স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী  (পর্ব-৪)   

বীরমুক্তিযোদ্ধা মেহের আলী মহেষখলা ক্যাম্পের ইয়ুথ, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও রিফিউজি ক্যাম্প পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।  জনাব মেহের আলীর শ্বশুরের পরিবারটি ঐ অঞ্চলের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ধনী হওয়ায় তিনি এই অঞ্চলের ছাত্র যুব সমাজকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্ভুদ্ধ করা, সাময়িকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, নৌকায় পরিবহনের ব্যবস্থা ও মহেষখলা ক্যাম্প পরিচালনার জন্য খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়ে এই অঞ্চলে আসেন

প্রকাশিত: ৩:২১ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩০, ২০২৩
প্রচ্ছদ: অসীম

নেজা ডেস্ক :
গত পর্বের পর থেকে…
ভাষা সংগ্রামের জন্যে রাষ্ট্রিকিট হওয়া বাংগালী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দীন আহমেদ তার প্রবন্ধ “অসমাপ্ত গল্প”তে লিখেছেন-
নেত্রকোনার রাজনীতি সচেতন সাধারন মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদেরা নেত্রকোনায় বাঙালী জাতির স্বাধীকারের  প্রতিটি আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রামে মেহের আলীর অবদান সম্পর্কে কমবেশি জানে। কিন্তু মহেষখলা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিসংগ্রামের পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের ঘটনাগুলো যুদ্ধের কারণে তাৎক্ষনিকভাবে জানতে পারিনি। যুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আব্দুল হেকিম চৌধুরী, জনাব আব্দল খালেক, ডা: আখলাকুল হোসাইন আহমেদ,খালেকদাদ চৌধুরী এড্ভোকেট কে এম ফজলুল কাদের,খালেকদাদ চৌধুরী,আ: কদ্দুছ আজাদ, নুরুজ্জামান চিশতি, ইনসান উদ্দিন খান, ডা: জগদীশ দত্ত,অধ্যাপক মানিক সরকার বীরমুক্তিযোদ্ধা গোলাম এরশাদুর রহমান, বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী,আশরাফ আলী খান খসরুর, মধ্যনগর থানা মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও সাবেক পরিচালক নিরীক্ষা অধিদপ্তর, গনপূর্ত মন্ত্রনালয় বাংলাদেশ সচিবালয় গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জনাব মোঃ আকিকুর রেজা ভূইয়া, মধ্যনগর থানা মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের সহ-সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আওয়াল সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও ধর্মপাশা উপজেলার  সফল উপজেলা চেয়ারম্যান, মধ্যনগর থানা মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারী বাদল চন্দ্র দাসের কাছ থেকে যুদ্ধের সময় মেহের আলীর অসামান্য অবদান সম্পর্কে জানতে পারি।

যুদ্ধের সময় মেহের আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে যুদ্ধের ট্রেনিং এর জন্য তাদেরকে মহেষখলাতে প্রেরন, মহেষখলা ক্যাম্প পরিচালনার জন্য খাদ্য সামগ্রী প্রেরন। সেই দায়িত্ব নিয়ে জনাব মেহের আলী মধ্যনগর থানার অন্তগত অঞ্চলগুলোতে কাজ করতে থাকেন। যুদ্ধের সময় মেহের আলীর অবদান সম্পর্কে পাওয়া তথ্যাদি নীম্নে উপস্থাপন করা হলো :

