
১৯৭১সন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিরর হমানের আহবানে সারা বাংলাদেশে প্রচন্ড মুক্তিযুদ্ধ চলতেছিলো। বাংলাদেশ যেনো এক অগ্নিগর্ভ। দিনরাত শোনা যেতো গুলাগুলিরশব্দ। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনা বাহিনীর প্রশিক্ষিত সৈন্যদের সাথে এ দেশের সাধারণ প্রশিক্ষিত মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের সাথে যুদ্ধ।
সেই সময়টিতে তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যমগুলো মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক খবর প্রচার ও প্রকাশ করতোনা। তখনো এদেশের প্রচার মাধ্যমগুলো পাকিস্তানিদের দখলেছিলো। এহেন অবস্থায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী গণমাধ্যমকর্মীগণ ধীরে ধীরে সরে আসতে লাগলেন।
তখন স্বাধীনতার পক্ষের একমাত্র প্রচার মাধ্যমে ছিলো “স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র”। এই বেতার কেন্দ্র হতে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সঠিক খবর প্রচার ও প্রকাশ করা হতো। বাংলাদেশের এই ক্রান্তিলগ্নে এদেশের প্রতিটি গনমাধ্যম কর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের খবর সংগ্রহ করতেন। আর সেই খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচার ও প্রকাশ করা হতো।
তৎসময়ের এমন অনেক ঘটনা আছে, পাক বাহিনীর নির্যাতনে অনেক গণমাধ্যমকর্মী শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সত্য প্রচারে ক্ষ্যান্ত হন নাই। দীর্ঘ নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ শাহাদাত বরণ করেন। দু’লাখ মা- বোন সম্ভ্রম হারান। তার মধ্যে একটি বিরাট অংশ গণমাধ্যমকর্মী।
আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি আজ অর্ধ-শতবছর অতিক্রম করেছে। এদেশের যে কোন দূর্যোগ ও ক্রান্তি লগ্নে প্রথম যে শ্রেণিটি স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রথম সারিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন তারা হলেন গণমাধ্যমকর্মী।
বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার গনমাধ্যমকর্মীদের ত্যাগ তিতিক্ষার স্বীকৃতি স্বরূপ ঘোষণা করেছে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সরকারের এহেন ঘোষণাকে সাধুবাদ জানাই। সর্বজন স্বীকৃত সংবাদপত্র আধুনিক বিশ্বে একটি উন্নত মানের শিল্প। যে শিল্প সমাজ, জাতি, দেশ ও বিশ্ব সেবায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে ।
তবে এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, তাদের সত্য, স্বচ্ছ ও সাহসী ভূমিকা পালনে বিভিন্ন ক্ষমতাধর ব্যক্তি অথবা সমাজের প্রভাবশালী অনেকের হাতেই গণমাধ্যমকর্মীগণ নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হয়ে থাকেন। যাহা কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। সত্য প্রকাশ যদি কোন ক্ষমতাধর প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে চলে যায় তখন তারা গনমাধ্যমকর্মীদর অত্যাচার নির্যাতন এমনকি হত্যা পর্যন্ত করেন। এমন অনেক অনৈতিক ঘটনা দেশ ও দেশের বাহিরে দৃশ্যমান।
তারপর আমরা গণমাধ্যমকর্মীদের পক্ষে মানববন্ধন করি, প্রতিবাদ করি। আজ আর আমরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইনা। আমরা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এসব অনৈকিতা মোকাবেল করবো। বিশ্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই সারা বিশ্বে গণমাধ্যমকর্মীগণ নিগৃহীত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। যাহা অমানবিক ও দূঃখজনক ।
একজন গণমাধ্যমকর্মীকে তুচ্ছজ্ঞান অতিসাধারণ ভাবার কোন কারণ নেই। তিনি এদেশের একটি মহানও সম্মান জনক পেশায় নিয়োজিত। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দেশি ও বিদেশী সকল গণমাধ্যমকর্মীদের যথেষ্ঠ সম্মান ও মূল্যায়ন করতেন। তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই তথ্য সংগ্রহের জন্য অসংখ্য গণমাধ্যমকর্মী উপস্থিত হয়েছেন।
বর্তমানে শত প্রতিকুলতা উপক্ষো করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের ভবিষ্যত মঙ্গলের জন্য “সাংবাদিককল্যাণ ট্রাস্ট” গঠন করেছেন। আশার কথা দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত প্রাণ গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য সরকার ভাবতে শুরু করেছে। আমি বিশ্বাস করি গনমাধ্যমকর্মীদের আগামীদিনের পথ চলা হবে আরো সুন্দর ও কুসুমাস্থির্ণ।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান। আরতার শ্রেষ্ঠ সহায়ক শক্তি এদেশের গণমাধ্যমকর্মীগণ। তার অর্জিত প্রতিটি সফলতা গণমাধ্যমকর্মীগণ অতিযত্ন সহকারে স্বচ্ছ ভাবে দেশ ও দেশের বাহিরে প্রচার ও প্রকাশ করে যাচ্ছেন। স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটি গণমাধ্যমকর্মী স্বদেশে প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও পরীক্ষিত সৈনিক।
দেশ পরিচালনায় যে কোন সরকারের সফলতা ও ব্যার্থতা থাকাই স্বাভাবিক একজন গণমাধ্যমকর্মী সরকারের সফলতা প্রকাশ করবেন। আর ব্যর্থতার বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন ও প্রকাশ করবেন যেন সরকার তার চলায় পথের দিকে নির্দেশনা পায়। এতে দোষের কিছু নাই। তবে প্রতিহিংসা পরায়ণতা পরিহার করতে হবে।
স্বচ্ছ মনে পথ চলায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তবে পরিতাপের বিষয় ইদানিং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হলুদ গনমাধ্যমকর্মীদরে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে আমাদের সকলের সচেতনতা অবলম্বন করতেহবে। একজন গণমাধ্যমকর্মীর নৈতিক চেতনা হবে সত্যবাদিতা, সত্য প্রকাশ ও স্বদেশ প্রেম। যার মনে স্বদেশে প্রেমের ঘাটতি আছে তাকে আমি হলুদ গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে আখ্যায়িত করি।
ঝড় আসবে বৃষ্টি আসবে, ধমকা হাওয়া বইবে, তার মাঝেই গণমাধ্যমকর্মীদের পথচলা। হে কলম সৈনিক! মহান মুক্তিযুদ্ধে তোমার অবদান, বিশ্ব ইতিহাসে তোমার সত্য প্রকাশের অবদান, দেশও বিশ্বের ক্রান্তিলগ্নে তোমার অবদান, কেউ কোনদিন ভুলতে পারবেনা। তোমার মেধা, তোমার মনন, দক্ষতা, তোমার কর্মের মাধ্যমে তুমি প্রমাণ করেছো “Pen is mightier then the sward’ অর্থাৎ “কলম তরবারির চেয়ে শক্তিশালী” সবশেষে কবি গুরু রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে চাই “নিশ্চয়ই অতীতের চেয়ে ভালো হবেরে ভবিষ্যত”।
লেখক : সাংবাদিক, সমাজকর্মী, উন্নয়নকর্মী ও প্রাবন্ধিক।