“মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা” -মাজেদুল হক
মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা
-মাজেদুল হক
মধ্যরাত!
হঠাৎ শোনা যায় গুলির আওয়াজ, বিকট শব্দে আমার ঘুম ভাঙে, ঘুম থেকে চমকে উঠি, দুচোখ মেলেই আমার অবিরত প্রশ্ন – কোথায় এমন শব্দ ? পরে জানিতে পারলাম আজ ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস তাই গভীর রাতে তোপধ্বনি হচ্ছে , তখন জানিতে চাইলাম , স্বাধীনতা কি ? কেন এ দিবস পালন করা হয় ?
আমার পিতামহ শেখ মোহাম্মদ মাফিজ উদ্দিন ওরফে শেখ কালাচাঁন বা কালু শেখ তিনি আমায় বুকে জড়িয়ে কোলে নিয়ে কাঠের চেয়ারে বসিলেন এবং শোনালেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা।
দাদাভাই,
সেদিনের কথা মনে হলে এখনও দুচোখে জল আসে কারণ মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো ছিল খুবই ভয়াবহ, পশ্চিমা পাক বাহিনী হানাদার পাকি সেনারা ঝাপিয়ে পড়ে ছিল আমাদের (পূর্ব পাকিস্তান) নিরীহ বাঙালির উপর, নির্বিচারে হত্যা করেছে গরীব দুখী মানুষ কে। ঘর থেকে তুলে নিয়ে কিশোরী মা-বোনকে নির্যাতন করে ছিল, মা-বাবার সামনে অস্ত্র ঠেকিয়ে যুবতী মেয়েকে এবং স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে, ওরা ছিল নারীর দেহ লোভী নরপিশাচ।
পথে-ঘাটে পড়ে থাকিত অগণিত মরা মানুষের লাশ, লাশের দুর্গন্ধে দুর্বিষহ হয়েছিল এলাকা। কুকুর, শিয়াল ও কাক,শকুনের খাবার হয়েছিল মানুষের লাশ। নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে ভেসে যেতো মানুষের লাশ, এসব দেখেও কিছু করার ছিল না। প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না কারণ ওরা ছিল শক্তিশালী। মান সম্মান নিয়ে বাঁচা ছিল খুবই কষ্টকর।যেকোনো সময় ঘটে যেত অঘটন। রাজাকার ও আলবদর ছিল ঐ হানাদার বাহিনীর দোসর, ওরা এসব অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করিত।
ফকিরের বাজার নামক মোকামে ছিল আমার মনোহারী দোকান, দোকান থেকে বাজার শেষে সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে খাবার খেতে বসেছি এমন সময় পাকি হানাদারের(রাজাকার) দল আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে নিয়ে যায় টাকা ভর্তি টাকার থলে তখন আমি ব্যবসার পুঁজি হারা হয়ে যাই তারপরেও কোন রকম কষ্ট করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখি কিন্তু ওরা বার বার চেষ্টা চালায়, আমার বাড়িতে এসে টাকা না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দেয় তাই আমি আমাদের ইউনিয়নের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার টাইগার সিদ্দিক কে এ বিষয়ে অবগত করি, সে আমায় অত্যাধিক শ্রদ্ধা করিতো তাই আমার প্রতি খেয়াল রাখিত। মুক্তিযোদ্ধাদের কে আর্থিক সহযোগিতা করিতাম যখন তাদের চাল,ডালের প্রয়োজন হইতো তখন আমি আমার দোকান থেকে চাল, ডাল দিতাম এবং বিভিন্ন ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কারণে আমাকে মেরে ফেলার জন্যে চেষ্টা চালায় তখন আমি আত্মগোপনে থেকে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (নেত্রকোণা সদর ও বারহাট্রা, নেত্রকোণা-২ আসনের বর্তমান মাননীয় এম পি) আশরাফ উদ্দিন খান খশরু সাহেব কে এ বিষয়ে অবগত করিলে তিনি, মাধব ও ওয়াজেদ নামে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা আমার বড়িতে নিযুক্ত করেন। তাঁরা আমাদের এলাকার নিরাপত্তা দিতে সচেষ্ট থাকিতেন। স্বাধীনতার ঘোষণা পর্যন্ত আমি আমার সাধ্যমতো মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে যাই। স্বাধীনতা ঘোষণার পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তৎকালীন জীবিত অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসে আমাকে তাদের উপকারের জন্যে প্রশংসা করেছেন এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে গিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ছিলেন কিন্তু আমি বলেছি, আমার উপকারের জন্যে প্রশংসার প্রয়োজন নেই, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাই আমি গর্বিত।