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক  বীরমুক্তিযোদ্ধা জনাব মোঃ আকিকুর রেজা ভূইয়া বলেন,আমি ১৯৭১ সালে পূর্তমন্ত্রনালয়ের অভ্যন্তরীন অডিট শাখায় অডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ২৬ শে মার্চের ভাষনের পর পাকিস্তান সরকারের চাকুরী না করার সিদ্ধান্ত নেই। ২৭শে মার্চ মেজর শফিউল্লাহর (পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন) গাড়ীতে টঙ্গী ব্রীজ হয়ে টাঙ্গাইলে আসি। পরবর্তীতে ট্রাকে করে আমার শ্বশুর বাড়ী ময়মনসিংহ আসি।ময়মনসিংহের কাগমারী সেনাবাহিনীতে আক্রমনকারীদের সাথে মিলিত হয়ে সেনা নিবাসের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে সেনাবাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক কষ্ট করে আমার গ্রামের বাড়ী দগুনৈ গ্রামে পৌঁছাই যাহা কিনা সুনামগঞ্জ মহকুমার মধ্যনগর থানার অন্তর্গত। এখানে এসেই সাক্ষাত হয় বীরমুক্তিযোদ্ধা মেহের আলী ভাইয়ের সাথে যিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম  সংগঠক ,তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মহেষখলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য,নেত্রকোনা মহকুমা আওয়ামীলীগের শ্রম ও কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

জনাব মেহের আলী ঢাকায় থাকালীন আমাকে, আমার খালাত ভাই বীরমুক্তিযোদ্ধা জনাব আজিজুর রহীম (স্বাধীনতার পর যিনি বাংলাদেশ সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দীর্ঘদিন নেতৃত্ব প্রদান করেন) ও আমার ভগ্নিপতি জনাব মোঃ আলী (স্বাধীনতার পর যিনি বাংলাদেশ জয়েন্টস্টক কোম্পানীর প্রধান হিসেবে অবসর গ্রহন করেন) সহ অন্যান্যদেরকে স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে আমরা অন্যান্যদের নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সতর্কতার সাথে অংশ গ্রহণ করি ।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীরমুক্তিযোদ্ধা জনাব মোঃ আকিকুর রেজা ভূইয়া বলেন,জনাব মেহের আলী আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন দলের কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক এডভোকেট সৈয়দ আহমদ ও জাতীয় ব্যাক্তিত্য একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক জনাব সানা উল্লাহ নুরী, বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মেহের ভাইয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।আমরা প্রায়ই তাদের বাসায় যাতায়াত করতাম। প্রথম দিকে মেহের  ভাই জনাব সানা উল্লাহ নূরীর বাসায় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।

জনাব মেহের আলীর মধ্যে নেতৃত্বের অসাধারন গুনাবলী ছিল। মানুষ তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। তিনি নেত্রকোনাতে যেমন মানুষকে স্বাধীকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করেছেন তেমনি মধ্যনগরের  মানুষের কাছে, ছাত্র ও যুব সমাজের  কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তাঁর শ্বশুর বাড়ী মধ্যনগর থানার দুগনৈ গ্রামে হওয়ায় তিনি স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চলের মানুষকে স্বাধীকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করতে থাকেন। বীরমুক্তিযোদ্ধা মেহের আলী মহেষখলা ক্যাম্পের ইয়ুথ, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও রিফিউজি ক্যাম্প পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।  জনাব মেহের আলীর শ্বশুরের পরিবারটি ঐ অঞ্চলের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ধনী হওয়ায় তিনি এই অঞ্চলের ছাত্র যুব সমাজকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্ভুদ্ধ করা, সাময়িকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, নৌকায় পরিবহনের ব্যবস্থা ও মহেষখলা ক্যাম্প পরিচালনার জন্য খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়ে এই অঞ্চলে আসেন।

জনাব মেহের আলী  জনাব মোঃ আকিকুর রেজা ভূইয়া (যিনি বাংলাদেশ সচিবালয়ের হিসাব নিরীহ্মা অধিদপ্তরের সহপরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহন করেন।) ও জনাব আব্দুল আওয়ালকে সহ-সভাপতি (পরবর্তীতে তিনি ধরমপাশা উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ও জেলা আওয়ামীলীগ সুনামগঞ্জের সহ-সভাপতি ছিলেন)  এবং বাদল চন্দ্র দাসকে সেক্রেটারী করে মধ্যনগর থানা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে দেন। এই কমিটিতে অন্যান্য যারা ছিলেন সর্বজনাব-১. জনাব শ্রী হেম বাবু সহ-সভাপতি ২. জনাব ললিত মোহন রায়- সহ-সভাপতি ৩. জনাব পরিতোষ পথ সহসাধারণ সম্পাদক  ৪. জনাব প্রতাপ  চন্দ্র দাস, খালপাড়া৫. জনাব আব্দুল আজিজ- চামারদানী ৬. জনাব এখলাস চৌধুরী- দুগনৈ ৭. জনাব যতীন্দ্র চন্দ্র বর্মন ৮. জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী -দুগনৈ প্রমুখ। জনাব মেহের আলী মধ্যনগর থানা এবং অন্যান্য ইউনিয়ন ও গ্রামের মুক্তি সংগ্রাম পরিষদগুলোর অনুমোদন মহেষখলা ক্যাম্প থেকে করিয়ে আনেন।মেহের আলী সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে মধ্যনগর থানার ছাত্র ও যুব সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে থাকেন ও তাদের  থাকা খাওয়া এবং ট্রেনিংয়ের জন্য ইন্ডিয়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে  মেজর মোত্তালিব (পরবর্তীতে যিনি সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন), ও ক্যাপ্টেন গণীর নেতৃত্তে কয়েকশ সামরিক কর্মকর্তা ও ই পি আর সদস্য  দুগনৈ গ্রামে আসলে মেহের আলী উনার শ্বশুর বাড়ীতে কয়েকদিনের জন্য তাদের  সকলের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং নিরাপদে ট্রেনিংয়ের জন্য ইন্ডিয়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়াও মেহের আলী উনার শ্বশুর  রহমত আলী তালুকদারের বাড়ী থেকে শত শত মণ ধান, চাল, অন্যান্য সামগ্রী মহেষখলা ক্যাম্পে পাঠান যাহা ক্যাম্প পরিচালণায় অত্যন্ত গুরুত্ত্বর্প্ণূ ভুমিকা পালন করে। ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দীন আহমেদ তার প্রবন্ধ “,অসমাপ্ত গল্প”তে আরো লিখেছেন-

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মেহের আলীর নিহতের পর কোন একদনি বাংলা একাডেমী ও একুশে পদক প্রাপ্ত জাতীয় সাহিত্যিক ও মহেষখলা ক্যাম্পের পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য জনাব খালেকদাদ চৌধুরী জনাব মেহের আলীর শ্বশুরের বাড়ীতে যান । জনাব রেজা খালেকদাদ চৌধুরীকে মেহের আলীর শ্বশুরের বাড়ী লুটের ঘটনাটি খুলে বলেন। জনাব রেজা বলেন,কিভাবে মেহের আলীর শ্বশুরের বাড়ীর ও এলাকার মেয়েদেরকে লাঞ্চিত করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়া ও সার্বিকভাবে সহায়তা করার অপরাধে কিভাবে তাদের  উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে।এরই মধ্যে জনাব খালেকদাদ চৌধুরীর উপস্থিতির কথা জানতে পেরে শত শত লোক জনাব মেহের আলীর শ্বশুরের বাড়ীতে হাজির হয়।তারা তাদের প্রিয় নেতা মেহের আলীর হত্যার বিচার চায় এবং হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করে।জনাব  চৌধুরী তাদের কথা ধৈর্য্য সহকারে শুনেন এবং অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন।

জনাব চৌধুরী মেহের আলীর শ্বশুরের পরিবারের সদস্যবৃন্দসহ দুগনৈ গ্রামের এলাকাবাসীর প্রতি মুক্তিযোদ্ধারের থাকা খাওয়া ও ক্যাম্প পরিচালনায় বিভিন্ন ভাবে সহায়তার জন্যে ধন্যবাদ জানান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বলেন, আপনাদের অবদান জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। তাদের লুট হয়ে যাওয়া সম্পদ উদ্ধারের জন্যে তিনি সরবাত্তক চেষ্টা করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। পরবর্তীতে তিনি বিষয়টি নিয়ে মহেষখলা ক্যাম্পের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডাঃ আখলাক হোসেন, আব্দুল হেকিম চৌধুরীর সাথে কথা বলেন। তারা বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় লুটে যাওয়া কিছু সম্পদ ফিরিয়ে দেন। এই বিষয়টির বর্ণনা জনাব খালেক চৌধুরী তাঁর অমর গ্রন্থ শতাব্দীর দুই দিগন্ত বইটিতে বর্ণনা করে গেছেন। বর্ণনাটি নিম্নে তুলে ধরা হলো।

স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী

জনাব খালেকদাদ চৌধুরীর হাটনাইয়া গ্রামে গমনের পথে মেহের আলীর শ্বশুর বাড়ীতে ষাত্রা বিরতি:
ঈদুল ফিতরের সপ্তাহ খানেক আগে আমি ও আরো কয়েকজন ঈদ উদযাপনের জন্য নিজ নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য একটি ভাড়াটে নৌকা করে রওনা হয়ে পড়ি। আমার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্যরা  তখন মোহনগঞ্জ থানার হাটনাইয়া গ্রামে আমার বোনের বাড়িতে ছিল। কারণ মদন থানা পাকবাহিনীর দখলে চলে যাবার পর ফতেপুর থাকা নিরাপদ নয়। তাই আমার স্ত্রী অন্যান্যদের নিয়ে এখানে চলে আসে। এখান থেকেই মাঝে মাঝে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চাউল, তরিতরকারী, তৈল, ঘি, কাপড় চোপড় পাঠিয়ে দেয়া হতো।

আমাদের প্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিস এখান থেকেই পেতাম।বর্ষা ও পানি তখন বেশ কমে আসছে। তাই সোজা পথে চলাচল প্রায় বন্ধ। তাই একটু ঘুরে আসতে হলো। পথে সন্ধ্যা হয়ে যায়। নৌকায় কোনো খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা  ছিল না তাই দুগনৈ গ্রামে নৌকা বাঁধি। নৌকায় ছিলাম আমারা চার, পাঁচজন। একজন বললো যে সে এ গ্রামে আগেও এসেছে। গ্রামের এক অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির সঙ্গে তার জানা শুনা আছে।সেই বাড়িটি হলো  মু্ক্তিযুদ্ধের সংগঠক মেহের আলীর শ্বশুর বাড়ি ।তাদের ঘাটে নৌকা খুটি গেড়ে সে নৌকা থেকে নেমে যায়। অনেক্ষণ পর ফিরে আসে এবং বলে যে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। শেষ রাত্রেও এখানেই খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। রাত দশটা এগারটার দিকে খাবার জন্য মেহের আলীর  শ্বশুর বাড়িতে যাই।তাদের কাছে শহীদ মেহের আলীর জন্য দুঃখ প্রকাশ করি এবং তাদেরকে সান্তনা প্রদান করি। খেতে বসে বাড়ির লোকদের কথাবার্তা শুনে কেমন যেন খটকা লাগলো।

