স্কুল পালানো রোধে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২-এর ভূমিকা; এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে করণীয়
আল মামুনঃ
মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৮ম, ৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে উঠলেই স্কুল পালানো এ যেন একটি সাধারণ প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন ক্লাস করতে হবে না এবং ক্লাসে গেলেও ১/২ টা ক্লাস করেই যেভাবে হোক পালাতে হবে, এমন একটা ট্রেন্ড যেনো কাজ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
স্কুল পালানো রোধ করার জন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের পালানোর রাস্তাগুলো বন্ধ করাসহ আরো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও কোন কাজ হচ্ছে না। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চলে ডালে ডালে আর শিক্ষার্থীরা চলে পাতায় পাতায় এ রকম অবস্থা। এ অবস্থার অবসানে নতুন শিক্ষাক্রম ২০২২ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশা রাখি।
এই শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়ন থাকায় শিক্ষার্থীরা স্কুল পালানোর কথা চিন্তাও করবে না। শিখনকালীন মূল্যায়ন হয় জোড়ায়, দলীয় ও একক কাজের ভিত্তিতে। ফলে দুর্বল-সবল শিক্ষার্থীরা মিলেমিশে তাদের পাঠের বিষয়টি পারস্পরিক আলোচনা মাধ্যমে হাতে কলমে আশ্বস্থ করে থাকে। এতে করে মোটামুটি আনন্দঘন পরিবেশে তাদের পাঠের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। আর স্কুল পালানোর মূল কারণ হলো ঐ সময়ে প্রাইভেট, কোচিং এ অংশগ্রহণ করা। কিন্তু প্রাইভেট, কোচিংগুলোতে স্বল্প পরিসরে পর্যাপ্ত সময়, উপকরণ দিয়ে শিখন শেখানো কার্যক্রম সম্পন্ন করা কঠিন আর পারলেও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকার কারণে শিখনকালীন মূল্যায়নে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে শিক্ষকদের। আগের শিক্ষাক্রমের পাঠ্যসূচীতে যে বইগুলো ছিল সেগুলো নিজে বা প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে শেখা সম্ভব ছিল। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধাসমৃদ্ধ ক্লাসরুম ও উপকরণ ছাড়া পাঠের বিষয়টি সকল শিক্ষার্থীদের কাছে বোধগম্য করা খুবই কঠিন। এজন্য শিক্ষকদেরকেই প্রতিটি ক্লাসের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি, শিখনকালীন মূল্যায়ন যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে।
আমাদের সম্পদ সীমিত আর অভাব অসীম। এই দেশে শিক্ষক সংকট, উপকরণ সংকট, ক্লাসরুমের সংকট, পাঠের বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবেশের সমন্বয় করা সবকিছুই চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জগুলোকে শিক্ষকদেরকেই কৌশলে মোকাবেলা করতে হবে। Slow Learner/Advance Learner চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং তাদের শিখন পরিস্থিতি উন্নয়নে কার্যকর কৌশল প্রয়োগ; মূল্যায়নের মূলনীতি অনুসরনপূর্বক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন যোগ্যতার মূল্যায়ন নিশ্চিতকরণ ও মূল্যায়নের ধারাবাহিক রেকর্ড সংরক্ষণ; শিক্ষার্থীদের দলগত কাজসহ সামগ্রিক মূল্যায়নে নিরপেক্ষতা, সততা এবং নৈতিকতা বজায় রাখা; শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিখন পরিবেশ তৈরি করতে শিক্ষককে মূলত Facilitator এর ভূমিকা পালন করা ইত্যাদি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের করনীয় হলো- নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া এবং শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা; সঠিক সময়ে পড়াশুনা করা, খাওয়া, ঘুমানো এবং মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলায় অংশ নেয়া; এনসিটিবি কর্তৃক প্রণীত পাঠ্যপুস্তক ও সম্পূরক পঠন সামগ্রী পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা; নতুনকে গ্রহণ করার উপযুক্ত মানসিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করা; শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে Activity based learning কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করা; বিদ্যালয় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে শ্রেণি শিক্ষকের সাথে আলাপ আলোচনা করা; শিখন সংশ্লিষ্ট যে কোনো বিষয় নিয়ে অভিভাবকের সাথে কথা বলে পরামর্শ গ্রহণ করা; নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শিখনের সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করা; দলগত কাজে সহপাঠীদের মূল্যায়নে নিরপেক্ষতা, সততা এবং নৈতিকতা বজায় রাখা; স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য গঠিত ক্লাবসমুহের মধ্যে অন্তত ২/৩ টি ক্লাবে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা ইত্যাদি ।
নতুন এই শিক্ষা পদ্ধতি সফল করতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। যেমন- সন্তানদের/শিক্ষার্থীদেরকে নিজের এবং বাড়ির ছোট ছোট কাজগুলো করানোর বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা; সন্তানদের/শিক্ষার্থীদের সময় দেওয়া, তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা;
সন্তানদেরকে/শিক্ষার্থীদেরকে ভালো কাজে উৎসাহ দেওয়া এবং ভুল/অপ্রয়োজনীয় কাজকে নিরুৎসাহিত করা; কারিকুলাম বিস্তরণে অভিভাবকদের যে দায়িত্ব তা সঠিকভাবে পালন করা; সন্তানদের/শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা; সন্তানদের/শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিষয়ে নিরপেক্ষতা, সততা এবং নৈতিকতা বজায় রাখা ইত্যাদি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও ভূমিকা রাখতে হবে। মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রমকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা, ক্লাসরুমে হাতে কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০/৩৫ নিয়ে আসা; একজন শিক্ষকের জন্য প্রতিদিন ক্লাস সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩ টির বেশি যাতে না হয়; আর শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরত্বের সাথে ভাবা। মাঠ পর্যায়ের আঞ্চলিক পর্যায়ের শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার, প্রধান শিক্ষক, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারগণ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে যথাযথ মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা; নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে সবল ও দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করে কার্যকর কৌশল ও নীতি নির্ধারণে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করানো; স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করা; প্রশিক্ষণ বাস্তবায়নের সকল পর্যায় মনিটরিং করা ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে প্রতিবেদন প্রেরণ করা ইত্যাদি ।
পরিশেষে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট নাগরিক তৈরি করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখকঃ
সহকারী শিক্ষক
আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নেত্রকোণা।