স্বামী বা স্ত্রীর কোন একজন পাগল হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালাক হয়ে যাবে কি?
ইসলামিক জার্নাল ডেস্কঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধ কাজ হল তালাক বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়া। আর শয়তানের কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় কাজ হল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করা [সহীহ মুসলিম-৬৮৪৬]। অতীব প্রয়োজন (যা শরীয়তে ওজর বলে গণ্য) ছাড়া স্বামীর জন্য যেমন তালাক দেওয়া জায়েয নয়, তেমনি স্ত্রীর জন্যও তালাক চাওয়া দুরস্ত নয়।
তালাকের পথ খোলা রাখা হয়েছে শুধু অতীব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। আমাদের বর্তমান সমাজে তালাক মনে হয় এক খেল তামাশায় পরিনত হয়ে গেছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে তালাক সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা। তাই কেউ দাম্পত্য জীবনে পা রাখার আগে তার অপরিহার্য কর্তব্য হবে, বিয়ের আগেই দাম্পত্য জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় মাসআলাগুলোর সাথে তালাকের বিধানসমূহ জেনে নেওয়া।
তালাক শব্দটির মানে হলো বিয়ের বন্ধন খুলে দেয়া; স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পরিত্যাগ করা বা বিচ্ছিন্ন করা। স্বামী কর্তৃক সরাসরি অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে বা আদালতের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনের সম্পর্ক ছিন্ন করাই হলো তালাক। দাম্পত্য জীবনে মিলমিশ রাখার সব প্রচেষ্টা যেখানে ব্যর্থ হয়ে যায়; সেখানে এ ব্যবস্থার সাহায্যে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের স্বাতন্ত্র ও ব্যক্তিগত সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখার এবং জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করাই হচ্ছে তালাকের উদ্দেশ্য। তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কেউ এই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কিংবা ভুল পন্থায় তা প্রয়োগ করলে সে একদিকে যেমন গুনাহগার হবে অন্যদিকে তালাকও কার্যকর হয়ে যাবে।
ইসলামে তালাকের অধিকার সীমিত করা হয়েছে তিনবারের মধ্যে। প্রথম দু’বার ‘রাজ‘ঈ’ ও শেষেরটি ‘বায়েন’। অর্থাৎ ইসলামে তালাকের বিধান রাখা হ’লেও স্বামীকে ভাববার ও সমঝোতার সুযোগ দেওয়া হয় স্ত্রীর তিন ঋতু বা তিন মাসিক যাবত। এর মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। যাকে ‘রাজ‘আত’ বলা হয়। কিন্তু গভীর ভাবনা-চিন্তার পর ঠান্ডা মাথায় তৃতীয়বার তালাক দিলে তখন আর ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। এটাকে তালাকে বায়েন বলে।
তালাক দেয়ার পদ্ধতি দু’টি:
১) স্ত্রীকে তার ঋতু হতে পবিত্র হওয়ার পর মিলন ছাড়াই স্বামী প্রথমে এক তালাক দিবে। অতঃপর সহবাসহীন অবস্থায় তিন ঋতুর ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে স্বামী স্ত্রীকে রাজ‘আত অর্থাৎ ফিরিয়ে নিতে পারে। ইদ্দতকালে স্ত্রী স্বামীগৃহে অবস্থান করবে। অবস্থানকালে স্বামী স্ত্রীকে খোরপোষ দিবে। এটিই হ’ল তালাকের সর্বোত্তম পন্থা। ‘মাকাল ইবনু ইয়ানারেব বোন এক ব্যাক্তির বিবাহাধীন ছিল। সে তাকে তালাক দিল। পুনরায় ফিরিয়ে আনলোনা, এভাবে তার ইদ্দত শেষ হয়ে গেলে সে আবার তার কাছে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। মাকাল (রাঃ) ক্রোধান্বিত হলেন, সময় সুযোগ থাকতে ফিরিয়ে নিল না, এখন আবার প্রস্তাব দিচ্ছে। এরপর আল্লাহ তাআলা এ আয়াতটি অবর্তীর্ন করেনঃ তোমরা যখন স্ত্রীকে তালাক দাও এবং তারা তাদের ইদ্দত-কাল পূর্ন করে, তখন তারা নিজেদের স্বামীদেরকে বিবাহ করতে চাইলে তোমরা বাধা দিও না। (বাকারা-২৩২)। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডাকলেন এবং তার সামনে আয়াতটি পাঠ করলেন। তিনি তার জিদ পরিত্যাগ করে আল্লাহর আদেশের অনুসরণ করেন।’ [সহীহ বুখারী-৪৯৪৫]
২) সহবাসহীন তোহরে প্রথম তালাক দিয়ে ইদ্দতের মধ্যে পরবর্তী তোহরে ২য় তালাক দিবে এবং ইদ্দতকাল গণনা করবে। অতঃপর পরবর্তী তোহরের শুরুতে তৃতীয় তালাক দিবে ও ঋতু আসা পর্যন্ত সর্বশেষ ইদ্দত পালন করবে। তৃতীয়বার তালাক উচ্চারণ করলে স্ত্রীকে আর ফেরৎ নেওয়া যাবে না। অতএব ২য় তোহরে ২য় তালাক দিলে ৩য় তোহরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানেও পূর্বের ন্যায় যাবতীয় বিধান বহাল থাকবে। যেমন পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন; ‘হে নবী! যদি আপনি স্ত্রীদের তালাক দিতে চান, তাহ’লে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দিন এবং ইদ্দত গণনা করতে থাকুন। আপনি আপনার প্রভু সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকুন। সাবধান তালাকের পর স্ত্রীদেরকে গৃহ হ’তে বিতাড়িত করবেন না, আর তারাও যেন স্বামীগৃহ ছেড়ে বহির্গত না হয়। অবশ্য তারা যদি খোলাখুলিভাবে ফাহেশা কাজে লিপ্ত হয়, তাহ’লে স্বতন্ত্র কথা। এগুলি আল্লাহকৃত সীমারেখা। যে ব্যক্তি উক্ত সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজের উপরে যুলুম করে। কেননা সে জানে না যে, তালাকের পরেও আল্লাহ কোন (সমঝোতার) পথ বের করে দিতে পারেন’ (তালাক্ব ৬৫/১)।
একত্রে বা একই মজলিসে তিন তালাক:
এক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল : যদি কেউ শারঈ পন্থা বাদ দিয়ে বিদ‘আতী পন্থায় এক মজলিসে তিন তালাক একত্রিতভাবে বা একই তুহরে তিন তালাক পৃথক পৃথকভাবে দিয়ে দেয়, তা’হলে তার স্ত্রী চিরতরে তালাক হবে কি-না। এই বেদাতী পন্থাটা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটে। বলতে গেলে ৯৫% তালাক এই বেদাতী পন্থায় ঘটে।
কুরআনী নীতি অনুযায়ী তিন তুহরে তালাক না দিয়ে যদি কেউ অন্যায়ভাবে একই সাথে তিন তালাক দেয়, তবে সে তালাক বর্তাবে কি-না, এ বিষয়ে বিদ্বানগণের মতভেদকে চারভাগে বিভক্ত করা যায়। একদল বিদ্বান বলেন, এর দ্বারা কিছুই বর্তাবে না। ২য় দল বলেন, তিন তালাক পতিত হবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তি গোনাহগার হবে। ৩য় দল বলেন, সহবাসকৃত নারীর উপরে তিন তালাক বর্তাবে ও সহবাসহীন নারীর উপরে এক তালাক বর্তাবে। ৪র্থ দল বলেন, এক তালাক রাজ‘ঈ হবে।
১ম দলের দলিল:
তাঁদের মূল দলীল (ক) সূরায়ে বাক্বারাহ ২২৮ ও ২২৯ আয়াত ও সূরায়ে তালাকের ১ম ও ২য় আয়াত। অতঃপর (খ) হাদীছের দলীল হ’ল- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় স্বীয় স্ত্রীকে ঋতুকালীন সময়ে তালাক দেন। তখন ওমর (রাঃ) উক্ত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি ওমর (রাঃ)-কে বলেন, আপনি আব্দুল্লাহ্কে বলুন যেন সে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় ও ঘরে রাখে পরবর্তী তুহর পর্যন্ত। অতঃপর সে পুনরায় ঋতুবর্তী হবে ও ঋতুমুক্ত হবে। তখন ইচ্ছা করলে সে তাকে রেখে দিবে অথবা সহবাসের পূর্বেই তালাক দিবে। এটাই হ’ল ইদ্দত তালাকপ্রাপ্তা নারীদের জন্য, যা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন’ (সহী বুখারী-৪৮৭৫, ও সহীহ মুসলিম-৩৫২০)।
পাগল হওয়া তালাক কার্যকর হওয়ার কোন কারণ নয়। তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে কেউ পাগল হয়ে গেলে সুস্থ ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে তালাক দিতে বা নিতে পারে। যদিও মানবিকতার দিকটিই অগ্রাধিকার প্রদান করা কর্তব্য হবে এবং স্ত্রী যদি অসুস্থ হয়, স্বামীর দায়িত্ব হবে তার জন্য সাধ্যমত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা (বাজী, আল-মুন্তাক্বা ৪/১২১; উছায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে‘ ১২/২২৫)।
স্বামী যদি বদ্ধ পাগল হয়ে যায় আর সহসা সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে এমতাবস্থায় স্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করলে তার জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ করা জায়েয। এ ক্ষেত্রে কোর্টের মাধ্যমে বিচ্ছেদের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। বিবাহ বিচ্ছেদ ব্যতিরেকে তা বৈধ হবে না।
এ বিষয়ে কোন কোন আলেম বলেন, স্ত্রীকে এ জন্য নূন্যতম ১ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে যদি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদ বৈধ হবে না। তবে এ সময় নির্ধারণের ব্যাপারে কোন দলীল আছে কি না তা আমার জানা নাই।
মোটকথা, যদি আল্লাহর ফয়সালা অনুযায়ী স্বামী পাগল বা মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায় তাহলে প্রথমত: স্ত্রীর উচিৎ ধৈর্যের সাথে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো না করা। এরপর যদি সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনা না দেখা যায় এবং সে নিজে ও তার সন্তান-সন্ততি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করে তাহলে তখন কোর্ট এর মাধ্যমে আইনগত ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ করবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকেে হেফাজত করুন।
সংকলন:
মাও: আবু তাহের নেত্রকোণী
প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম ক্বাওমি মাদ্রাসা।
ভূগী, পূর্বধলা, নেত্রকোণা।
নিয়মিত লেখক, ইসলামিক জার্নাল বিভাগ
নেত্রকোণা জার্নাল