মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথা : বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: শামছুজ্জোহা

২৩ শে মার্চ ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। ১৯৭১ সালের সেই প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন মোঃ শামসুজ্জোহার নেতৃত্বে নেত্রকোণায় তৈরি হয় বাংলাদেশ প্রতিরোধ যুদ্ধ দিবস।

প্রকাশিত: ২:২৪ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৩০, ২০২৩

নেজা ডেস্ক :
বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের ক্ষোভে-বিক্ষোভে এবং পাকিস্তানিদের চরম বৈষম্যের শিকার হয়ে জন্ম নেয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তির স্রোতধারা পূর্ববাংলার ঘরে ঘরে। ২৫ মার্চের পর থেকে উত্তাল হয় সারা দেশ। শুরু হয় মুক্তিকামী জনতার মুক্ত হবার যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধে অংশ নিয়ে সেই মুক্তিকামী জনতাই হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধা। লিখতে চলেছি এমন এক মুক্তিযোদ্ধার কথা- যাঁর কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন এখানে অল্প কথায় ব্যক্ত করা দুঃসাধ্য। তবুও অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করার প্রয়াস করছি মাত্র। তিনি একজন জীবনভর মুক্তিযোদ্ধা।

যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন হবার পর অস্ত্র জমা দিয়েও জীবনযুদ্ধকে লালন করে চলেছেন নীরবে, নিভৃতে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আজো ধারণ করে আছেন মননে। আর তাইতো তিনি একজন জীবনভর মুক্তিযোদ্ধা। কিছু মানুষের জন্মই যেন হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য, এদেশকে স্বাধীন করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের কথা যখন কেউ ভাবেনি তাঁরা তখন দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধে গিয়ে দেশ স্বাধীন করার কথাই মনে মনে ভাবতেন। প্রতীক্ষায় ছিলেন কখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কাছ থেকে আসবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সেই বহুপ্রতীক্ষিত নির্দেশ। কোন কিছুর বিনিময়ে তাঁরা যুদ্ধে যাননি, গিয়েছেন দেশ মাতৃকার টানে। তেমনি একজন হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোঃ শামসুজ্জোহা। এই নাম নেত্রকোণা জেলায় স্বাধীনতা যুদ্ধের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম।

এই নক্ষত্রের উদয় ঘটেছিল ১৯৩৮ সালে। অবশ্য তাঁর জন্ম সাল নিয়ে কিছুটা হের-ফের আছে। কারণ তিনি প্রথমে মাদ্রাসায় শিক্ষা জীবন শুরু করেছিলেন। তখন ছিলো ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়। সে সময় নেত্রকোণায় অধ্যাপক ফুলে হোসেন, সত্যকিরণ আদিত্য, আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল খালেক, প্রাক্তন এম.পি আব্দুল মজিদ তারা মিয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে মিটিং মিছিল করতেন।

জনাব শামসুজ্জোহা বাল্যকাল থেকেই ডানপিটে ছিলেন। তিনি মাদ্রাসার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তাঁর বন্ধুবান্ধব নিয়ে নেতাদের পিছনে ছুটতেন। বিষয়টি মাদ্রাসার সুপার সাহেব আমলে নিয়ে তাঁর পিতা মরহুম নুরুজ্জামান মাস্টারকে বললেন, আপনার ছেলেকে মাদ্রাসায় না রেখে স্কুলে ভর্তি করে দিন। উল্লেখ্য মরহুম নূরুজ্জামান মাস্টার ছিলেন দত্ত হাই স্কুলের শিক্ষক। তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে দত্ত হাই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। এখানে স্মরণীয় যে, জনাব শামসুজ্জোহার বড়ভাই করাচিতে চাকুরী করতেন। বড়ভাই তাঁকে পড়াশুনার জন্য করাচি নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার স্কুলে বাঙালি এবং পাকিস্তানি ছাত্রদের বৈষম্য বুঝতে পেরে করাচির পাঠ চুকিয়ে ১৯৬১ সালে একদিন একাই জাহাজে চড়ে জেদ করে মাতৃভূমি পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন। এসে আবার দত্ত হাই স্কুলে ভর্তি হন।

