ইসলামিক জার্নাল ডেস্ক :
হিজরি নবম মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত অনুষ্ঠিত হয়েছে মেরাজ। প্রিয়নবিকে চরম বিপদের মুহূর্তে শান্ত্বনা দেয়ার নিমিত্তে এক অসাধ্য সাধন কাজের মাধ্যমে নবুয়তের সত্যতাকে সুনির্ধারিত করতে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলা তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে ডেকে নেন। ইসলামের ইতিহাসে এ ঘটনা মেরাজ নামে প্রসিদ্ধ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা (আল্লাহ) তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে (হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাত্রি বেলা ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম (মক্কা মুকাররামাহ) থেকে মসজিদে আকসা (বাইতুল মুকাদ্দাস) পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি (আল্লাহ) পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাইল আয়াত-০১)
এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয়নবিকে দেখিয়েছেন অনেক নির্দশন। যার মধ্যে রয়েছে সাধারণ জ্ঞানের বাইরে ঐশ্বরিক অনেক ঘটনা ও ইতিহাস।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কেন এত বড় একটি ঘটনা ঘটালেন? এর পেছনে তাঁর কি রহস্য? এর গুরুত্বই বা কি? এর দ্বারা আমরা কি পেলাম? এ বিষয়গুলোর একটি সংক্ষিপ্তরূপ তুলে ধরা হলো- নবুয়তের সত্যতার প্রথম দিক...মেরাজের রাতে পবিত্র নগরী মক্কা থেকে আরেক পবিত্র নগরি জেরুজালে মুহূর্তের মধ্যে গমন। সেখানকার মসজিদে আকসার চার পাশের বরকতময় নির্দশনগুলোর পরিদর্শন। অথচ এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সাধারণত সময় লাগে এক মাস। আল্লাহ তাআলা তা খুব তড়িৎ গতিতে সম্পন্ন করিয়েছেন।
যা মেরাজ পরবর্তী সময়ে মক্কায় অবস্থানরত সকল কাফির-মুশরিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়নবি বলে দিয়েছিলেন। যা তার নবুয়তের সত্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং মুজেজা।
মেরাজের দীর্ঘ পথে যা দেখলেন তিনি...মদিনায় নামাজ আদায়হাদিসের এক রেওয়ায়েতৈ এসেছে, ‘বোরাক নামক কুদরতি বাহনে ভ্রমণের সময় জিবরিল আলাইহিস সালাম এক জায়গায় পিয়নবিকে নামাজ পড়তে বলেন। অতঃপর তিনি বলেন, এ জায়গা আপনি চিনেন? প্রিয়নবি বললেন, না’। হজরত জিবরিল আলাইহিস সালাম বললেন, ‘এটা তায়্যেবা অর্থাৎ মদিনা, এটাই হচ্ছে হিজরতের জায়গা।
তুর পাহাড়ে নামাজমদিনা অতিক্রম করার পর অন্য এক জায়গায় নামাজ পড়ান এবং বলেন এটা হচ্ছে তুরে সাইনা অর্থাৎ এখানেই আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কথা বলেন।বাইতে লাহামে নামাজতুর পাহাড়ের পর প্রিয়নবি বায়তে লঅহামে নামাজ আদায় করে। এ বায়তে লাহাম হলো হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মস্থান।
অতঃপর প্রিয়নবি বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌছেন। যেখানে সকল নবি ও রাসুলগণ একত্রিত হন। কেননা এই বায়তুল মুকাদ্দাসই হচ্ছে সব নবি ও রাসুলদের প্রাণ কেন্দ্র।
সব নবি-রাসুলদের নেতা মনোনীতবায়তুল মুকাদ্দাসে পৌছার পর প্রিয়নবি সব নবি-রাসুলদের ইমাম হয়ে মসজিদে আকসায় নামাজ আদায় করেন। আর এ নামাজ আদায়ের মাধ্যমে প্রিয়নবি হয়ে ওঠেন ইমামুল মুরসালিনা ওয়ান নাবিয়্যিন।
বায়তুল মুকাদ্দাসে দুধ পানসব নবি-রাসুলদের নিয়ে নামাজ আদায়ের পর প্রিয়নবিকে পানি বা সরাব, দুধ ও মধু দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। প্রিয়নবি দুধ গ্রহণ করলেন। প্রিয়নবি দুধ পান করার ফলে জিবরিল আলাইহিস সালাম বলেন, ‘আপনি ফিতরাতের ওপর বিজয়ী হয়েছেন। যদি আপনি পানি পান করতেন তবে, আপনার উম্মত বিপদের সম্মুখীন হয়ে যেত।
