শহীদ মেহের আলী একটি নাম, একটি ইতিহাস : বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী

শহীদ মেহের আলী তৎকালিন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন

প্রকাশিত: ২:১৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০২৩

নেজা ডেস্ক :
ষাটের দশকের নেত্রকোণায় ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। তৎকালিন নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, শহীদ মেহের আলী একটি নাম, একটি ইতিহাস। ষাটের দশকে নেত্রকোণায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে নামটি বার বার উচ্ছারিত হবে তিনিই হলেন শহীদ মেহের আলী। ১৯৪১ সালে নেত্রকোণা পৌরসভার ইসলামপুর এলাকায় জন্মগ্রহণ করা এই কিংবদন্তী ছাত্র নেতার প্রকৃত নাম ছিল মো: মেহের আলী, পিতা মো: আক্তার আলী, মাতা মোসাম্মৎ তুলাজান বিবি। ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সাংগঠনিক দক্ষতা ও মানসম্মত নেতৃত্বের গুনাবলীসহ বিরল প্রতিভার অধিকারী। তিনি তাদের মালনী রোডের বাসায় থেকে  তার সফল ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক জীবন গড়ে তোলেন। ব্যক্তিগত জীবনে ৩ সন্তানের জনক তিনি। তার স্ত্রী রওশনারা বেগম।

এক সন্তান অস্ট্রেলীয়াতে সফল ইন্জিনীয়ার  এবং অধ্যাপনায় নিযুক্ত আছেন। বিশ্বমানবাধিকার ও পরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক সংস্থা  ‘‘Amnesty International”  and  “Green Peace” -এর সাথে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ‘‘Bangladesh Martyrs Memorial Research Center” and “Bangladesh Muktijudho Research Institute’’ -প্রতিষ্ঠান দুটির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা, জাতির বীর সন্তানদের পরিবারের সদস্যদের বিভিন্নভাবে সহায়তা ও তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে কাজ করে যাচ্ছেন । আরেক সন্তান এডভোকেট ।

ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১’এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যত আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে তার প্রতিটিতেই মেহের আলীর স্বরব উপস্থিতি ও নেতৃত্ব নেত্রকোণাবাসী চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের ঊষালগ্নে নেত্রকোণার রাজনীতির আকাশে এক উজ্বল নক্ষত্র হলেন শহীদ মেহের আলী। শহীদ মেহের আলী সম্বন্ধে এক আলাপচারিতায় ঐ সময়ের আরেক ছাত্রনেতা নেত্রকোণা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: শামছুজ্জোহা বলেছেন, মেহের আলী ভাই সর্ম্পকে বলার আগে আমি ষাটের দশকের সময়টার কথা কিছু বলতে চাই। আজকাল রাজনীতি করা ও নেতা হওয়া খুব সহজ। কিন্তু তখনকার যুগে রাজনীতি করা মানে নিশ্চিত জেল হাজতে যাওয়া নতুবা মৃত্যু। কারণ পাকিস্থান সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে বা শ্লোগান তুললেই জেল জুলুম হুলিয়া জারী হয়ে যেতো। আন্দোলন সংগ্রামের আবাস ইঙ্গিত পেলেই ১৪৪ ধারা জারী অথবা কারফিউ দিয়ে নেতা কর্মী ও জনগনের উপর অত্যাচার নির্যাচনের ষ্ট্রিম রোলার চালাতো। এমনকি নেতা কর্মীদের হত্যা করতেও পিছু পা হতো না। আমরা সেই কঠিন সময়গুলোতে মেহের আলী ভাইয়ের নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রাম করেছি।

১৯৬৪ সালের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলেই মেহের আলী ভাইয়ের গুরুত্ব বোঝা যাবে। সেদিন দেশব্যাপী সাধারণ ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। এই ধর্মঘটে নেত্রকোণায় ছাত্র সমাজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে মিছিল মিটিং-এ নেত্রকোণার তৎকালিন মুসলিম লীগের পেটুয়াবাহিনী হামলা চালায় আওয়ামীলীগ অফিসের সামনে। এই হামলায় ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতা কর্মীসহ মেহের আলী ভাই রক্তাক্ত জখম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে আহত অবস্থায় মেহের আলী ভাইয়ের নেতৃত্বে সম্মিলিত ছাত্র সমাজের পাল্টা হামলা চালালে মুসলিম লীগের গুন্ডা বাহিনি পালিয়ে যায়।

১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সারা দেশব্যাপী ধর্মঘট ডাকা হয়। নেত্রকোণায় ধর্মঘট চলাকালে মোহনগঞ্জ থেকে একদল ছাত্রকর্মী সভায় যোগ দিতে ট্রেনযোগে নেত্রকোণায় আসছিল। সেদিন ট্রেনে মোবাইল কোর্ট বিনা টিকেটে যাত্রীদের সাথে আগত ছাত্রকর্মীদেরকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ নেওয়ার পথে নেত্রকোণার ছাত্র সমাজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে নেত্রকোণা বড় ষ্টেশনে ট্রেন আটকিয়ে ভাংচুর করে ছাত্রকর্মীদেরকে ছিনিয়ে আনে। রেল কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করলে নেত্রকোণাবাসীর উপর সরকারের নির্দেশে পাইকারী জরিমানা ধার্য করা হয়। সেই সাথে ছাত্রনেতা মেহের আলী ভাইসহ বেশ কিছু নেতাকর্মীকে পুলিশ ধরে জেল হাজতে প্রেরণ করে। নেত্রকোণার এই ঘটনা সেদিন বিবিসি, ভয়েজ অফ অ্যামেরিকা ও আকাশবাণী কলকাতা থেকে খবর প্রকাশ হয়েছিল। শহীদ মেহের আলী তৎকালিন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছাত্র সংগঠন পূর্বপাকিস্থান ছাত্রলীগ করতেন। তিনি বিশ্বদ্যালয়ের পাশাপাশি নেত্রকোণার আন্দোলগুলোতেও নেতৃত্ব প্রদান করেছেন।বিশ্বদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে  তৎকালীন ডাকসু সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে ছিল।পাশাপাশি জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথেও উনার ভাল যোগাযোগ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্র আন্দোলন তথা জাতীয় আন্দোলনগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছেন ও গুরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন । আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা প্রসিডিয়াম মেম্বার এডভোকেট সৈয়দ আহমেদ ছিলেন মেহের আলীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

অন্যকে সম্মান করলে নিজের সম্মান বাড়ে।মেহের আলীকে নিয়ে আরো গবেষনা করা প্রয়োজন। উনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের জাতীয় পর্যায়ের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস তুলে আনতে পরলে তা আমাদের নেত্রকোনার ইতিহাস ও ঐহিহ্যকে সম্মৃদ্ধ করবে। মনে রাখতে হবে যারা দেশের তথা জাতির জন্য কাজ করেছেন তারা কোন পরিবার বা গোষ্ঠীর সম্পদ নয় তারা পুরো বাংগালী জাতির অহংকার। নেত্রকোণায় ছাত্র সংগঠন করার লক্ষ্যে নেত্রকোণা আওয়ামীলীগ নেতা আবদুল খালেকের পত্র নিয়ে মেহের আলী ও শামছুজ্জোহা ঢাকা গিয়ে গুলিস্থানে (বঙ্গবন্ধু এভ্যিনিউ) আলফা লাইফ ইন্সুরেন্স অফিসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং খালেক সাহেবের পত্র হস্তান্তর করেন। বঙ্গবন্ধু তাদের কথা শুনে একটি চিরকুট লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি’র নিকট পাঠিয়ে দেন। চিরকুটে লেখা ছিলো এরা নেত্রকোণা থেকে এসেছে ছাত্রলীগ করতে চায়। শেখ মনি মেহের আলী ও শামছুজ্জোহার সাথে আলাপ আলোচনা করে ছাত্রলীগের আদর্শ উদ্দেশ্য সর্ম্পকে বলে কিছু ছাপানো লিফলেট গঠনতন্ত্র ও কিছু পুস্তিকা দিয়ে তাদেরকে নেত্রকোণা পাঠিয়ে দেন এবং সর্তক করে দেন এসব বই পত্র যেনো পুলিশের হাতে না পড়ে, পড়লে কিন্তু নির্ঘাত জেল।