এই  বাড়ীর ও গ্রামের লোকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের এ পর্যন্ত যথেষ্ট সাহায্য সহায়তা করেছে। কিন্তু তাদের আজকের আচরণে এবং কথাবার্তায় কেমন যেন একটা উৎকণ্ঠার ভাব লক্ষ্য করা গেল । আমার প্রৌরত্ব ও সাদা চুল তাদের শংকার ভাব কিছুটা দূর করতে পারলো।খাওয়া শেষ হলে আমি বাড়ির মালিক জনাব রহমত আলীর সঙ্গে কথা বলি। তাকে জিজ্ঞেস করি আপনাদের মনে যেন আমাদের প্রতি কেমন একটা সন্দেহের ভাব লক্ষ্য করছি। কিন্তু আপনারা তো সব সময়ই মুক্তিযোদ্ধাদের সকল রকমের সাহায্য করেছেন। এখন আপনাদের মনে এ সন্দেহের কারণ কি? পরে তিনি বাড়ী লুটের ঘটনাটি  বলেন । তিনি বলেন কিভাবে মেহের আলী নিহতের পরপরই তাদের বাড়ীর ও এলাকার মেয়েদেরকে লাঞ্চিত করা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়া ও সার্বিকভাবে সহায়তা করার অপরাধে কিভাবে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। আমি তাদেরকে মহেষখলা কাম্পে আমার সাথে যোগাযোগ করতে বলে আমরা চলে আসি। এর মাঝে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় লুটে যাওয়া কিছু সম্পদ উদ্ধার করা হয়।এরপর তারা আমার সাথে মহেষখলা ক্যাম্পে যোগাযোগ করে তাদের জিনিসপত্র ফিরিয়ে নেয়ার জন্য।তাদের কথা শুনে একটু চুপ করে থেকে  পরের দিন সকাল ৯টা ১০টার দিকে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার তারিখ জেনে যেতে বলি। তারা বেল যে না তাদের থাকা সম্ভব নয়। কাল সকালে তারা আবার আসবে। তাদের বাড়ী দুগনই গ্রামে। এখান থেকে নৌকা পথে দুগনই. দুঘন্টার রাস্তা। সন্ধ্যার আগেই তারা বাড়ী ফিরে যাবে। চার দাড়ের নৌকা দ্রত বেয়ে তারা এখানে আসা যাওয়া করে।

মেহের আলীর শ্বশুর বাড়ী থেকে লুন্ঠিত সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে মহেষখলাতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের গুরত্বপূর্ণ সভা:
ওরা চলে যাওয়ার পরই আমি ডাঃ সাহেবকে ডাকি। তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। তাকে ওদের কথা সব বলি। তিনি বলেন, সত্য কথাই ওরা বলেছে । এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করি কবে ওদের কেসের তারিখ দেয়া হবে। হেকিম সাহেবকেও রাজি করাতে হবে। এরপর আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজ শেষে সন্ধ্যার পরই অফিসে হাজির হই। অফিসের কাজ সেরে রাত দশটা পর্যন্ত চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে ওদের কেসের তারিখ নির্ধারণের ব্যাপারে আলোচনা করি। প্রথম দিকে তিনি নানা অসুবিধার কথা বলে তারিখ আরো পরে নির্ধারণের কথা জোর দিয়ে বলতে থাকেন। তাতে আমরাও আমাদের মতে দৃঢ় থাকি এবং শেষটায় তাকে বুঝাতে সমর্থ হই যে, ব্যাপারটা যতই দেরী হবে ততই আমাদের ন্যায় নীতি এবং সততার প্রতি আমাদের কর্মী ও সদস্যসহ বহু লোকের মন সন্দিহান হয়ে উঠবে এবং মুক্তিযোদ্ধারাও এ ব্যাপারে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। অনেক্ষণ চুপ করে থেকে সাত দিনের মধ্যে কেসের তারিখ নির্ধারণ করি।

মেহের আলীর শ্বশুর বাড়ীর উদ্ধারকৃত জিনিসের(লুন্ঠিত) বর্নণা :
পরদিন সকাল আটটায় অফিসে আসি। দশটায় ট্রাইব্যুনালে বসি, ইতিমধ্যে ওরাও এসে গেছে। আমি তাদের ডেকে তারিখ জানিয়ে দেই এবং সেই দিন ঠিক দশটায় হাজির হতে নির্দেশ দেই এবং তাদের জিনিসপত্রের লিস্ট দিতে বলি। তারা জানায় একপ্রস্থ লিষ্ট আমাদের অফিসেও আছে। সেটা দেখেই সে অনুযায়ী আপনারা জিনিসপত্রগুলো  ফিরিয়ে দিন। আমরা আপনাদের সে রায়ই মেনে নেব। ওরা বিদায় হলে চৌধুরী সাহেবকে সে তালিকায় উল্লেখিত সমস্ত  জিনিস ঐদিন অফিসে এনে জমা রাখতে বলি। তিনি জানান যে, জিনিসপত্রগুলো সেকান্দর নুরীর ( যার বিরুদ্ধে  মুক্তিযুদ্ধের সময় লুন্ঠন ও নিরাপরাধ মানুষদেরকে হত্যার বহু অভিযোগ ছিল) বাসগৃহে রয়েছে। লিস্টও তার কাছে তবে এর কপি তার নিজের কাছেও আছে।