উর্ধ্বলোকে আরোহন ও প্রথম আকাশে ঘটনা প্রবাহ... হজরত আদম আলাইহিস সালামের সাক্ষাৎদুনিয়ার আকাশে আরোহন করে প্রিয়নবি দেখেন এক ব্যক্তি ডানে তাকিয়ে হাসছেন; আর বামে তাকিয়ে কাঁদছেন। জিবরিল প্রিয়নবির জিজ্ঞাসায় জানালেন, ইনি হলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম। তিনি তার ডান পাশের জান্নাতি সন্তানদের দেখে হাসছেন। আর বাম পাশের জাহান্নামি সন্তানদের দেখে কাঁদেছেন।
হারাম ভক্ষণকারীর পরিণামদুনিয়ার আকাশে দুইটি ভাণ্ডভর্তি গোশ্ত। যার একটি তাজা গোশ্ত। আর অন্যটিতে পঁচা-দুর্গন্ধ গোশ্ত। মানুষ তাজা গোশ্ত না খেয়ে পঁচা গোশ্ত খাচ্ছে। প্রিয়নবি জানতে পারলেন এরা হলো দুনিয়ার হারাম ভক্ষণকারী ব্যক্তি।
অন্যায়ভাবে সম্পদ আত্মসাৎকারীর পরিণামকিছু লোকের ঠোট উটের মত। ফেরেশতারা তাদের মুখ ফেড়ে ঐ (পঁচা-দুর্গন্ধযুক্ত)গোশত তাদের মুখের মধ্যে ভরে দিচ্ছেন; যা তাদের অন্যপথ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর তাতে তারা ভীষণ চিৎকার করছে এবং আল্লাহর কাছে মিনতি করছে। জানা গেল এরাই হচ্ছে দুনিয়াতে যারা ইয়াতিমের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করেছিল।
ব্যভিচারীর পরিণামসেখানে দেখা গেল- কয়েকজন স্ত্রীলোক বুকের ভারে লটকানো রয়েছে এবং হায়! হায়! করছে। জানা গেল এরা হচ্ছে ঐ সব স্ত্রীলোক; যারা দুনিয়াতে ব্যভিচারে লিপ্ত ছিল।
সুদ খাওয়ার পরিণামঅতঃপর দেখলেন, কিছু লোকের পেট বড় বড় ঘরের মত। তারা উঠে দাঁড়াতে চাইলেই পড়ে যাচ্ছে আর আল্লাহ তা’আলার সামনে হা-হুতাশ করছে। জানা গেলে তারা হচ্ছে দুনিয়ার সুদখোর ব্যক্তি।
গিবতকারীর পরিণামঅতঃপর দেখা গেল- ফেরেশতারা কিছু লোকের পার্শ্বদেশ থেকে গোশত কেটে তাদের নিজেদের খাওয়াচ্ছে আর বলছে, তোমরা দুনিয়াতে যেভাবে নিজের ভাইয়ের গোশত খেতে (গিবত করতে); এখনেও খাও। জানা গেল- তারা হল ওই সব লোক; যারা দুনিয়াতে অপরের দোষ অন্বেষণ করে বেড়াত
এভাবে দ্বিতীয় আকাশে সুদর্শন যুবক হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম, তৃতীয় আকাশে হজরত ইয়াহইয়া ও জাকারিয়া আলাইহিস সালাম, চতুথ আকাশে হজরত ইদরিস আলাইহিস সালাম, পঞ্চম আকাশে হজরত হারুন ইবনু ইমরান আলাইহিস সালাম, ষষ্ঠ আকাশে হজরত মূসা ইবনু ইমরান আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
সপ্তম আকাশে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎসপ্তম আকাশে বায়তুল মামুরের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসে থাকা মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে দেখতে পানে।
রাসূল যখন এক আসমান থেকে অন্য আসমানে উঠছিলেন জিবরাইল তার জন্য প্রতিটি আসমানের দরজা খুলে দেওয়াচ্ছিলেন। এভাবে ঊর্ধ্ব আরোহণ করতে করতে রাসূল এমন এক স্থানে পৌঁছালেন- যেখান থেকে দপ্তরে কলম চলার আওয়াজ আসছিল। ওই স্থানে সালাত ফরজ হয়।
সালাতের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- ‘তোমার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও এবং তুমি নিজেও উহাতে অবিচল থাক........’ (সূরা তা-হা; আয়াত-১৩২)।
ধারাবাহিক চলার গতিতে রাসূল সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছালেন। তৎপর জান্নাত ও জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করলেন। নবীজি জান্নাত পরিদর্শনে গেলে তাঁর সম্মানে ফুলের বাগানগুলো মধুর সুগন্ধ ছড়িয়ে দেয়। জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলে নবীজির সম্মানে জাহান্নামের আগুন নিভে যায়।
রাসূলে আরাবির (সা.) মেরাজ সফরে জিবরাইল, মিকাইল (আ.)সহ ৫০ হাজার ফেরেশতা রাসূলের খেদমতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বোরাক নামক বাহন বেহেশত থেকে পাঠানো হয়েছিল।
বোরাকের গতি ছিল বিদ্যুতের গতি। অবতরণকালে সামনের পা দু’খানা লম্বা ও আরোহণকালে পেছনের পা দু’খানা লম্বা হয়ে যায়। দৃষ্টির শেষ সীমানায় পা ফেলে বোরাক। তা ছাড়া রাসূলের মেরাজের ওই সফরে আরও ১০টি সোপান খেদমতের সৌভাগ্য লাভ করে বলে জানা যায়।
ইমামুল মুরসালিন (সা.) মেরাজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পবিত্র মক্কায় যখন এর চর্চা হচ্ছিল তখন প্রত্যেকই স্বীয় মানসিকতা অনুযায়ী এতদসম্পর্কে ধারণা করতে থাকে।
কুরাইশরা রাসূলের কাছে জিজ্ঞেস করল যদি তুমি বাইতুল মাকদিস প্রত্যক্ষ করে থাক, তবে- উহার দৃশ্য বর্ণনা কর।
এ প্রসঙ্গে সরদারে দোজাহার (সা.) একটি হাদিস পেশ করা হলো- ‘হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলকে বলতে শুনেছেন- মেরাজের ব্যাপারে কুরাইশরা যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করল তখন আমি কাবাগৃহের হাতিমে দাঁড়ালাম। তখন আল্লাহতায়ালা বাইতুল মাকদিস মসজিদ খানা আমার সম্মুখে প্রকাশ করে দিলেন। ফলে আমি উহার দিকে তাকিয়ে উহার চিহ্ন ও নিদর্শনগুলো তাদের বলে দিতে থাকলাম। (বুখারি- মুসলিম)।
মরুর দুলালের মেরাজ ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী সফর। যা সাধারণ জ্ঞানে বোঝা বড়ই দুরূহ ব্যাপার। ওই সফরে চক্ষু দ্বারা দেখার জন্য যেসব শর্ত পূরণ আবশ্যক সেসব শর্তের যাবতীয় বাধা রাসূলের চক্ষু থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শ্রবণের সাধারণ নিয়মাবলি অপসারিত হয়েছিল এবং স্থান ও কালের সব দূরত্ব তাঁর জন্য সংকুচিত করা হয়েছিল।
হাবিবে খোদার (সা.) মেরাজ রাতের বিচরণ যতদূর পর্যন্ত হয়েছিল তাতে তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য নবী-রাসূলদের সব শ্রেষ্ঠত্বকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বাইতুল মাকদিসে মুসল্লি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন নবী-রাসূলদের আত্মাগুলো, বাইতুল মামুরে ফেরেশতাকুল।
ধন্য হয়েছিল আকাশ-বাতাস, আরশ, কুরসি, লাওহে-মাহফুজ, কলম, জান্নাত-জাহান্নাম তথা ঊর্ধ্বজগৎ। মেরাজের রাতে সৃষ্টির নিদর্শনগুলোয় বন্ধুকে দেখায়ে যুগ-জনমের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন আল্লাহ্, আর নিদর্শনগুলো দেখে চক্ষু শীতল করেছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)।
এভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনেক কিছু দেখানো হয়, অনেক কিছু জানানো হয়। যত বিষয়ে আমরা না দেখে ঈমান রাখি, সে সব কিছু তাঁকে দেখানো হয়। এটাই মেরাজের শিক্ষা যে, গায়েবের সব বিষয়ে আমাদের বিশ্বাস ও ইয়াকীনকে আরো দৃঢ় করবো এবং মেরাজের রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযসহ যেসব বিধান আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেসব বিধান পালনে পাবন্দ হওয়া।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে সেসব বিধান পালন ও আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন ছুম্মা আমিন।
সংকলন:
মাও: আবু তাহের নেত্রকোণী
প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম ক্বাওমি মাদ্রাসা।
ভূগী, পূর্বধলা, নেত্রকোণা।
নিয়মিত লেখক, ইসলামিক জার্নাল বিভাগ
নেত্রকোণা জার্নাল।
সম্পাদক ও প্রকাশক- মুহা. জহিরুল ইসলাম অসীম
অস্থায়ী কার্যালয় : এআরএফবি ভবন, নেত্রকোণা - ময়মনসিংহ রোড, সাকুয়া বাজার মোড়, নেত্রকোণা সদর, নেত্রকোণা-২৪০০। ফোনঃ ০১৭৩৫-০৭৪ ৬০৪, বিজ্ঞাপন: ০১৬৪৫-৮৮ ৪০ ৫০, ই-মেইল: netrokonajournal@gmail.com
সম্পাদক কর্তৃক এআরএফবি ভবন, ময়মনসিংহ রোড, সাকুয়া বাজার, নেত্রকোণা সদর, নেত্রকোণা থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত..... [সর্বাধিক পঠিত নেত্রকোণার একটি আঞ্চলিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম]