মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক:বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফায়েত আহম্মেদ খান
নেত্রকোণা কোম্পানীর অধিনায়ক ছিলেন সাফায়েত আহম্মদ খান
নেজা ডেস্ক :
মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফায়েত আহম্মেদ খান। তিনি ছিলেন একাধারে সামাজিক , সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক । একজন সফল কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কথা জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে।
জন্ম : ১৯৪৭ সালের ২৪ জানুয়ারি মাসে জনাব খান নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার জল্লী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম লুৎফে আলী খান ও মাতা মোছাঃ লতিফেন্নেছা। সহধর্মিনী মোছাঃ আয়শা সিদ্দিকুন্নেছা একজন ধর্মপ্রাণ সুগৃহিণী। ৪ কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক তিনি। এক সন্তান স্বনামধন্য এডভোকেট ।
শিক্ষা জীবন: জনাব খান কিশোরগঞ্জের শিমুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক ও নেত্রকোণা আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৯ সালে বিএ পাশ করেন। অতঃপর ১৯৭২ সালে এলএলবি পাস করেন এবং নেত্রকোণা বারে আইন পেশায় যোগ দেন।
রাজনৈতিক ও কর্মজীবন: বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট সাফায়েত আহম্মেদ খান পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ননী গোপল সরকারের প্রবন্ধ “স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী” থেকে জানা যায়,২০০৫ সালের ১৯ মে, শহীদ মেহের আলী স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে নেত্রকোণা প্রেসক্লাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: শামছুজ্জোহার সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কোম্পানী কমান্ডার সাফায়েত আহমেদ খান তাঁর বক্তব্যে, নেত্রকোণায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্ততি লগ্নে শহীদ মেহের আলীর নিপুণ সাংগঠনিক দক্ষতা ও ভুমিকার কথা উল্লেখ করেন।
বস্তত: নেত্রকোণায় ছাত্রলীগ, আওয়ামীলীগ এবং শ্রমিকলীগের রাজনীতির ইতিহাসে শহীদ মেহের আলী ছিলেন এক প্রবাদ প্রতীম প্রাণপুরুষ ।তিনি অন্য একটি ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন,ষাটের দশকের শুরুতে কোন একদিন ঢাকা থেকে সর্বদলীয় নেতাদের একটি দল নেত্রকোনাতে আসেন। সেই দলে কমিউনিসট্ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনি সিং,আব্দুল মমিন ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ছিলেন । আয়ুবের সামরিক শাসন ও মুসলিমলীগের নেতাদের ভয়ে কেউ কারো বাসায় কেন্দ্রীয়নেতাদের নিয়ে সভা করতে রাজি হচ্ছিলেন না। তখন মেহের আলী ভাই মালনী রোডের তাদের পাটের গুদামে সভাটি করার প্রস্তাব করেন। সেই সভায় ফজলুল কাদের,আব্দুল মজিদ তারা মিয়া,আব্বাস আলী খান, মেহের ভাই, সাদির উদ্দীন আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। মেহের ভাই কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নীতি নির্ধারণী সভা করছিলেন। আর আমরা দরজায় দাড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছিলাম। আমাদের তখন ভেতরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। অন্যকে সম্মান দিলে নিজের সম্মান বাড়ে। মেহের ভাইকে সম্মান দিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের সম্মান বাড়বে বৈ কমবে না।
জনাব খান ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নেত্রকোণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরবর্তীতে শ্রমিকলীগ ও আওয়ামীলীগে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৮ সালে নেত্রকোণা কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন।
১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে জনাব সাফায়েত আহম্মেদ খান আবারো কারারুদ্ধ হন। ১৯৭২ সালে জনাব সাফায়েত আহম্মেদ খান নেত্রকোণা মহকুমা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। ফলে তাঁকে দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয়। আবার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরও তিনি দীর্ঘদিন কারাবরণ করেন।
জনপ্রতিনিধি : ১৯৮৫ সালে এডভোকেট সাফায়েত আহম্মেদ খান কেন্দুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক : তিনি নেত্রকোণা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে দীর্ঘদিন সভাপতি তথা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমীর আজীবন সদস্য, নেত্রকোণা জেলা সাধারণ গ্রন্থাগারের তিনি আজীবন সদস্য এবং নেত্রকোণা জেলা রেডক্রিসেন্ট ইউনিটের আজীবন সদস্য ছিলেন। নেত্রকোণা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ও নেত্রকোণা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ:
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট নেত্রকোণা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিমুযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী তার “মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা” বইতে লিখেছেন, “নেত্রকোণা কোম্পানীর অধিনায়ক ছিলেন সাফায়েত আহম্মদ খান। জেট ফোর্সের ব্রিগেড ইনচার্জ কর্ণেল অলির নেতৃত্বে নেত্রকোণা কোম্পানীর প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করে। সেক্টর ইন কমান্ড ছিলেন আবুল হোসেন এবং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আশরাফ উদ্দিন খান ও আবুল কাশেম। কোম্পানীর মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১৩০ জন। নেত্রকোণা কোম্পানীর আরো কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার মধ্যে মোহনগঞ্জের আনোয়ার হোসেন, সামছুল হক মাহবুব, নেত্রকোণার নাগড়ার নোয়াফিজ উদ্দিন ভূঞা উকিল সাহেবের পুত্র আনোয়ার হোসেন ভূঞা, আটপাড়া থানার শ্রীরামপাশার রফিক চেয়ারম্যান, দেওশ্রীর কুতুব উদ্দিন, আটপাড়ার আব্দুর রশিদ ফকির, তেলিগাতীর আঃ হামিদ ও মোজাম্মেল হক, মোহনগঞ্জ থানার নলজুরি পাবই গ্রামের ইদ্রিস মিয়া নেত্রকোণা মসজিদ কোয়ার্টারের আবুল কালাম অন্যতম। এই কোম্পনী দীর্ঘদিন ধানুয়া কামালপুর অংঞ্চলের যুদ্ধে অংশ নেন। তখন কোম্পানী টু-আই-সি আবুর হোসেনের ছোট ভাই কাজল শহীদ হয় এবং আটপাড়ার দেওশ্রী গ্রামের মোফাজ্জল হোসেন ধর্মপাশা যুদ্ধে শহীদ হন। কামালপুর যুদ্ধে মেডিকেল কোরের দায়িত্ব পালন করেন আটপাড়ার মোসলেম উদ্দিন আহমেদ( সেনা বাহিনী সদস্য)। কামালপুর যুদ্ধে আটপাড়ার দেওশ্রী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলালজ্জামান পান্না বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ক্যাপ্টেন আঃ হামিদ (মতিয়র রহমান) এর নেতৃত্বে এই কোম্পানী পরবর্তীতে ধর্মপাশা থানা আক্রমণে অংশগ্রহণ করে ।“
বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফায়েত আহম্মেদ খান শেষ জীবনে ধর্মীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বাঘড়া ফাজিল মাদ্রাসা এবং রাজঘাট ফাজিল মাদ্রাসার সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি নেত্রকোণা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের আজীবন সদস্য ছিলেন। ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট তিনি মৃত্যু বরন করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাজ গঠনে তার অবদান জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
পুরষ্কার ও সম্মানণাঃ
ষাটের দশকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য “Bangladesh Muktijudho Research Institute Silver Award-2023” সম্মাননা প্রদানের জন্যে মনোনীত করা হয়।
লেখকঃ আহমেদ সমিরুদ্দীন. ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, প্রাবন্ধিক
[প্রখ্যাত সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক,প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ননী গোপল সরকারের প্রবন্ধ অগ্নিযুগের সূর্যসৈনিক : বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মেহের আলী, মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ সংগঠক : ডা: আখলাকুল হোসাইন আহমেদ, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী , প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট সাবসেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিমুযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা, মুক্তিযুদ্ধে মুজিববাহিনী, হায়দার জাহান চৌধুরীর প্রবন্ধ “শহীদ মেহের আলী একটি নাম, একটি ইতিহাস “, “ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি ও ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ , মহেষখলা ক্যাম্প, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক খালেকদাদ চৌধুরী ও মেহের আলী প্রসঙ্গ ,নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধু, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক,প্রাবন্ধিক সাবসেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিমুযোদ্ধা গোলাম এরশাদুর রহমানের মুক্তিসংগ্রামে নেত্রকোণা, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসানের গ্রন্থ “ মুক্তিযুদ্ধে মোহনগন্জ-মহেষখলা ক্যাম্প ও ডাঃ আকলাখ হোসেন আহমদ “, ভাষা সংগ্রামের জন্যে রাষ্ট্রিকিট হওয়া মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দীন আহমেদ সাহেবের প্রবন্ধ “,অসমাপ্ত গল্প” , প্রখ্যাত সাংবাদিক কুন্তল বিশ্বাসের প্রবন্ধ “ নেত্রকোণায় ভাষা আন্দোলন”-ভাষা সংগ্রামে নেত্রকোণা ২০০৮ স্মারকগ্রন্থ, ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দীন আহমেদ সাহেবের প্রবন্ধ “একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলো”-আমাদের ময়মনসিংহ, জাতীয় সাহিত্যিক একুশে পদক প্রাপ্ত প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক সানাউল্লাহ নূরী সাহেবের বিবৃতি “ নেত্রকোণায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মেহের আলীর স্মরণসভায় সানাউল্লাহ নূরী- ২৬-০৬-১৯৯৪ দিনকাল, বাধন খান পাঠান ববির(ববিতা) প্রবন্ধ ”মুক্তিযোদ্ধা আয়েশা খানম : বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারীনেত্রী” ,বিভিন্ন জাতীয় ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎাকার, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার, স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎাকার, বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা,টিভি সংবাদ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও,অডিও ও মেহের আলীর ডায়েরী অবলম্বনে লেখা হয়েছে।]