ততদিনে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। যে কারণে মেট্রিক পরীক্ষার বয়স ঠিক রাখতে দত্ত হাই স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁর জন্মের সাল পরিবর্তন করে ১৯৪৭ সালের ১০ ফেব্রয়ারি নির্ধারণ করেন। ফলে তিনি তাঁর সহপাঠিদের চেয়ে অনেকটাই সিনিয়র ছিলেন। পিতা নূরুজ্জামান মাস্টার এবং মাতা হাতেমুন্নেছার ঘরে জন্ম নেয়া এই স্বাধীনচেতা মানুষটি কালক্রমে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সৈনিকে পরিণত হন। এখানে আরো একটি বিষয় স্মরণীয় যে, রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য ১৯৫৮ সালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে। দত্ত হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করার পর তিনি নেত্রকোণা কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা লিটারেচার বিষয়ে ।

তবে করাচী থেকে স্বদেশ ভূমিতে আসার পর তিনি দেখতে পান দেশে চলছে আইয়ুব খানের মার্শাল ল’। মার্শাল ল’ বিরোধী একটি মেরুকরণ করতে চলেছে কমিউনিস্ট পার্টি। নেত্রকোণা জেলার অন্যতম রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যিনি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং তৎকালীন ময়মনসিংহ আসনের (নেত্রকোণা মহকুমা) সংসদ সদস্য সর্বজনাব আব্দুল খালেক, সত্যকিরণ আদিত্য, ফজলুর রহমান খান, মেহের আলী গাজী মোশারফ হোসেন, ওয়াজেদ আলী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ চেষ্টা করছিলেন এই অঞ্চলেও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে। সেজন্য কয়েকজন তরুণকে যুক্ত করেন। এর মধ্যে মোঃ শামসুজ্জোহা অন্যতম। এই আন্দোলনই ছিল উনার রাজনীতিতে হাতেখড়ি এবং ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ করার প্রথম অধ্যায়। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন তরুণদের অনুপ্রেরণা ও প্রাণের নেতা।

জনাব শামসুজ্জোহার ছাত্রলীগে যোগদানের বিষয়টিও একটি চমকপ্রদ ইতিহাস। ১৯৬১ সালে নেত্রকোণার তৎকালীন সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সংগঠন “ছাত্রসংস্থা”-র প্রতিষ্ঠাতা প্রধান উদ্যেক্তা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছাত্রনেতা  জনাব মেহের আলী(কিংবদন্তী ছাত্রনেতা জনাব মেহের আলী ১৯৬০ সালে সর্বজনাব জামাল উদ্দিন আহমেদ, গাজী মোশারফ হোসেন, টি.এ রহমত উল্লাহ, নুর“ল ইসলাম, লুৎফর রহমান খান, আব্দুস সাত্তার প্রমুখ নেতাদের নিয়ে “ছাত্রসংস্থা”-গড়ে তুলেন -ঐ সময় দেশে সামরিক আইনের কারনে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল তাই এই গোপন সংগঠনটি গড়ে তোলা হয় যার মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হতো ) ও জনাব শামসুজ্জোহাকে ডেকে আওয়ামীলীগ নেতা জনাব আব্দুল খালেক একটি হাতে লেখা চিঠি দিয়ে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দেন।

এই দুই ছাত্রনেতা নবাবপুর রোডে এক হোটেলে থেকে দেখা করতে যান বঙ্গবন্ধুর আলফা বীমা কোম্পানীর অফিসে। বিশাল এক সেক্রেটারিয়েট টেবিল নিয়ে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । এত বড় মাপের একজন নেতাকে দেখে তাঁরা উভয়েই কিছুটা ঘাবরে যান। বঙ্গবন্ধু বসতে বললেও তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকলেন। এক পর্যায়ে খালেক সাহেবের চিঠিটি মেহর আলী সাহেব বঙ্গবন্ধুর হাতে বিনয়ের সাথে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু চিঠিখানি পড়ে একজনকে ডাকলেন এবং তাদেরকে কেক এবং চা দিতে বললেন। এ পর্যায়ে তাঁরা জড়সড় হয়ে চেয়ারে বসেন। বঙ্গবন্ধু একটি চিরকুট দিয়ে তাঁদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মনি সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দেন। মনি সাহেব তাঁদেরকে বলেন, ‘তোমরা সন্ধ্যার পর আসো।

