সমঝোতায় সংসার, সুখে থাকে পরিবার
নেজা ডেস্ক :
মানুষ সামাজিক জীব সংসার তাহার জীবনের আশ্রয় বা ঠিকানা। সং শব্দের অর্থ রঙঢঙ এবং সার শব্দের অর্থ আসল, মানুষের জীবন ধারণের রঙঢঙ এর আসল ঠিকানা হয়েছে সংসার। সংসার শুরু হয় বা সৃষ্টি হয় স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বন্ধনে এবং পরিচালিত হয় প্রীতি-প্রণয়ে।
প্রত্যেক ধর্মের বিধানে নির্ধারিত আছে, বিবাহের পবিত্র বন্ধনে স্বামী-স্ত্রীর দৈহিক সম্পর্কে গড়ে ওঠে পরিবার। স্বামী -স্ত্রী একে অপরের চিরসঙ্গী, একে অপরের সহধর্মিণী। সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকবে, পূরণ করবে সাধ্যমত একে অপরের আর্থিক ও দৈহিক সহ যাবতীয় চাহিদা।
সংসার জীবনের সুখের চাবিকাঠি সমঝোতা। সৌহার্দপূর্ণ বা মিত্রভাবাপন্ন রুচিসম্মত সংযত ব্যবহারই সমঝোতা । যে পরিবারে সমঝোতা আছে সেই সংসারে আছে অনাবিল সুখ শান্তি আর যে পরিবারে সমঝোতার অভাব সেই পরিবারে অশান্তির লেলিহান শিখা প্রজ্জ্বলিত।
দোষে-গুনে মানুষ, কোন মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়, মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে এটাই স্বাভাবিক তাই সংসার জীবনের প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন সমঝোতা। স্বামী-স্ত্রী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে গড়ে তুলে সমৃদ্ধ পরিবার, একের পক্ষে সম্ভব না সুখী সমৃদ্ধ সংসার গড়ে তুলা। দুজনের প্রচেষ্টার ফলে যত সহজে সংসার সমৃদ্ধির লক্ষে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, একার পক্ষে তাহা কখনো সম্ভব হয় না।
কবির ভাষায়-
পান খেতে স্বাদ লাগে না স্বাদ লাগে তার চুনে,
সুন্দরে তার মন ভরে না মন ভরে তার গুণে।
তদ্রূপ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেই স্বামী-স্ত্রীর সংসার মধুময় হয় না যদি না থাকে প্রীতি-প্রণয়। প্রীতি-প্রণয়ের মধুরতা সৃষ্টির মূল চাবিকাঠি হলো সমঝোতা। সমঝোতার অভাবে অনেক সংসার অশান্তির আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার আবার কিছু সংসার সমঝোতার অভাবে অকালেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কথা-বার্তা, আচার-আচরণ ও চলাফেরায় হতে হয় সংযমী আর এ সংযমের আভিধানিক বা পরিভাষিক শব্দের নাম সমঝোতা।
পরিবার সমৃদ্ধি লাভ করলে সমৃদ্ধ হবে ক্রমান্নয়ে পাড়া, মহল্লা এভাবে পুরো দেশ। একটি দেশের উন্নয়নের ভিত্তিপ্রস্তর হচ্ছে পরিবার, ভিত্তিপ্রস্তর যত মজবুত হবে তত বেশি ঠিকে থাকবে প্রতিষ্ঠান তাই দেশের কল্যাণে পরিবার কে গুরুত্ব দেওয়া খুবই প্রয়োজন আর সেই কারণে পরিবারে প্রয়োজন সমঝোতা।
সমঝোতায় গড়ে ওঠে পরিবারে সু-সম্পর্ক। একে অপরের সাথে সু-সম্পর্কে পরিবার হয় আর্থিক ও মানবিক সমৃদ্ধ। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের হতে হবে সংযমী, সংযমি শিক্ষা লাভ করে নিজ পরিবার থেকে। মা-বাবার দৃষ্টি-ভঙ্গি অনুসরণ করে সন্তান তাই মা-বাবা কে খেয়াল করে সংসার পরিচালনা করতে হয় যেন নিজের অসাবধানতার কারণে সন্তান কুপথে না যায় বিপদগামি না হয়।
কিছু অসাধু ব্যাক্তি মানসিক বিকারগ্রস্ত তার দৃষ্টি-ভঙ্গি সংযত রাখতে ব্যর্থ হয় তাই সংসারে নেমে আসে অশান্তি, লেগে থাকে সংসারে ঝগড়া বিবাদ। নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে নিজের জীবন সঙ্গীকে তাঁর সমপক্ষ বা যোগ্য মনে করে না, চলে যায় বিপথে বেচে নেয় অসৎ পথ। হয়তো তাদের ধারণা তাহার সঙ্গীর চেয়ে অন্যজন আরও আকর্ষণীয় কিন্তু এসব ধারণা বা ভাবনা ভিত্তিহীন কারণ একজন ব্যক্তির সাথে আরেক জন ব্যক্তির পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
