স্বাধীনতাযুদ্ধে নেত্রকোণা মুক্তির নায়ক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিক আহমদ
জাসদের হঠকারী রাজনীতির বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়ে প্রগতির চাকাকে সামনে রাখার প্রত্যয়ে সাহসী ভূমিকা রাখেন আবু সিদ্দিক আহমেদরা।
আজ ১৬ই সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে নেত্রকোণা মুক্তির অহংকার নিয়ে যে মানুষটির নাম উচ্চারিত হয় সেই ৪নং টাইগার কোম্পানীর অধিনায়ক আবু সিদ্দিক আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী। দিবসটি উপলক্ষে এই বীর যোদ্ধা সম্পর্কে যতটুকু জানি তাই স্বল্প কথায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
সহযোদ্ধা আবুখা, আব্দুস সাত্তার, আব্দুর রশিদের রক্তে ভেজা মাতৃভূমি নেত্রকোণাকে ৯ই ডিসেম্বর মুক্ত করে বিজয়ের অহংকার নিয়ে যে মানুষটি শীতের কুয়াশাস্নাত সকালে শহরের কৃষি ফার্মের (বর্তমান ডিসি, এসপি অফিস) সারি সারি নারিকেল বাগানে প্রতি বৎসর পদচারনা করতেন (৭৫ পরবর্তি মুক্তিযুদ্ধাদের দুঃসময়ে) মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোণা অধ্যায়ে যার নাম অনন্তকাল চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে তিনি হলেন আলহাজ্ব আবু সিদ্দিক আহমেদ। যিনি টাইগার সিদ্দিক নামেই সমধিক পরিচিত।
এই মানুষটি নেত্রকোণার অত্যন্ত্ পশ্চাদপদ কালিয়ারা গাবরাগাতী ইউনিয়নের নাড়িয়াপাড়া গ্রামের সৈয়দ আহমেদ তালুকদার এবং হরমুজেন্নেছা তালুকদারের ঔরসে ১৯৪০ সনের ১১ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহন করেন।শৈশবে দুষ্টুমীর শীর্ষশিখরে অবস্থান হেতু বন্ধুত্বের পরিসর ছিল বিস্তৃত।সবার বড় হিসাবে ছোটদের প্রতি দৃষ্টি রাখায় নিজের লিখাপড়া খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। তবুও ১৯৬৩সনে বাউসী হাইস্কুল থেকে মেট্রিক এবং নেত্রকোণা মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করেন।মায়াঘেরা আউলা বনের গ্রাম আর কংশের স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটা ছিল তার অভ্যাস। বাবা ছেলের দস্যিপনার জন্য বারবার শাসন করলেও মায়ের এক উত্তর “সিদ্দিক” বিশ্বাসী হয়েই থাকবে।
ষাটের দশকে উত্তালদিনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সঙ্গে,উঠাবসা হয় আব্দুল খালেক, ফজলুর রহমান খান, আব্বাছ আলী খান, গাজীমোস্তফা হোসেন প্রমূখের সঙ্গে।ক্রমেই অসহযোগ আন্দোলনের রনদামামা বেজে উঠলে ১১নং কালিয়ারা গাবরাগাতী থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে নেত্রকোণার জনসভায় শরীক হতেন।
আসলে কালিয়ারা গাবরাগাতী সবসময়ই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি আর এ্টা অনেকটা আবু সিদ্দিক আহমেদের বদেৌলতেই।১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ্চ ঢাকায় ক্রাকডাউন হলে দলেদলে মানুষ শহর ছেড়ে পালাতে থাকে আর সম্ভ্রাব্য রোড নির্ধারিত হয় বরোয়ারী গোদারাঘাট পেরিয়ে কালিয়ারা গাবরাগাতী দিয়ে পাহাড়ে পৌঁছানো।