অনেক তাজা প্রাণ ঝরেছে, মা-বোনের সম্ভব হারিয়েছে, অগণিত শহীদের রক্তে রঞ্জিত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ তাই আমরা প্রতিবছর শহীদ স্বরণে, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, ২৬ মার্চে স্বাধীনতা দিবস পালন করি। স্বাধীনতা দিবস বাঙালি জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্বরণীয় দিন।
স্বাধীনতার পরে জন্মেছি তাই নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ না দেখিলেও ইতিহাস পড়ে, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং মুক্তিযুদ্ধাদের কাছে জেনেছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা।
আমার অতি শ্রদ্ধা ভাজন ও প্রিয়জন যিনি আমাকে নিজের সন্তানের মতো আদর স্নেহ করিতেন তিনি হলেন ১১ নং কে গাতীর কৃতি সন্তান একাত্তরের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, একাধিক বার ইউনিয়ন পরিসদের চেয়ারম্যান হাজী আবু সিদ্দিক আহমেদ ওরফে টাইগার সিদ্দিক যার নাম বাংলাদেশের ঘরে ঘরে অতি পরিচিত। তিনি গ্রামের বাড়িতে এলেই আমাকে নিয়ে যুদ্ধকালীন জীবনের কথা শোনাতেন।
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় সবে মত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে পেয়ে এলাকায় এলেন টাইগার সিদ্দিক, বাড়িতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তাৎক্ষণিক খবর পেলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শহর থেকে গ্রামে ঢুকবে তখন তিনি ওদের আসার পথে বড়ওয়ারী ফেরি ঘাটের ওপারে হাতকুন্ডলী গ্রামে উনার দলবল (মুক্তিযোদ্ধাদের) নিয়ে আত্মগোপন করে গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকেন,দুপুর গড়িয়ে বিকেল ঘনিয়ে এলো এমন সময় পাকি সেনারা ফেরি পাড় হয়ে অট্ট হাসি মুখে মহান্দে ওপারে পা রাখিল গ্রামে ঢুকার উদ্দেশ্যে, সামনে পা বাড়ানো মাত্রই সকল মুক্তিযোদ্ধা এক সাথে আল্লাহর নাম স্বরণ করে গুলি ছাড়লেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপরে, নিমিষেই পাকি সেনারা লুটে পড়লো মাটিতে, প্রায় ১৫/১৬ জন সেনাবাহিনী ছিল কিন্তু অবিরত গুলাগুলির কারণে সবাই মৃত্যু মুখে পতিত হলো আর এটাই ছিল নেত্রকোণায় সর্বপ্রথম সন্মুখ যুদ্ধ তারপরে পর্যায় ক্রমে টাইগার সিদ্দিক এর নেতৃত্বে চলে যুদ্ধ স্বাধীনতা চিনিয়ে আনিতে সক্ষম হয় সাহসী রণাঙ্গনের মধ্য দিয়ে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই শাসনব্যবস্থায় একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রবণতা লক্ষ করা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের উপর শুরু হয় অমানবিক আচরণ, কলে কৌশলে শুরু হয় নিপীড়ন এসব অত্যাচারের প্রতিবাদ করার কারনেই সৃষ্টি হয় যুদ্ধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান সামরিক শাসক যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের ওপর একের পর এক নিপীড়নমূলক আচরণ করে, তখনই এদেশের জনগণ তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে, যার পরিণতি ছিল ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান । এ অভ্যুত্থানে ২৫ শে মার্চ আয়ুব খান পদত্যাগ করিলে তার উত্তরসূরি জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেন।তিনি ঘোষণা করেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। যার পরিপেক্ষিত ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে আওয়ামিলীগ বিপুল ভোটে বিজয় অর্জন করিলেও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে গড়িমসি করে। একপর্যায়ে তারা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করে এবং শেষ পর্যায়ে এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ শুরু করে। ববঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর নির্দেশে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়, পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ শত্রুর দখলমুক্ত হয়। অবশেষে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের বীর বাঙালি ফিরে পায় বহুদিনের প্রত্যাশিত প্রিয় স্বাধীনতা।