দেশে রাজনীতির যে কড়াকড়ি অবস্থা, দিনের বেলায় তোমাদের সাথে কথা বলা যাবে না’। কথামত তাঁরা ঐ দিন সন্ধ্যার পর মনি ভাইয়ের কক্ষে আসেন। মনি ভাই তাঁদেরকে অতি গোপনে ছাত্রলীগের আদর্শ-উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন এবং তাঁদেরকে কয়েকটি প্যাম্পলিট প্রদান করে বলেন, খুব সাবধানে নেত্রকোণায় নিয়ে যাবে। ধরা পড়লে নির্ঘাত ছয় মাসের জেল। প্যাম্পলিটের উপরে লেখা ছিলো একটি স্লোগান; যথা- ‘শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি’। এগুলো নিয়ে তাঁরা নেত্রকোণায় এসে কার্বন কপি করে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের মাঝে অতি গোপনে বিতরণ করেন।

১৯৬২ সালে নেত্রকোনা মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে   জনাব মেহের আলী ও জনাব শামসুজ্জোহাকে প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী করে কমিটি করে দেয়া হয়(জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন)। শুরু হয় নেত্রকোণায় ছাত্রলীগের অভিযাত্রা।  পরবর্তীতে একসময় জনাব শামসুজ্জোহা নেত্রকোণা ছাত্রলীগের সভাপতির(১৯৬৯-৭০ ) পদ অলংকৃত করেন এবং পরবর্তীতে আওয়ামী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে নেত্রকোণা জেলা শাখার সভাপতি (২০০৫)হন। এর পরের ইতিহাস সকলের জানা। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। তখনখার সময়ে নেত্রকোণায় রাজনীতির পাশাপাশি যাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন, তাঁদের মধ্যে জনাব মেহের আলী,সত্যকিরণ আদিত্য অন্যতম। নেত্রকোণায় তখন  ছাত্র রাজনীতি দুটি প্রধান ধারায় অগ্রসর হ”হচ্ছিলো।একটি হলো বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ এবং অপরটি হলো ন্যাপ-কমিউনিস্টদের ছাত্র ইউনিয়ন।

১৯৬৩ সনের জানুয়ারি মাসে মধুমাছি কচিকাঁচার মেলা গঠন করা হয়। জনাব মেহের আলী ছিলেন মধুমাছি কচিকাঁচার মেলার প্রধান উদ্যেক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক । মেলার পরিচালক হিসেবে ছিলেন জনাব এডভোকেট একে ফজলুল কাদের, আর উপদেষ্টা মন্ডলীতে ছিলেন- সর্বজনাব এন আই খান,জনাব আব্দুল খালেক, জনাব খালেকদাদ চৌধুরী, ডা. জগদীশ দত্ত, এডভোকেট ফজলুর রহমান খান,মাওলানা ফজলুর রহমান খান,হাবিবুর রহমান খান  প্রমুখ। জনাব শামসুজ্জোহাকে প্রতিষ্ঠাতা আহ্ববায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আয়েশা খানমকে প্রতিষ্ঠাতা আহ্ববায়িকা করে কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে  জনাব মতিয়ুর রহমান খানকে আহ্ববায়ক ও চামেলী খুরশিদকে আহ্ববায়িকা করে কমিটি গঠন করে দেয়া হয় ১৯৬৪ সালে।