এই সময়ে আবু সিদ্দিক আহমেদ বন্ধু বাণ্ধব ভাইদের ডেকে নির্দেশ দেন যেকোন মূল্যে মানুষ যেন নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারে।একসময় ১০ই এপ্রিল এলাকার ছেলেদের নিয়ে মেঘালয় প্রদেশের বাঘমারায় গমন করেন অবশ্য উনার সাক্ষাতকারে জানা যায় ইউপির ছেলেদের নিয়ে যখন যুদ্ধে যাবার চিন্তা করছিলেন তখনই একটি চিঠি আসে যুদ্ধে যোগ দেয়ার; চিঠিটা ছিল ফজলুররহমান খান আর আব্বাস আলী খানের স্বাক্ষরে। সেখান থেকে তোড়ায় প্রথম ব্যাচে ট্রেনিং নিয়ে সদলবলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। ইতোমধ্যে হাজার হাজার ছেলে সীমান্ত অতিক্রম করে মেঘালয় রাজ্যের মহেষখলা, মহাদেও, রংড়া, বাঘমারা ইয়ূথ ক্যাম্পে নাম লিখাতে থাকে এবং তোড়া ট্রেনিং সেন্টার থেকে মাসখানেক ট্রেনিং নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানীতে জড়ো হয়।এই কোম্পানী আবার তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল কোম্পানী কমান্ডার নাজমূল হকতারা আর টু আইসি ছিলেন আব্দুল জব্বার (উকিলপাড়া) ।
প্লাটুন তিনটি ভাগ হলে আশরাফ আলীখান খসরু(বর্তমান মন্ত্রী) প্লাটুন কমান্ডর হন কিন্তু অসুস্থতা জনিত কারনে বিশ্রামে থাকলে আবু সিদ্দিক আহমদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তিতে ভারতীয় ক্যাপ্টেন চৌহানের তত্বাবধানে সিদ্দিক- খসরুর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী কোম্পানী হয় যার নাম ৪নং টাইগার কোম্পানী।
এই প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযুদ্ধা আবু আক্কাছ আহমদ বর্ণনা করেছেন নৌকা অত্যন্ত সুন্দরভাবে আষাঢ মাসের পহেলা তারিখ। ট্রেনিংয়ের পর মন উসখুস করছিল অপারেশনের জন্য, আমাদের কমান্ডার নাজমূল হক তারাকে বললাম উনি বললেন তোমাদের কোম্পানীর অধিকাংশ ছেলেই নেত্রকাণার -তাই ডিসিশন নিয়ে অপারেশন তোমাদেরই করতে হবে। আমরা প্লাটুন কমান্ডার খসরু ভাইয়ের অনুপস্থিতে জব্বারভাই এবং সিদ্দিক ভাইয়ের নেতৃত্বে আমার গ্রামের বাড়ী নাড়িয়াপাড়ায় ১০৭জন মুক্তিযুদ্ধা নিয়ে অবস্থান গ্রহন করি।সিদ্ধান্ত ছিল কংশ নদী পাড় হয়ে হানাদারদের আক্রমন করতে যাবো।পাক বাহিনী বোটে করে নদী পাড় হয় কিনা এজন্য গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয়, খবর আসে পাঞ্জাবীরা দালালসহ আসছে- আমরা ব্রাশ দিয়ে নেৌকা ডুবিয়ে দেই। কয়েকজন ডুবন্ত নেৌকা থেকে লাফিয়ে পড়ে, সিদ্দিক ভাই কমান্ড করেন এদের ধরে আনো ।
পরবর্তিতে স্বীয় ভ্রাতা গোলাম মোস্তফা সহ সাতজনকে দিয়ে ধৃত রাজাকারদের মেঘালয়ে পাঠানো হয়।আসলে টাইগার কোম্পানীর কমান্ডার রন কেৌশলের দিক দিয়ে ছিলেন খুবই কেৌশলী। উনার কেৌশলের কাছে পাক হানাদার বাহিনী বারবার পরাস্ত হয়।এই ভাবে,ঠাকোরকোনা ব্রীজ, বাশাটি, ত্রিমোহনী ব্রিজ, জারিয়া, নাজিরপুর দূর্গাপুরসহ অনেক যুদ্ধ পরিচালনা করে হয়ে উঠেছিলেন দূর্ধর্ষ।পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে হানাদার মুক্ত করার মানসে ফকিরেরবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করে অনেকদিন অবস্থান করেন”।
