মে দিবস: শ্রমিকের ঘামে লেখা এক অমর ইতিহাস

প্রকাশিত: ৭:০৬ অপরাহ্ণ, মে ১, ২০২৫

“শ্রমিক মানেই কেবল মজুরি নয়,শ্রমিক মানেই কেবল হাত পাতা ভিক্ষুক নয়। মাটি থেকে আকাশ ছুঁয়া যে দালান, তার প্রতিটি ইটেই লেখা থাকে শ্রমিকের নাম।”

মানবসভ্যতার ইতিহাস মূলত শ্রমের ইতিহাস। যে হাত মাটি খুঁড়ে অন্ন ফলায়, যে ঘামে ঘূর্ণায়মান চাকা তৈরি হয় বিদ্যুতের, যে পায়ের ধাক্কায় জেগে ওঠে শহরের ব্যস্ততা—তাদের স্মরণে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় মে দিবস। ১লা মে — আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, কেবল একটি দিন নয়; এটি একটি প্রতীক, এক গভীর প্রতিজ্ঞার স্মারক — “শ্রমই উন্নয়নের শেকড়, শ্রমিকের অধিকারই সভ্যতার চাবিকাঠি”।

১৮৮৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহর। তখন শিল্পবিপ্লবের জোয়ারে গতি পেয়েছে আধুনিকতা, কিন্তু শ্রমিকের ভাগ্যে নেমে এসেছে অমানিশা। দিনে ১২-১৬ ঘণ্টা অমানবিক পরিশ্রম, নেই বিশ্রাম, নেই ন্যায্য মজুরি। এই পরিস্থিতিতে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে শিকাগোসহ নানা শহরে শুরু হয় প্রতিবাদ।

১লা মে, হে মার্কেট স্কোয়ারে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় চারজন শ্রমিকের। পরদিন বোমা বিস্ফোরণ ও পুলিশের পাল্টা আক্রমণে আরও বহু হতাহত হন। এই ঘটনাই ইতিহাসে পরিচিত হয় ‘হে মার্কেট ম্যাসাকার’ নামে। শ্রমিকদের রক্তে লেখা সেই দিনের আবেদন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেসে ১লা মে দিনটিকে “আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেখান থেকেই মে দিবস বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের অধিকারের প্রতীক হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে মে দিবস প্রথম সরকারিভাবে পালিত হয় ১৯৭২ সালে। তবে এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগেই। ১৯৪০-এর দশকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে গড়ে ওঠে শ্রম আন্দোলনের প্রথম ঢেউ। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ শ্রমজীবী শ্রেণির চেতনায় নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।

স্বাধীনতার পর ‘শ্রমিক-মালিক সৌহার্দ্য’ নীতির মাধ্যমে একটি কল্যাণমূলক শ্রমনীতি প্রণয়ন করেন। শ্রমিকদের জন্য সরকারি মালিকানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালু হয়, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, বার্ষিক ছুটি এবং মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিত করা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে…
কালের প্রবাহে আমরা অনেক দূর এসেছি, কিন্তু শ্রমিকের মুখে হাসি কি ফিরেছে? তৈরি পোশাক শিল্পে নিযুক্ত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের অধিকাংশই নারী। তারা দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগেরও বেশি অবদান রাখছেন। অথচ কাজের নিরাপত্তা, বেতনবৈষম্য, সময়মতো পারিশ্রমিক প্রদান—এমন অনেক মৌলিক অধিকার এখনও অধরা থেকে গেছে।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধস আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। প্রায় ১,১৩৪ শ্রমিকের মৃত্যু এবং সহস্রাধিক আহত হওয়ার এই ঘটনা শ্রমিক নিরাপত্তার করুণ চিত্র তুলে ধরে। এরপর অনেক আইন-কানুন প্রণীত হলেও বাস্তব প্রয়োগ এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।

বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দোরগোড়ায়। প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স ও গিগ ইকোনমির প্রসারে শ্রমের সংজ্ঞাই বদলে যাচ্ছে। আজকের শ্রমিক শুধু কারখানার নয়, সে ফ্রিল্যান্সার, সে অ্যাপভিত্তিক ডেলিভারি কর্মী, সে রাইডশেয়ারিং চালক। কিন্তু এই নতুন ধারার শ্রমিকরা এখনও আইনি স্বীকৃতি ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত।

মে দিবস তাই কেবল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নয়, এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের শ্রমিক সমাজের কাঠামো গঠনের সুযোগ

মে দিবস শুধু রাজনীতির ভাষায় কথা বলে না, এটি সাহিত্যের, কাব্যের, গানের এক অন্তর্লীন অনুরণন। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “শ্রমিকের গান”-এ লিখেছিলেন:

“শ্রমিক ভাই ভাই রে ভাই,
জগৎ চলে শ্রমেই,
শ্রমিককে করে যে হেয়
সে মানুষ নয়,ছলে!”

মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—একটি সমাজ তখনই সভ্য হয়, যখন সে তার শ্রমিকের ঘামকে সম্মান করে, তার অধিকার রক্ষা করে। উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন তা শ্রমিকের হাসিমুখ দিয়ে শুরু হয়।

আসুন, মে দিবসের দিনে আমরা নতুন প্রতিজ্ঞা করি। শ্রমিক শুধু একশ্রেণির মানুষ নয়, তিনি আমাদের সমাজের চালিকাশক্তি। তার সম্মান, সুরক্ষা ও সুস্থ জীবন নিশ্চিত করাই আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক:
মোঃ ইমরান হোসাইন।