১৯৬৫ সালে দায়িত্বে আসি আমি হায়দার জাহান চৌধুরী ও খনা সেন রায় আহ্ববায়ক ও আহ্ববায়িকা হিসেবে । পরে আলাউদ্দীন খান ও রেজিয়া রহমান ছবি  আহ্ববায়ক ও আহ্ববায়িকা হিসেবে দায়িত্বে আসেন। এরপর যারা আহ্ববায়ক হিসেবে দায়িত্বে আসেন তারা হলেন-জনাব আনোয়ারুল হক ভূইয়া, জসিম উদ্দীন ভূইয়া,দিলুয়ারুল হক ভূইয়া,এ টি এম মন্জুরুল হক,বিপুল সাহা,সাকী,রবিন,ইমু। ঐ সময়ে কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক র্কমকান্ডের আড়ালে রাজনৈতিক র্কমকান্ড পরিচালিত হতো।

নেত্রকোণা কেন্দ্রীয় ভাষা শহীদ মিনারের অন্যতম কারিগড় ছিলেন জনাব মো: শামসুজ্জোহা। অপর পক্ষে ছাত্র ইউনিয়ন খেলাঘরের অনুসারি ছিলো। এভাবেই এগিয়ে চলে জনাব শামসুজ্জোহার রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। রাজনীতি ও সংস্কৃতির পাশাপাশি পরবর্তী কালে তিনি নেত্রকোণায় সমাজসেবা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি নেত্রকোণা কো-অপারেটিভ ব্যাংক, মালটিপারপাস কো-অপারেটিভ এসোসিয়েশন এর সভাপতি হয়েছিলেন এবং এক পর্যায়ে রেডক্রস নেত্রকোণা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এমনকি নেত্রকোণা চক্ষু হাসপাতাল স্থাপনে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিলেন।

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান সহ সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন এই অঞ্চলের তরুণ সমাজের রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের সময় তিনি সদ্য কলেজ পাশ করা ছাত্র। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। মিছিল-মিটিংয়ে নেত্রকোণা তথা সারা বাংলাদেশ তোলপাড়। মিছিলের পর মিছিল, স্লোগানের পর স্লোগান। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা বেপরোয়া। ‘পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পুলিশ তুমি যতই মার, বেতন তোমার এক শ বারো’-এমন স্লোগানে তখন চারপাশ মুখরিত। সেসময় তিনি তরুণ ছাত্রসমাজকে সাথে নিয়ে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৯ সালে তাঁর ছাত্রলীগের সভাপতি পদে অভিষেক হয়। জয়বাংলার একনিষ্ঠ কর্মী, মিছিলের অগ্রভাগের বজ্রকণ্ঠ ছিলেন তিনি। হয়ে ওঠেন এক তুখোড় ছাত্রনেতা।

১৯৭১ সালের ১লা মার্চ মোঃ শামসুজ্জোহার নির্দেশে এবং তৎকালীন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরীর নেতৃত্বে এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়- যেখানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন যথাক্রমে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও নাজিম উদ্দিন আহম্মদ। উল্লেখ্য,স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ১৯৬২ সনে একটি গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামেও পরিচিত। এটি ছিল তিনজনের একটি চক্র বা সেল। তিনজন হলেন সিরাজুল আলম খান, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদ। যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার আগে আগে সিরাজুল আলম খান যে কয়েকজন বাছাই করা ছাত্ররাজনীতিবিদকে নিউক্লিয়াসে নিয়ে আসেন তাদের মধ্যে মোঃ শামসুজ্জোহা অন্যতম। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। সারাদেশে এসময় নিউক্লিয়াস তার অন্তর্জাল ছড়াতে থাকে এবং নেত্রকোণার নেতৃত্ব অর্পণ করা হয় মোঃ শামসুজ্জোহার হাতে।

২৩ শে মার্চ ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। ১৯৭১ সালের সেই প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন মোঃ শামসুজ্জোহার নেতৃত্বে নেত্রকোণায় তৈরি হয় বাংলাদেশ প্রতিরোধ যুদ্ধ দিবস। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো ও কুচকাওয়াজ, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া ও ছয় রাউন্ড ফাঁকাগুলি করা সহ বিভিন্ন রকমের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে মোক্তারপাড়া মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিরোধ যুদ্ধ দিবস। উল্লেখ্য, মোক্তারপাড়া মাঠে প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিলেন জনাব এন আই খান।

সাল ১৯৭১। জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত চারদিক। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এই মন্ত্রে দীক্ষিত বাংলার আপামর জনতা। এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে মোঃ শামসুজ্জোহা ইন্ডিয়ার তুরা থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে উইং কমান্ডার হয়ে তিনটি কোম্পানীকে সাথে নিয়ে বাঘমারা হয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং ১১ নম্বর সেক্টরে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। এই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল তাহের এবং নেত্রকোণা অঞ্চলের যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন মুরারী ও ক্যাপ্টেন চৌহান।     মোঃ শামসুজ্জোহা যুদ্ধ করেছিলেন ক্যাপ্টেন মুরারী’র অধীনে । যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি এস. এম. জি. (শর্ট মেশিন গান) চালাতেন। দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলা শত্রুমুক্ত করার পেছনে উনার অবদান অনস্বীকার্য। দুর্গাপুর থেকে যুদ্ধ শুরু করে শত্রুমুক্ত করতে করতে এগিয়ে যান ময়মনসিংহের দিকে।

তিনি প্রতিদিন স্বপ্ন দেখতেন এক স্বাধীন ভুখন্ডের, এক সোনার বাংলার। আর স্বপ্নের সিঁড়িতে ভর করে যাঁর পথচলা, সে তো হার না মানা গল্প দিয়েই ছিনিয়ে আনেন বিজয়মাল্য। তাইতো তিনি ফিরেছিলেন বিজয়ীর বেশেই। ময়মনসিংহ  শত্রুমুক্ত করে ১৯৭১ সালে ১২ ডিসেম্বরে  তিনি ফিরে আসেন তাঁর নিজের এলাকা নেত্রকোণায়। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে  সেই বিজয়ই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন, সবচেয়ে বড় আনন্দ। এখানে উল্লেখ্য যে, মহেষখলাতে আওয়ামীলীগের অত্যন্ত সৎ ও নির্ভীক কর্মী,নেত্রকোনা মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ও  মহেষখলা ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য(ছাত্র ও যুবনেতাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত), জেলা শ্রমিকলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নেত্রকোনা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান উদ্যেক্তা এবং জেলা আওয়ামীলীগের শ্রম ও কৃষিবিষয়ক সম্পাদক’৭১ জনাব মেহের আলীকে ব্যাংক লুটের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৭ই মে সেকান্দর নুরীর লোকেরা হত্যা করে (ষাটের দশকে ছাত্রদের পর শ্রমিক ও কৃষক গোষ্ঠী সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল।

এই দুটি গোষ্ঠী নেত্রকোনায় স্বাধীকার আন্দোলন,সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুর“ত্ত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে)। মুক্তিযুদ্ধের খরচ ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে জাতীয় প্রয়োজনে জয়বাংলা বাহিনীর প্রধান কোম্পানী কমান্ডার সাবেক আওয়ামীলীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মো: শামসুজ্জোহার নেতৃত্তে বীরমুক্তিযোদ্ধা  বুলবুল ইপিআর সদস্যসহ অন্যান্যদরকে নিয়ে পুলিশের অস্ত্রাগার ও ব্যাংক লুট করেন (“মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা” বইটিতে  সাবসেক্টর কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা  হায়দার জাহান চৌধুরী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন)।

এই ঘটনার সাথে শহীদ মেহের আলীর বিন্দুমাত্র সমৃক্ততা ছিলনা । অথচ নিরপরাদ মানুষটিকে হত্যা করা হলো। মেহের আলীকে হত্যার পরপরই বীরমুক্তিযোদ্ধা মো: শামসুজ্জোহা ও সাবেক আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলামকেও গ্রেফতার করা হয় হত্যার জন্যে। সৌভাগ্যক্রমে তারা প্রাণে বেচে যান। এই স্মৃতিটা আজো তাঁর অন্তরকে ব্যথিত করে। স্বাধীনতার পরপরই  নেত্রকোনার বীরমুক্তিযোদ্ধারা মেহের আলীর হতাকারীদের ব্রাস ফায়ার করে হত্যা করে। এই বিষয়টির বর্ণনা জনাব খালেক চৌধুরী তাঁর অমর গ্রন্থ’ শতাব্দীর দুই দিগন্ত ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক  বীরমুক্তিযোদ্ধা গোলাম এরশাদুর রহমানের মুক্তিসংগ্রাম বইয়ে উল্লেখ আছে। বর্ণনাটি নিম্নে তুলে ধরা হলো-

