছে ইদানিং! তবে মিলাদুন্নবী নামেই এগুলোর প্রচার হয়ে থাকে আকসার। এতে করে তারা নিজেরা তো অন্যায় করছেই, মিলাদুন্নবীর মত একটি পবিত্র বিষয়কেও খারাপভাবে চিত্রায়ন করছে!

আপত্তিকর কথাবার্তার মধ্যে নবীর (সাঃ) শানে বাড়াবাড়ি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে রয়েছে নবীকে প্রায় আল্লাহর পর্যায়ভুক্ত করে ফেলার প্রয়াস! কেউ আল্লাহর একক বৈশিষ্ট্য আলেমুল গাইব বানিয়ে দিচ্ছে নবীকে। আবার কেউ উনাকে হাজির নাজির টাইপের উদ্ভট কথাবার্তা বলে গুমরাহ হচ্ছে! এছাড়াও নূরের তৈরী, মৃত্যু বরণ করেননি টাইপের ফালতু টপিক দিয়েই ভরপুর থাকে হালের মিলাদ মাহফিলগুলো!

আপত্তিকর কার্যক্রমের বিবরণ আসলে সেভাবে তুলে ধরার দরকার নেই। মিছিল র‍্যালী কিয়াম বা শান এর নামে নাচ-গান; এসব দেখে যে কেউই বুঝতে পারবে ব্যাপারগুলো। এগুলো পালনের ধরা-বাঁধা রুসুম-রেওয়াজও চোখে পড়ার মত! সিরাতুন্নবি, মিলাদুন্নবী বা নবী সাঃ এর অন্য যে কোন অধ্যায়; এসবের সাথে বিদআত হারামের কোন সম্পর্ক নেই। এগুলো কিভাবে করছেন, কী কী করছেন সেটাই মুখ্য।

আর দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো, যারা মিলাদুন্নবী আয়োজন করেন, তারা বহু গর্হিত কাজ করে বসেন, যারা সিরাতুন্নবি আয়োজন করেন, তারা মিলাদুন্নবীকে অবজ্ঞা করে বসেন!, মুমিন আল্লাহকেই বেশি ভালোবাসেন এবং এ ভালোবাসা প্রকাশের একমাত্র পথ হলো রাসুলের অনুসরণ, অনুকরণ ও আনুগত্য। কিন্তু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা ছাড়া কি তাঁর আনুগত্য সম্ভব? তাই আল্লাহকে ভালোবাসার স্বাভাবিক পরিণতিই হলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা কি পরিমাণ থাকা উচিত সে কথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘তোমাদের কেউ সত্যিকারের মু’মিন হবে না, যে পর্যন্ত আমি তার নিকট তার পিতা, পুত্র ও সকল মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় বলে গণ্য না হবো।’ আল্লাহপাক পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজনকে ভালোবাসা কর্তব্য বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কারো প্রতি ভালোবাসা যেন রাসূলের চেয়ে বেশি না হয়, বরং সবার চাইতে যেন রাসূলের প্রতি ভালোবাসা অধিকতর গভীর ও তীব্র হয়, সে কথাই এ হাদিসে বলা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো যে, আমাদের ভালোবাসা রাসূলের জন্য সবচেয়ে বেশি কি না তা যাচাই করার উপায় কি? এর হিসাব নেয়া কঠিন নয়। অন্য কোনো মানুষের প্রতি ভালোবাসার দাবি পূরণ করতে গিয়ে যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানি করা হয় তাহলে বোঝা গেল যে রাসুলের প্রতি ভালোবাসা অন্যের তুলনায় কম। বাস্তবে এটাই দেখা যায় যে মানুষ প্রিয়জনের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তাদের মঙ্গলের নিয়তেই এমন কিছু করে, যা করতে গিয়ে আল্লাহ ও রাসুলের হুকুম অমান্য করে। রাসুলের প্রতি গভীর ভালোবাসা থাকলে সে এমনটা করবে না। যারা এমন বোকামি করে তাদের সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যে অন্য লোকের দুনিয়া বানানোর জন্য নিজের অখিরাত নষ্ট করে, কিয়ামতের দিন সে সবচেয়ে বেশি নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে। ’

রবিউল আউয়াল মু’মিনের দিলে রাসূলের প্রতি যে মহব্বতের দরিয়া প্রবাহিত হয় তাতে রবিউল আউয়াল মাসে যেন বান ডাকে। মহব্বতের এ জোয়ার এ মাসে সর্বত্রই টের পাওয়া যায়। সিরাতুন নবীর এত চর্চা আর কোন মাসে হয় না। বড় বড় মাহফিলে, মসজিদে, অফিসে, বাড়িতে, সর্বত্র এ মাসে অনুষ্ঠানের ব্যাপক আয়োজন হয় এবং তাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে ইসলামী চিন্তাবিদ ও ওলামায়ে কেরাম মূল্যবান আলোচনা পেশ করেন।

এসব অনুষ্ঠানে সমবেতভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যে পরিমাণ দরুদ ও সালাম পেশ করা হয় বছরের আর কোনো মাসে এতটা হয় না। এ মাসটি এ ব্যাপারে এমন এক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যার কোনো তুলনা নেই। বিশেষ করে ১২ রবিউল আউয়াল ঘরে ঘরে যেভাবে মিলাদের অনুষ্ঠান করা হয়, এমনভাবে এক দিনে আর কোনো সময় করতে দেখা যায় না।

মিলাদ মাহফিল ও দোয়ার মাহফিলঃ
মিলাদ অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে একটি বিষয় মুসলিম সমাজ, বিশেষ করে ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন মনে করছি। আমাদের দেশে সারা বছরই বিভিন্ন উপলক্ষে যেসব দোয়া মাহফিল হয়, তা সাধারণত মিলাদ মাহফিলের নামেই হয়ে থাকে। নতুন বাড়ি বা দোকান উদ্বোধন উপলক্ষে দোয়া, বিয়ে, শাদি উপলক্ষে দোয়ার যে অনুষ্ঠান করা হয়, তা খুবই ভালো রেওয়াজ।তবে মুসলমানদের সব কাজই আল্লাহর নামে ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা অনুযায়ী হওয়া উচিত। আসলে ওই অনুষ্ঠান গুলো কি মিলাদ কি না?

সংকলন:
মাও: আবু তাহের নেত্রকোণী
প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম ক্বাওমি মাদ্রাসা।
ভূগী, পূর্বধলা, নেত্রকোণা।
নিয়মিত লেখক, ইসলামিক জার্নাল বিভাগ
নেত্রকোণা জার্নাল