গাছের পাতা দেখতে সবুজ তারপরেও বৈশিষ্ট্য গত দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় ভিন্ন তেমন মানুষের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা আছে থাকবে। একেকজন মানুষ একেক গুণের অধিকারী তাই ভালোবাসার দৃষ্টিতে খেয়াল করলে দেখা যায় নিজের কাছের মানুষ টি অতি প্রিয় ও আপন জন। এ কথাটি সময় থাকতে বুঝতে হয় সময় গেলে অসময়ে বুঝলে পরিণতি খারাপ হয় বিনে ভালো হয়না।
একজন ব্যক্তি তাহার স্ত্রীর অজান্তে আরেক নারীর সাথে রঙঢঙে লিপ্ত হয় কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর তাহার স্ত্রী জানিতে পেয়ে স্বামীকে ইশারা ইঙ্গিতে কিছুটা শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে সকালে ওঠে রান্নার কাজ শেষ করে আদর-সোহাগে তাহার স্বামীকে খেতে দেয় কিন্তু তাঁর সামনে সু-স্বাদু একটি তরকারি ভিন্ন কালারের কয়েকটি পাত্রে পরিবেশন করে রাখল। স্বামী খেতে গিয়ে এক পাত্রের তরকারি শেষ হলে অন্য পাত্রের তরকারি থালায় নিয়ে খায় আর ভাবে একই তরকারি আজ ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে কেন ? মনে তাহার অবিরত প্রশ্ন, খাবার শেষে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ” ওগো ” একটি কথা জানতে চাই, আজ একই তরকারি ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে রাখলে কেন ? স্বামীর প্রশ্নের জবাবে স্ত্রী মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, তরকারি এক হলেও একেক পাত্রের একেক গুণ আছে আর সেই গুণ খাদ্যের রুচি বৃদ্ধিতে সহায়ক তাই আপনার রুচি সম্মত যে পাত্র সে পাত্রের তরকারি খাওয়ার জন্যে এভাবে রাখলাম।স্বামী খুবই চিন্তিত হলেন এবং মনে মনে ভাবতে লাগলেন তাঁর কু-কর্মের কথা বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনার পর স্ত্রীকে আদর সোহাগে বুকে জড়িয়ে বলিলেন বাদ দাও এসব, ভালোর ভালো এক পাত্রই যথেষ্ট-
একই জিনিস ভিন্ন পাত্র,
খেয়েদেয়ে বুঝলাম মাত্র।
এমন ভুল যেন কেউ না করে,
সবচেয়ে মজা নিজের ঘরে।
কিছু স্ত্রী লোকের মাঝেও এমন মনোভাব থাকে অসময়ে নিজের ভুল বুঝতে পারে যখন সংসারে নেমে আসে অশান্তি। তাই অভয়ের মাঝে প্রয়োজন সমঝোতার মনোভাব।
এমন অসৎ ভাব স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের মাঝেই লক্ষ করা যায়, এর জন্যে দায়ী মানসিক দৃষ্টি-ভঙ্গি এর বেশি কিছু না। নিজের মন ও দৃষ্টি সংযত থাকলে এমনটা হয় না।
চলাফেরায় অনেক পরিবারে দ্বিমত পোষণ করে, একজনের পছন্দের বিষয় আরেক জনের অপছন্দ, এটা কোন মতে কাম্য নয়। দ্বিমত পোষণ করা মানেই সংসারে অশান্তি ডেকে আনা। অনেক স্ত্রী চায় স্বামীর সাধ্যের বাহিরেও খরচ করতে, উন্নত পরিবারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এটা একে বারেই বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয় এমন চলাফেরা বাদ দিয়ে নিজের সাধ্যমতো চলাফেরা করতে হবে। আয় বুঝে ব্যয় করা বুদ্ধিমানের কাজ, অপচয়কারি শয়তানের সমতুল্য। কিছু স্বামীও আছে অধিক খরচ করে এটাও ভালো নয় সংসারের কল্যাণের জন্যে উভয়েই চলাফেরায় সমঝোতায় খেয়ালি হতে হয়।
আচার-আচরণের দিক থেকেও সমঝোতা প্রয়োজন। একে অপরের সাথে এমন ব্যবহার করতে হবে যেন একজনের ব্যবহারে আরেকজন বিরক্ত না হয়ে সন্তুষ্ট হয়। সুন্দর ব্যবহার সু-সম্পর্ক বৃদ্ধি করে আর অসামাজিক ব্যবহার অশান্তির জন্ম দেয়, পরিবারে ডেকে আনে অশান্তি। যদিও কোন সময় পরিবারের কেউ দুষ্টামি করে তাকে পাল্টা জবাব না দিয়ে তাঁর প্রতি সংযমি হয়ে সমঝোতায় সুন্দর ব্যবহার করিলে সে পরবর্তীতে এমন ব্যবহার করবে না সে নিজ থেকে অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে নিজে সংশোধন করবে। কথায় আছে – ব্যবহার বংশের পরিচয়। একজনের ব্যবহারে প্রকাশিত হয় তাহার বংশ পরিচয়, সে কেমন, কেমন তাহার বংশ মমর্যাদা। কে কেমন আচরণ করলো সেটা দেখার বিষয় না, দেখার বিষয় হলো আমি মানুষের সাথে কেমন আচরণ করতে সক্ষম হয়েছি পরবর্তীতে যেন আরও ভালো ব্যবহার করিতে পারি এটাই একজন আদর্শ ব্যক্তির উদ্যেশ্য হওয়া একান্ত প্রয়োজন। আমার ব্যবহারে যদি মানুষ খুশি হয় বেজার না হয়ে সন্তুষ্ট থাকে তাহলেই আমার সার্থকতা। একজন খারাপ আচার ব্যবহার করিলে তার ব্যবহারের দায়ভার তাকেই নিতে হয়। মানুষের ব্যবহার যদি পশুর মত হয় তাহলে মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার কি এমন সার্থকতা ? তাই জীবন চলার পথে সমঝোতা একান্ত প্রয়োজন।
কথায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে, মানুষের বেশির ভাগ মনের ভাব প্রকাশ পায় কথাবার্তায় তাই কথাবার্তায় সমঝোতা প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। কথায় মানুষ খুশি হয় আবার কথার আঘাতে ব্যথায় জর্জরিত হয় মানুষের মন। শ্রুতিমধুর কথায় মানুষ ভালোবাসায় আকৃষ্ট হয়। প্রবাদে আছে – “বোবার শত্রু নেই।” বোবার শত্রু না থাকার কারণ সে কথা বলতে পারে না তাই তাহার কাছ থেকে কেউ কথার আঘাত পায় না, যে কারণে তাহার শত্রু তুলানায় অনেক কম।
কবির ভাষায়-
সুন্দর ব্যবহারে পর হয় আপন,
খারাপ ব্যবহারে দূরে যায় প্রিয়জন।
সুমিষ্ট কথায় মন গলে মোমের মত,
রুক্ষ কথায় মন হয় ক্ষত-বিক্ষত।
পরিবারের কর্তৃপক্ষ যদি সমঝোতা রক্ষা করে চলে তাহলে নতুন প্রজন্ম তাহা খেয়াল করে শিখে, পরবর্তীতে তাহারাও সমঝোতার ভিত্তিতে জীবন পরিচালিত করে। প্রথম যারা স্বামী-স্ত্রী পরবর্তীতে তারাই হন মা-বাবা, তাদের সন্তানের কর্তৃপক্ষ।
নিজের স্বার্থ ত্যাগ দিয়ে কিছু করাই সমঝোতা। কিছু কিছু পরিবারের ব্যবহার দেখে মন বিষাক্ত হয়ে যায় আর কিছু কিছু পরিবারের ব্যবহার দেখলে মন আনন্দিত হয়, লোভনীয় ব্যবহার। কাউকে কঠোর ভাবে কথা না বলে বিনয়ী ভাবে কথা বলাই হলো শিষ্টাচার। কাউকে শাসন হিসেবে কথা না বলে বিনয়ী হিসেবে কথা বলা প্রয়োজন। বিনয়ী কথা সবাই গ্রহণ করিতে সেচ্ছায় বাধ্য থাকে আর কঠিন ও কঠোর কথা কেউ গ্রহণ করিতে রাজি হয় না। কিছু কিছু দম্পতির ব্যবহার অতিষ্ঠ লাগে, চালচলন দেখলে সংসার জীবন ঘৃণা লাগে, মন চায় সংসার জীবন পরিহার করি আবার কিছু কিছু দম্পতির মধুময় ব্যবহার দেখে লোভ লাগে, লোভনীয় মনে হয়। মন চায় মন ভরে উপভোগ করি তাদের প্রীতি ব্যবহার। সাধ জাগে এমন সংসার জীবন গড়ে তোলার।
লেখক পরিচিতি-
মাজেদুল হক, পূর্ণ নাম – শেখ মোহাম্মদ মাজেদুল হক ওরফে মাজেদ, সাহিত্যাঙ্গণে সু-পরিচিত নাম- মাজেদুল হক, “বিরহী কবি” হিসেবে সমধিক খ্যাত ও সমাদৃত।
প্রকাশিত গ্রন্থ – ১। চোখের জলে নদী ২। কাব্য বলাকা ৩। স্বপ্ন দিগন্ত ৪। ফুল ঝুড়ি ৫। স্বদেশের মায়া ৬। নেত্র চয়ন।