“স্বাধীনতার অব্যাবহতি পর মোক্তার পাড়ার মাঠে বীরমুক্তিযোদ্ধা ও সংগ্রামী জনতার সমাবেশে বীরমুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের কাছে নিখুজ মেহের আলীর সন্ধান চান এবং প্রিয় নেতাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বলেন।যদি ফিরিয়ে দেয়া না হয় তবে তারা নিজেরাই এর বিচার করবেন। সভাতেই ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ তথা গোলাম এরশাদুর রহমান,হায়দার জাহান চৌধুরী, আশরাফ আলী খান খসর প্রমুখ বীরমুক্তিযোদ্ধারা অফিসিয়ালি জানতে পারেন যে, জনাব মেহের আলী মহেষখলা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন কালে ১৭ ই মে ১৯৭১ সালে আততায়ীর গুলিতে শহীদ হয়েছেন।এই সংবাদ শোনার পর পরই বীরমুক্তিযোদ্ধারা  বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং ঐ সভাতেই  সিদ্ধাšত হয় হত্যার বিচার করার। ঐ সভা থেকেই ৫০ জন বীরমুক্তিযোদ্ধার একটি দল হত্যাকারীর সন্ধানে বেড়িয়ে যায় এবং হত্যাকারীকে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। এর মাধ্যমে বীরমুক্তিযোদ্ধারা  নেত্রকোনার মাটিকে তাদের প্রিয় নেতার রক্তে কলংকিত হওয়ার হাত হতে রক্ষা করেন।

ষাট এর দশকের তরুণ ছাত্রসমাজের প্রাণের নেতা মোঃ শামসুজ্জোহা এই প্রজন্মের তরুণদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলতে চান। কথায় আছে- স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। বঙ্গবন্ধু ও সকল মুক্তিযোদ্ধার অর্জিত এই স্বাধীনতা এযুগের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম ও ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার সঠিক ম‚ল্যায়ণ ও রক্ষা করার দায়িত্ব আজকের তরুণ প্রজন্মের হাতে। তরুণরা মননে ধারণ করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সোনার মানুষ হয়ে গড়বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। এই আশাতেই বুক বাঁধেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এক সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শামসুজ্জোহা।

তিনি লাল-সবুজের পতাকায় মুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যৌবনেই। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। যৌবনের সোনালি দিনগুলো বিলিয়ে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর মতো অনেকের আত্মদানে আমরা আজ স্বাধীন দেশ, মুক্ত চিন্তা আর নিজস্ব পতাকা পেয়েছি। স্বাধীনতার পর দেশের জন্য অনেকেই অনেক কিছু অর্জন করেছে কিন্ত‘ বিসর্জন দিয়েছেন একমাত্র শামসুজ্জোহার মত মুক্তিযোদ্ধারাই। আজ এই প্রৌঢ়ত্বে এসেও মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের স্মৃতি প্রায় প্রায়ই ভেসে ওঠে। আজো যখন একাকি সময় কাটান তখন বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে নিজের মনের অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করে চলেন নীরবে নিভৃতে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে লক্ষ-কোটি শব্দে এবং অন্তরের অন্তস্থল থেকে অসীম ব্যাপকতায় শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। কারণ স্রষ্টা উনার অন্তরকে করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধমুখী এবং দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ। তাই আজ তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আর সেই চেতনা আমৃত্যু ধারণ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে হয়েছেন এক জীবনভর মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তাঁর দীর্ঘায়ু ও সুস্থ’ জীবন কামনা করি।

লেখক: প্রিয়ঙ্কর বিশ্বাস তন্ময়

আরও পড়ুন……
ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি ও ৭১’- র মুক্তিযুদ্ধ : বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী