স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী [৫ম (শেষ) পর্ব]
জনাব মেহের আলী তাঁর শ্বশুর জনাব রহমত আলী তাং, চাচা শ্বশুর জনাব আক্কেল আলী তাং ও জনাব গফুর চৌধুরী এর নিকট থেকে ১৩০০ মন ধান, ১০০০ মন লাখড়ি ,৩০০ খাওয়ার থালা,৫টি বড় ডেগ ও ৫০টি চামচ মহেষখলা ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন যা কিনা মহেষখলা ক্যাম্প পরিচালনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
নেজা ডেস্ক :
গত পর্বের পর থেকে…
মহান মুক্তিযুদ্ধ : বঙ্গবন্ধুর ডাকে তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে ভারতের মহেশখলা যাওয়ার পথে মধ্যনগর থানার দুগনৈ গ্রামে তাঁর শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন মধ্যনগর সহ আশপাশএলাকার ছাত্র যুবকদেরকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করবার জন্য। ভারতের মহেষখলা ইউথ ক্যাম্প, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এবং শরণার্থী শিবিরে তাঁর ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। তিনি মহেষখলা ইউথ ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। মহেষখলা ক্যাম্পে মূলত নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সহ অন্যান্য রিফিউজি ক্যাম্প পরিচালনা করা হতো।
মহেষখলাতে মুক্তিযোদ্ধা ও ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনার পাশাপাশি তিনি মধ্যনগর থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামের ছাত্র, যুব ও সাধারণ মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্যে সংগঠিত করেন এবং ধান, চাল সহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী ক্যাম্পে সরবরাহের ব্যবস্থা করেন যা কিনা যুদ্ধের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রসদ। মেহের আলীর শ্বশুড়ের পরিবারটি অত্র অঞ্চলের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ধনী ছিলেন। সেই সুবাদে জনাব মেহের আলী মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই ঐ সব অঞ্চলের ছাত্র ও যুব সমাজকে স্বাধীকাার আন্দোলনে উদ্ভুদ্ধ করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিতেন।
মেহের আলী মোঃ আকিকুর রেজাকে সভাপতি ও জনাব আব্দুল আওয়ালকে সাধারণ সম্পাদক করে মধ্যনগর থানায় প্রথম দুর্গনৈ গ্রামের সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে দেন। পরবর্তীতে জনাব মেহের আলী ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে জনাব আকিকুর রেজা ভূঁইয়া (পরবর্তীতে তিনি পরিচালক হিসাবে নিরীক্ষা বিভাগ বাংলাদেশ সচিবালয়ে হিসাব অবসর গ্রহণ করেন) ও আব্দুল আওয়ালকে সহ-সভাপতি (পরবর্তীতে যিনি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও ধর্মপাশা উপজেলার ৩ বারের সফল উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন) ও বাদল চন্দ্র দাসকে সাধারণ সম্পাদক করে মধ্যনগর থানা মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে দেন এবং তাদেরকে নিয়ে প্রতিটি গ্রামে গ্রামে গেছেন স্থানীয় জনতাকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে।
১৯৭১ সালের এপ্রিল – মেজর মোত্তালিব (পরবর্তীতে যিনি সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন), ও ক্যাপটেন গণীর নেতৃত্বে প্রায় ৩০০ জন ই.পি.আর সদস্য দুগনৈ গ্রামে আসেন এবং দু’দিন এখানে অবস্থান করেন। জনাব মেহের আলী সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে জনাব মেহের আলীর শ^শুর মোঃ রহমত আলীর বাড়ীতে তাদের থাকা খাওয়ার সব বন্দোবস্ত করেন। ৩য় দিন তাদের মাছিমপুর ও কান্দাপাড়ায় জনাব নূর মিয়া চৌধুরীর বাড়ীতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং তারাই সব তদারকি করেন। পরের দিন মুক্তিযোদ্ধাদের পুরো টিমটিকে নিরাপদে সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে নিয়ে নিরাপদে তুরায় যাবার ব্যবস্থা করে দেন। এসবের মাঝেও জনাব মেহের আলী মহেষখলা ক্যাম্পে যাতায়ত করতেন তাঁর উপর ন্যস্ত অন্যান্য দায়িত্ব পালনের জন্যে । ইতিমধ্যে তিনি ধান চালসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে সংগে নিয়ে সংগ্রহ করতে থাকেন এবং মহেষখলী ক্যাম্প নির্বিগ্নে পরিচালনার জন্যে পাঠাতে থাকেন।
জনাব মেহের আলী তাঁর শ্বশুর জনাব রহমত আলী তাং, চাচা শ্বশুর জনাব আক্কেল আলী তাং ও জনাব গফুর চৌধুরী এর নিকট থেকে ১৩০০ মন ধান, ১০০০ মন লাখড়ি ,৩০০ খাওয়ার থালা,৫টি বড় ডেগ ও ৫০টি চামচ মহেষখলা ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন যা কিনা মহেষখলা ক্যাম্প পরিচালনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনাব মেহের আলীর শ্বশুড়ের বাড়ীটি সুমেশ^রী নদীর তীরে অবস্থিত এবং ঐ পরিবারটি অত্যন্ত প্রভাবশালী ও বিত্তবান হওয়ায় এ অঞ্চলের যে সব মুক্তিযোদ্ধা ইন্ডিয়াতে গেছেন তাদের প্রায় সকলেরই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। ঐ পরিবারের সদস্যসহ গ্রামবাসী জীবনের ঝুকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহয়তা করেছেন। তাদের অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
বীরমুক্তিযোদ্ধা মেহের আলীর শাহাদাৎবরন : জনাব মেহের আলী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের সমস্ত দায়িত্ব ¯স্থানীয় নেতৃবন্দের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে মহেষখলা চলে আসেন এবং ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে তিনি অন্যতম যিনি প্রথম ১৯৭১ সালের ১৭ই মে মহেষখলায় শহীদ হন। মেহের আলী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে প্রথম শহীদ, এবং একমাত্র শহীদ বুদ্ধিজীবি যিনি বীর মুক্তিমুযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন (শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা অনুযায়ী) ।
জনাব মেহের আলীকে ব্যাংক লুটের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সেকান্দর নুরীর লোকেরা হত্যা করে ।সেই সাথে অগ্নিযুগের এক বীরত্ব ব্যঞ্জক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। মেহের আলী নিহত হওয়ার পরপরই মহেষখলাতে জয় বাংলা বাহিনীর নেত্রকোনা শাখার প্রধান,কোম্পানী কমান্ডার,জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি,সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ-৭১, নেত্রকোণা জেলা- সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মো: শামছুজ্জোহা ও জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমীরুল ইসলামকেও গ্রেফতার করে হত্যা করার জন্য কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তারা বেচে যায়। উল্লেখ্য যে,মুক্তিযুদ্ধের খরচ ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে জাতীয় প্রয়োজনে বীরমুক্তিযোদ্ধা মো: শামসুজ্জোহার নেতৃত্তে বীরমুক্তিযোদ্ধা বুলবুল ইপিআর সদস্যসহ অন্যান্যদরকে নিয়ে পুলিশের অস্ত্রাগার ও নেত্রকোণার ন্যাশনাল ব্যাংকের Volt ভেঙ্গে টাকা পয়সা , সোনা লুট করেন যে ঘটনাটি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে।
(“মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা” বইটিতে সাবসেক্টর কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী বস্তিারতিভাবে বর্ণনা করেছেন)। কিন্তু নেত্রকোণাবাসী শহীদ মেহের আলী-র হত্যাকারীদের ক্ষমা করেননি। স্বাধীনতা লাভের অল্প কয়েকদিন পর তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম এরশাদুর রহমানের নেতৃত্বে সেইসব ঘাতকদের জনসম্মুখে হত্যা করা হয়েছিলো। মেহের আলী ছিলেন সকলের কাছে প্রিয় মেহের ভাই। তাঁর অনুসারীরা বলেন,‘ মেহের ভাই আমাদের রাজনৈতিক গুরু। তিনি আমাদের রাজনীতি শিখিয়েছেন। তাঁর মতো মানুষ হয় না। তিনি আমাদেরকে আপন ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। তাঁর মতো লোক বেঁচে থাকলে নেত্রকোণার রাজনীতিতে দুর্যোগময় অবস্থার সৃষ্টি হতো না। তিনি বেঁচে থাকলে অবশ্যই হতেন একজন এমপি-একজন মন্ত্রী-একজন আদর্শবান রাজনৈতিক নেতা। আমরা তাঁর মতো মানুষ আজও দেখিনি’।
বীরমুক্তিযোদ্ধা মেহের আলীর ডায়েরী থেকে সংগৃহীত:
নেত্রকোনা ছাত্রলীগ গঠনের ইতিহাস ও নেত্রকোনায় প্রথম নারী আন্দোলনঃ (জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন)
Shamsus Zuha: A school student while I was a student of Netrakona college
At the first week of February in 1962, I met him on the marriage ceremony of Mr.Abdul Khalek the then G.S of Awami league, netrakona. My attention was attracted by his seriousness about every affair of life. In course of time, I met the boy and discussed many problems about the country. We moved against the government for our genuine demands. After the abolition of student federation, we formed a branch of “ kochikachar Fair” named “Modhumachi kochikachar Mela”. After a few month, some of my colleague and younger both formed “ Student Union Branch”. Consequently, those who are to keep the right of liberty and liberty of speech formed a branch of “East Pakistan Student League”.Mr Zoha and I were the G.S and President of the Student League.“In connection with the movement some girls were introduced to me. In the month of September, 1962 Ms Aysha Khanum who was reading in class X was very known to me… It is a red letter day in the history of Netrakona subdivision that our sisters,the student of netrakona girl’s school, cooperate with us for the demand. Note: That procession was led by Aysha Khanom. Founder President of Bangladesh Mohila Parishad. The then government bent down his head to the Mass of the people. 9th October, 1963, the student together with political leaders have arranged a large meeting. As they are informed, they came from various schools to attend the meeting on that day at 5pm…….
মধুমাছি কচিকাঁচার গঠনের ইতিহাস:
“মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতারের প্রতিবাদে আমরা কাজ করেছিলাম ৩জন ছাত্র। আলোচনা দিন ঠিক করলাম ২১শে ফেব্রুয়ারী তথা শহীদ দিবস ঊপলক্ষ্যে। ফলে পালিয়ে বেড়ালাম অনেকদিন পর্যন্ত ।পরীক্ষায় সফল হতে পারলাম না।এই জন্যই নতুন করে শপথ নিলাম পাশ করার ও স্বৈরাচারী সরকারকে শেষ করার। ৬২ সালের শেষ দিক সংগ্রাম মুখর দিন। দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস ৵পালন ঊপলক্ষ্যে নেত্রকোনায় বিক্ষোভ হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ৭ই অকটোবরের সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেমে এল পুলিশের অত্যাচার।এবার কিন্তু মুক্তি পেলাম না। পাইকারী জরিমানার খোরাক হলাম। এবার কিন্তু বেচে যেতে পারলাম না। জেল থেকে ৯ দিন পর জামিনে ছাড়া পেলাম। জেলে বসে চিন্তা করলাম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ার। ফলে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারী মাসে মধুমাছি কচিকাচার মেলা গঠন করলাম।
১৯৬৪ সালের ১লা মে মাসে ঢাকা থেকে কবি সুফিয়া কামাল,রোকোন্জামান দাদা ভাইদের ,নেত্রকোনাতে নিয়ে এলাম।নেত্রকোনায় N.S.Fএর সম্মেলন বাতিল করেছিলাম।ফলে মামলা দায়ের করল।২৯শে মে আলোচনা করে দিন ঠিক করে রেলী হরতাল পালন করার আহবান জানালাম।সরকারী বাহিনী আমাকে ও মতিয়র রহমানকে ২৬শে আগষ্ট? “বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়ায় বাড়ী চলে গেলাম। ১লা ও ২রা মে রোকনজ্জামান দাদাভাই ও কবি সুফিয়া কামালসহ সবাই গেলাম নেত্রকোনায়। একক প্রচেষ্টা হিসেবে পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী
মেহের আলীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু প্রসঙ্গে:
“৫৭ সাল- কোন মাস সঠিক হিসাব নেই। কোনো এক বন্ধুকে বলেছিলাম ১৯৭০ সালে লন্ডন যাওয়ার কথা। জানি না- কিংবা একমাত্র আল্লাহই জানেন কবে বা কখন আমার রওয়ানা হওয়ার ডাক আসে। ১৯৫৭ সনে জনৈক সম্পর্কীয় এক ভাইয়ের সংগে ঢাকা এসেছিলাম বেড়াতে- তখন কার্জন হল দেখে মনে মনে বলেছিলাম যদি এখানে পড়তে পারতাম। ৫৮ সনে মেট্রিক পাস করি। কলেজ জীবন কাটিয়ে ১৯৬৩ সনে পাড়ি দিলাম কার্জন হলে। ভর্তি হয়ে ক্লাস করতে লাগলাম এক বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে। সেইসঙ্গে শ্রদ্ধায় মাথা নত করলাম সেই মঙ্গলময়কে যার অসীম অনুগ্রহে এখানে ভর্তি হতে পেরেছি। আশা… নিশ্চয় আল্লাহ পূর্ণ করেন- কোনদিন তিনি বান্দার আশা অপূর্ণ রাখেন না।”
বীরমুক্তিযোদ্ধা মেহের আলীর ডায়েরী থেকে সংগৃহীত বিদেশী ভাষার উক্তি:
** “হামা আজ দস্তে গায়ের নালা ফুনান্দ,শাদী,আজ দস্তে খেশতান ফরিয়াদ”
অর্থঃ নিজের হাতই যখন নিজের গালে চড় বসিয়ে দেয়,তখন হে শাদী অপরের মার খাওয়া নিয়ে খেদ করে লাভ কী।(১৮৫৭ সালে ৯ই মে মীরাট সেনানিবাস।)
** “আমারে পাছে সহজে বোল? তাইতো এত লীলার ছল,বাহিরে যার হাসির ছটা,ভিতরে তার চোখের জল।“ –ঈহুদী বৈজ্ঞানিক ডঃ কাইয়ুম ভাইজমান।
“শক্তি থাকলে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ হবে,এটা বৈজ্ঞানিক সত্য।“ –সংগৃহীত।
** “জরাজীর্ণ অতীতকে বিস্মৃত হও। বিস্মৃত হও হারিয়ে যাওয়া দিনকে। কেননা আমরা বর্তমানেরৃ..ভেতরেই বিস্মিত দেখতে চাই আমাদের অতীতকে।“—ইকবাল
বীরমুক্তিযোদ্ধা মেহের আলীর সাহিত্যকর্ম :
শহীদ মেহের আলী ছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা মানুষ। ডায়রির পাতায় তিনি লিখেছিলেন,
“প্রথম্ জীবনের মানে এক কথায় কৈশোর জীবনে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম ,তা দেরীতে হলেও পূর্ণ হচ্ছে।মানুষ প্রথম জীবনে যা কল্পনা করে যে আশা আকাংক্ষা পোষণ করে নিয়তি বোধহয় দূর থেকে সবকিছুই পূরণ করে দেয়,যাতে করে তাহার উপর কেউ দোষ চাপাতে না পারে। এজন্যই বোধ হয় কোরানে বলেছেন,..অর্থাৎ নির্দোষ তিনি।অবশ্য সেই লক্ষ্যে পৌছাবার জন্য চাই পরিশ্রম,ধৈর্য।“
“পৃথিবীতে মানুষ যখন জন্ম গহন করে সে তখন সবচেয়ে প্রকৃতিকে বেশী ভালবাসে । কিন্তু এরও বোধ হয় শেষ আছে। তাই শিশু যখন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলে অথবা সে যখন বড় হতে থাকে তখন সময়ের সাথে শিখে তার মা ও বাবাকে। ছেলে মাকে মেয়ে বাবাকে গভীর ভালবাসে কিন্তু ছেলে মাকে এবং মেয়ে বাবাকে ভালবাসা একটা অসামন্জস্য বিধায় ছেলে এমন একটি মেয়েকে, মেয়ে এমন একটি ছেলেকে খুজে যার মধ্যে সে তার মা ও বাবার গুণ দেখতে পায়।“
“সহজ হওয়ার মধ্যেই আছে কালচারের পরিচয়, আড়ম্বতার মধ্যে আছে দম্ভের। সে দম্ভ কখনও অর্থের, কখনও বিদ্যার, কখনও প্রতিপত্তির। অনেকেই ভুলে যান যে,স্বামীস্ত্রীর মিলিত জীবনের পরিপূর্ণতাও প্রমাণের অপেক্ষা রাখে-সেটা আকস্মিক নয়, পরিপূর্ণতার লাইফ ইমসিতরোল? নয়,গ্যারান্টিতো নয়ই। শুধু মীনস? সে এন্ড নয়। সামাজিক স্বীকৃতি ও আইনগত অধীকার দিয়ে বিবাহ স্ত্রীপুরুষের মিলনের ক্ষেত্রটিকে সুপরিসর ও নির্বিঘ্ন করে মাত্র। তাকে সফল করতে হয় উভয় পক্ষের সযত্ন চেষ্টায়,নিরলস সাধনায়। স্বামীস্ত্রী দিনে দিনে একে অন্যকে প্রভাবিত করে আপন রুটিন দ্বারা,অভ্যাসের দ্বারা ও মতবাদের দ্বারা পরস্পরকে গঠন করে নিজ অভিলাসনুযায়ীnকরে পাল পাল?এই দেয়া নেয়া বোঝাপড়া চলে অনেকটা অলক্ষ্যে,অজ্ঞাতে এবং অনেকটা অবিসংবাদে। সেটা পুর্ণ হয় নিকটতম সান্নিধ্যের দ্বারা। সান্নিধ্য শুধু গৃহে নয় বাহিরে।“
“অর্থাভাব হতনা,অভাব হত জীবনী শক্তির। আজ যে আমাকে বরন করবার জন্য তুমি চেয়ে আছ, আমাকে কি দেবে আমার সংগঠন করতে?তুমি চাইবেনা আমাকে তোমার মুষ্টির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে। বৃহত্তের জন্যে তমি যদি আমাকে প্রেরণা দিয়ে কাজে সাহায্য করতে তবে আমার কোন আপত্তি নেই।
‘‘ নদী ও নারীর এক গতি, একই মতি। নদী আনে ভাঙন, নারী জ্বালে প্রেমের আগুন। ক‚ল ভাঙা কীর্তিনাশা নদীর মতো নারীও নিজেকে দীপ্তিহীন প্রেমের আগুনে দহন করে, কখনও বা ক‚ল ভেঙে সমাজ সংসারের বাঁধন অতিক্রম করে…. ছুটে যায় নদীর মতো নারীও উদ্দাম, অনির্দিষ্ট। তার মধ্যে বেগ আছে, নিষেধ নেই।”
নদীর সাথে নারী জীবনের এই অপূর্ব সম্মিলন তিনি অতি নিপুণ ভাষায় লিখে গেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত: আমরা পেতাম সাহিত্য বিষয়ক মূল্যবান স্মরণীয় গ্রন্থরাজি।
২৪/১০/১৯৬৪ সালে তিনি ইংরেজিতে চমৎকার একটি কথা লিখেছিলেন, ‘‘Make new friend and keep the old. These are the silver and those are the gold.”
মেহের আলী সাহেব ডায়েরিতে লিখেছিলেন:
‘‘কোন দু:খই মানুষের চিরস্থায়ী নয়। দু:খে মানুষের দিন কাটে না, যায় না… মাঝে মধ্যে মেঘ জন্মালেও তা চিরস্থায়ী থাকে না।”
“বনরে বাঘকে গায়রে জোরে পোষ মনানো যায় কন্তিু ছোট একটি ফুলকে ফুটয়িে রাখা যায় না।
“সত্য ছাড়া আর কোনো কিছুর কাছে মাথা নত করো না। কেননা সত্যনিষ্ঠা- কেবল সত্যনিষ্ঠাই তোমাকে সাফল্যের তুঙ্গশীর্ষে উত্তীর্ণ করবে।”
বস্তুত: তাঁর এসব বাণীর আবেদন চিরকালের। যুব সমাজকে তিনি আন্দোলিত ও উদ্দীপ্ত করতে জানতেন। সমগ্র নেত্রকোণা জেলায় যারা ছাত্রলীগ এবং পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ করেছেন, তারা কোনো না ভাবে শ্রদ্ধেয় মেহের আলী ভাইয়ের নির্দেশনা ও সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। আমি তখন বারহাট্টা থানার বাউসী হাইস্কুলে পড়ি। তখন উনসত্তরের অগ্নিঝরা দিন। ঢাকার সাথে এখনকার মতো সরাসরি যোগাযোগ তখন ছিলো না- ছিলো না মুঠোফোনের যুগ। রেডিও এবং পরদিনের সংবাদপত্র ছিলো যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু আমরা নেত্রকোণা থেকে আন্দোলনের দিক-নির্দেশনা পেতাম। এমনকি কখন কোন শ্লোগান দিতে হবে- তাও। আমরা তখনই মেহের আলী ভাইয়ের কথা জানতে পারি এবং দূর থেকে তাঁকেই আমাদের নেতা হিসেবে জ্ঞান করি।
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক : নেত্রকোণা পৌরসভায় অজহর রোডের মোড় থেকে পূর্বদিকে ইসলামপুর পর্যন্ত হেঁটে গেলে অজান্তেই সেই বাড়িটির কথা মনে পড়ে- যেখানে একদিন জন্ম নিয়েছিলেন অগ্নিযুগের এই বিপ্লবী পুরুষ ! নেত্রকোণা পৌরসভা ও জেলা পরিষদ সরকারি অনুমোদনসাপেক্ষে ১৯৯৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই রাস্তাটির নামাকরণ করেছেন ‘শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেহের আলী সড়ক’। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী ও তা বাস্তবায়নে সর্বদা সচেষ্ট মাননীয় সংসদ সদস্য হাবিবা রহমান(শেফালী) ২০১৫ সালে নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়রে স্কুলের একটি গেইটের নামকরন করেন “বীর মুক্তিযোদ্ধা মেহের আলী গেইট” মেহের আলীর স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে উঠেছে শহীদ মেহের আলী স্মৃতি পরিষদ ও শহীদ মেহের আলী স্মৃতি যুব জাগরণ সমিতি, মালনী রোড(বর্তমানে সমিতি ঘরটিকে মসজিদে রুপান্তরিত করা হয়েছে)। স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান ও মুক্তিযু্দ্ধে জীবন বিসর্জনের জন্য “বিজয় একাত্তর সম্মাননা-২০২২” এবং ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন কলেজ ও লোকসাহিত্য গবেষণা একাডেমি সম্মাননা স্মারক ২০২২ প্রদান করা হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে শহীদ মেহের আলীর পরিবারের জন্য এক হাজার টাকা সম্মানী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল।
সে সময়ে আমার এক কাকা কান্তি রঞ্জন চৌধুরী নেত্রকোণা কলেজে বি.এ শ্রেণিতে পড়তেন। আর আমার মেঝদা বীর মুক্তিযোদ্ধা নিরঞ্জন সরকার ভজন পূর্বধলা কলেজে আইএ শ্রেণিতে পড়তেন। তাঁরা দু’জনের কাছ থেকে মেহের আলী ভাই সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিলাম। স্বাধীনতা লাভের পর শ্রদ্ধেয় জোহা ভাই, মতি ভাই, এরশাদ ভাই, হায়দার ভাইসহ অনেকের কাছ থেকে মেহের আলী ভাইয়ের নেতৃত্ব এবং বীরত্বব্যঞ্জক সংগ্রামের তথ্য-উপাত্ত পেয়েছিলাম।
আজ শহীদ মেহের আলী ভাইয়ের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে হৃদয় উদ্বেলিত এবং আবেগে আপ্লুত। এমন একজন মহান মানুষ নেত্রকোণা ও সমগ্র দেশের জন্য বড় বেশী প্রয়োজন ছিলো। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
লেখক: অধ্যাপক ননী গোপাল সরকার।
প্রান্ধিক, ঐপন্যাসিক, গল্পকার ও কবি। সভাপতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি, সম্পাদক: বিজয় ৭১ (ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা)
এই লেখকের লেখা আরও পড়ুন…..
মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ সংগঠক: ডা: আখলাকুল হোসাইন আহমেদ- অধ্যাপক ননী গোপাল সরকার
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী (পর্ব-১)
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী (পর্ব-২)
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী (পর্ব-৩)
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী শহীদ মেহের আলী (পর্ব-৪)
আরও পড়ুন……
ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি ও ৭১’- র মুক্তিযুদ্ধ : বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
শহীদ মেহের আলী একটি নাম, একটি ইতিহাস : বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধু: বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
মুক্তিযুদ্ধের স্মারক : বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
নেত্রকোণার রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ মরহুম জননেতা আব্দুল খালেক এমপি