নেত্রকোণা যুব সমিতির সৌজন্যে প্রকাশিত “স্বাধীনতার দীপ্ত শপথ বিজয় দিবস ৯৩সংকলনে” আবু সিদ্দিক আহমেদ এক লেখনীতে নেত্রকোণা মুক্তির অহংকার নিবন্ধে বর্ননা করেছেন এভাবে ‘৭ই ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় মিত্রবাহিনীর সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন চৌহান ম্যাসেঞ্জার মারফত খবর পাঠায় কালিয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা করতে চান। পরদিন ৮ই ডিসেম্বর সকাল ৮ঘটিকায় বাশাটি মাঠে ক্যাপ্টেন চেৌহান আমার সাথে বসে নেত্রকোণা শহর মুক্তির পরিকল্পনা করেন। উক্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী দক্ষিনদিকে নেত্রকোণা -ময়মনসিংহ রাস্তায় এ্যামবুশ গ্রহন করি। কোম্পানীর ছেলেদের নিয়ে নেত্রকোণার পূর্বপাশ দক্ষিন কাটলীর মধ্য দিয়ে রাত ২টায় কৃষি ফার্মে পেৌছে অবস্থান গ্রহন করি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানীর ছেলেরা ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছিলো এমন সময় বেলা ৯টায় শহরের উত্তর দিক থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলার শব্দের সংকেত পাই।আমরা সতর্কতা নিয়ে কৃষি ফার্মের নারিকেল গাছেরনীচে আসতেই দেখি পাক বাহিনী দক্ষিন গোদারাঘাটের পুলের উপর দিয়ে ময়মনসিংহের দিকে চলে যাচ্ছে।এই অবস্থায় আমরা গুলাগুলি শুরু করে শহরের কৃষি ফার্ম থেকে রাস্তার একবারে কাছাকাছি স্থানের (বর্তমান ডিসি- এসপি অফিসের)মাঠে অবস্থান নেই, সকাল বেলা আমি আহত হলে ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে “জয়বাংলা” শ্লোগান দিয়ে অগ্রসর হলে শত্রু সেনাদের ব্রাশ ফায়ারে আবু খা, সাত্তার, আব্দুর রশিদ মারা যান। ঐদিনই ৯ই ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমি নেত্রকোণা স্বাধীন হয়”।
দেশ স্বাধীন হলে আবু সিদ্দিক আহমেদ রাজনীতিতে নিজের নাম সন্নিবেশিত করেন। দেখা দেয় নতুন উপদ্রব, এককালের রনাঙ্গনের সাথীরা সদ্যস্বাধীন দেশে নতুন দল জাসদ গঠন করে।তৈরী হয় গনবাহিনী, সৃষ্টি হয় অস্থিতিশীল অবস্থা। আর তা রোখার দায়িত্ব এসে পড়ে বঙ্গবন্ধুপ্রেমি মুক্তিযুদ্ধাদের উপর। জাসদের হঠকারী রাজনীতির বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়ে প্রগতির চাকাকে সামনে রাখার প্রত্যয়ে সাহসী ভূমিকা রাখেন আবু সিদ্দিক আহমেদরা।
পরবর্তিতে নেত্রকোণা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন এমনকি আবু সিদ্দিক আহমদের আমন্ত্রনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আজকের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা নেৌকা যোগে কালিয়ারা গাবরাগাতী ইউনিয়ন সফর করেন।তিনি ইউপির বারবার চেয়ারম্যান নিাবচিত হন। তার ভাই গোলাম মোস্তফা জেলা মুক্তিযুদ্ধা সংসদের কমান্ডার হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে গেছেন।আর এক ভাই আবু আক্কাছ আহমেদ ঢাকাস্থ নেত্রকোণা সমিতির দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন।অনেক কীর্তির এই বীরপুরূষটি ২০১৬সনের ১৬ই সেপ্টেম্বর প্রিয়জনদের ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেন।বিধাতার কাছে প্রার্থনা উনাকে বেহেস্তবাসী করুন।
(বিঃদ্রঃ-তথ্যগত অসংগতি থাকলে সঠিক তথ্য তুলে ধরলে কৃতজ্ঞ থাকবো)