নির্ধারিত তারিখের দু’দিন আগেই লিষ্ট অনুযায়ী সমস্ত জিনিসপত্র আমাদের কার্যালয়ের সামনের খোলা জায়গায় জমা করা হয়। এ ব্যাপারে পুরো দু’দিন লেগে যায়। জিনিসপত্রের সংখ্যা দেখে সবাই তাজ্জব বনে যায়। এত জিনিসপত্র যে গ্রামঞ্চলের কোন অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ীতে থাকতে পারে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বড় থেকে সাইজ করে সাজানো ২৮টি তামার ও এলুমিনিয়ামের ডেকছি, ৯টি বড় বড় স্টীলের ট্রাঙ্ক ভর্তি কাপড় চোপড়  বেশীর ভাগ মেয়েদের শাড়ী, ব্লাউজ, ওড়না। যার অধিকাংশই সিল্ক,নাইলন, সুতী বস্ত্রাদিও প্রচুর। তাছাড়া কাসা, চীনা মাটির থালা বাটি ও অন্যান্য বাসনের সেট, বেশ কয়েকটি দামী ঘড়ি ও ঝর্ণা কলম, আরো অনেক কিছু। যা শহরের বিত্তবান পরিবারেও বিরল।

নির্ধারিত দিনে ওরা এলো। বেলা দুটো থেকে তাদের মালামাল তালিকা মিলিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে শুরু করি। ৪টার দিকে স্নান খাওয়া সারতে চলে যাই। পরে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত একটা পর্যন্ত সব কিছু ফেরৎ দেওয়ার কাজ শেষ হলে তারা রশিদ দিয়ে তা নিয়ে যায়। কাজ শেষে তারা তাদের সব জিনিস পেয়েছে কি না জানতে চাইলে কিছুক্ষণ নীরব থেকে মাতব্বর শ্রেণীর লোকটি বলে যে যা পেয়েছে তাতেই তারা খুশী। আরো বলে যে, আপনারা আসাতে এবং একাজে তদারকি করাতেই তারা তা পেয়েছে নচেৎ তারা এসবের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো। শেষটায় বললো, একটা জিনিস শুধু পেল না। সেটা পেলেই তারা সবচেয়ে বেশি খুশী হতো। সেটা কি তা জানতে চাইলে অনেকক্ষন চুপ করে থেকে বলে যে মেয়েদের একটি হাত ঘড়ি। ঘড়িটি মেহের আলীর স্ত্রীর। তার বিয়ের উপহার। আমি বলি যে যা লিস্টে পেয়েছি তার সবই দিয়েছি। কিন্ত এ রকম ঘড়িতো লিস্টে নেই।  তবে ঘড়িটা আছে। তারা জানে কন্তিু বোঝা গেল বলতে সাহস পাচেছ না। অগত্যা তারা আর কিছু না বলে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জিনিসপত্র তাদের নৌকায় তুলতে শুরু করে আমরাও উঠে পড়ি।” চলবে…….

লেখক: অধ্যাপক ননী গোপাল সরকার।
প্রান্ধিক, ঐপন্যাসিক, গল্পকার ও কবি। সভাপতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি, সম্পাদক: বিজয় ৭১ (ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা)

এই লেখকের লেখা আরও পড়ুন…..
মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ সংগঠক: ডা: আখলাকুল হোসাইন আহমেদ- অধ্যাপক ননী গোপাল সরকার
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী  (পর্ব-১)
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী (পর্ব-২)
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী  (পর্ব-৩)

আরও পড়ুন……
ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি ও ৭১’- র মুক্তিযুদ্ধ : বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
শহীদ মেহের আলী একটি নাম, একটি ইতিহাস : বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধু: বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক : বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
নেত্রকোণার রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ মরহুম জননেতা আব্দুল খালেক এমপি