বস্তুত নেত্রকোণা ছাত্রলীগ সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাণ পুরুষ ছিলেন শহীদ মেহের আলী। শহীদ মেহের আলী নেত্রকোণা শুধু ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না তিনি নেত্রকোণা জেলা শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। শহীদ মেহের আলী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দক্ষতা এবং সাংগঠনিক কর্মকান্ডে বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে সরাসরি শ্রমিকলীগের রাজনীতিতে চলে আসেন। তিনি ছিলেন নেত্রকোণা আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির শ্রম ও কৃষি বিষয়ক সম্পাদক। সর্বজন শ্রদ্ধেয় সর্বজনাব মজির উদ্দিন মোক্তার, আব্দুল মমিন, আব্দুল খালেক, ফজলুর রহমান খান, কে. এম. ফজলুল কাদের, এন.আই. খান, আব্বাস আলী খান, কথা সাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী  , ডাঃ জগদীশ দত্ত, ডাঃ আকলাকুল হোসাইন আহমেদ, হাদিস চৌধুরী , আব্দুল মজিদ তারা মিয়া, প্রমুখদের সাথে তিনি রাজনীতি করেছেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান এঁর নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিমুদ্ধের শহীদ মেহের আলী ছিলেন এক সংশপ্তক সূর্য্য সৈনিক। যাদেরকে তিনি নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন তারা হলেন সর্বজনাব মোঃ শামছুজ্জোহা, মতিউর রহমান খান, সাফায়েত আহমেদ খান, আশরাফ আলী খান খসরু, হায়দার জাহান চৌধুরী , গোলাম এরশাদুর রহমান, আলাউদ্দিন খান, গাজী দেলওয়ার হোসেন, বাদল মজুমদার ও আবদুর রহীম প্রমুখ ছাত্রনেতা।

মেহের আলী “একুশে পদক” প্রাপ্ত সাহিত্যিক এবং বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের প্রতাষ্ঠাতা সভাপতি সাংবাদিক ভাষা সৈনিক জনাব  সানাউল্লাহ নূরীর বাসায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা  করেন৷ মেহের আলী রাজনীতি,সাহিত্য ও সংস্কৃতির তালিম নিয়েছেন তৎকালীন মুসলমিলীগ ছাত্রলীগের সভাপতি নেত্রকোণা  জেলা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী সাবেক এম.পি আব্দুল খালেক সাহেব ও জনাব   সানাউল্লাহ নূরীর কাছ থেকে।জনাব আব্দুল খালেক সাহেব দীর্ঘ ১০/১২ বছর মেহের আলীদের বাড়ীতে ছিলেন এবং আঞ্জুমান স্কুল ও নেত্রকোনা কলেজে পড়াশোনা করেছেন। এখান থেকেই তিনি ছাত্র রাজনীতি হতে দলীয় রাজনীতির নেতৃত্বে উঠে আসেন। এ বাড়ী থেকেই নেত্রকোনা তেভাগা আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ত দিয়েছেন  তমদ্দুন মজলিসের নেত্রকোনা শাখার সভাপতি, “একুশে পদক” প্রাপ্ত সাহিত্যিক এবং বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের প্রতাষ্ঠাতা সভাপতি ভাষা সৈনিক সাংবাদিক জনাব  সানাউল্লাহ নূরী। । এই বাড়ীতে তিনি ৮-১০ বছর ছিলেন।তিনি আঞ্জুমান স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন।

জনাব নূরী পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক আবূল কাসেমের ভাগনীকে বিয়ে করেন।জাতীয় অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবূল কাসেম ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক। জনাব নূরীও ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন । তার নাম জাতির ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লিখা আছে। মেহের আলীর সাথে জনাব নুরীর সম্পর্কটা ছিল বড় ভাইয়ের মতো।জনাব নুরী ঢাকায় চলে যাবার পরও মেহের আলীর সাথে গভীর যোগযোগ ছিল।মেহের আলী স্কুল কলেজে পড়াকালীন ঢাকায় গেলে জনাব নুরীর বাসায় থাকত।  পরবর্তীতে মেহের আলী জনাব নুরীর বাসায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। জনাব নুরীর মাধ্যমে মেহের আলী যে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে আসেন তারা হলেন অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবূল কাসেম(ভাষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক -জনাব নুরীর মামা শ্বশুর), মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী,অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, কবি জসীমউদ্দীন, আর্টিষ্ট কামরুল হাসান,সওগাত সম্পাদক মো নাছির উদ্দীন,ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া,শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেন,ডঃ কুদরত-ই-খুদা, লাঠিবাহিনীর সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল হক চৌধুরী, শিক্ষাবিদ সেলিনা বাণু প্রমুখ। ঐ সকল জাতীয় ব্যক্তিদের দ্বারা মেহের আলী রাজনীতি,সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয় । তার ডায়েরীর উদ্ধারকৃত কয়েকটি পাতায় লিখিত কবিতা ও গল্প  থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৯৬২ সালে রেল  অবরোধ ও ভাংচুরের মামলায় মেহের আলী বেশ কিছুদিন জেল হাজতে ছিলেন। জেলখানায় বসে মেহের আলী পাকিস্থানি সামরিক নির্যাতন এর বিরুদ্ধে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কচি-কাঁচার মেলা নামে একটি শিশু-কিশোর সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পণা করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬৩ সনের জানুয়ারি মাসে মধুমাছি কচিকাঁচার মেলা গঠন করেন। তিনি ছিলেন মধুমাছি কচিকাঁচার মেলার প্রধান উদ্যেক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক । মেলার পরিচালক হিসেবে ছিলেন জনাব এডভোকেট একে ফজলুল কাদের, আর উপদেষ্টা মন্ডলীতে ছিলেন- সর্বজনাব এন আই খান,জনাব আব্দুল খালেক, জনাব খালেকদাদ চৌধুরী, ডা. জগদীশ দত্ত, এডভোকেট ফজলুর রহমান খান,মাওলানা ফজলুর রহমান খান,হাবিবুর রহমান খান  প্রমুখ। জনাব মেহের আলী শামসুজ্জোহাকে আহ্ববায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আয়েশা খানমকে আহ্ববায়িকা করে কমিটি গঠন করে দেন। এরই মধ্যে ডাকসু নির্বাচন চলে আসে। মেহের আলী   ডাকসু নির্বাচনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন পূর্বপাকিস্থান ছাত্রলীগের প্রার্থীদেরকে বিজয়ী করবার জন্যে। কিন্তু সে নির্বাচনে ৯০টি আসনের মধ্যে ৮০ টি আসনে র্পূর্বপাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়ন জয় লাভ করে(হল ও কেন্দ্রীয় সংসদ মিলিয়ে)। বিশ্ববিদ্যালয়  অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৯৬৪ সনে ১লা,২রে মে কবি সুফিয়া কমাল ও রোকনোজ্জামান দাদা ভাইসহ মেলার পরিচালকবৃন্দের ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নেত্রকোণায় নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, তখন নেত্রকোণায় ঐ প্রথম দুদিনব্যাপী এতবড়  বিচিত্রানুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে মেলার ভাইবোনদের একটি দল কুচ-কাওয়াজ ও শরীর চর্চা প্রদর্শন করে। দাদা ভাই খুশী হয়ে দলটির নাম দেন শেরে বাংলা বাহিনী। শেরে বাংলা বাহিনী এখনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে কুচ-কাওয়াজ ও শরীর চর্চা প্রদর্শন করে।

পরবর্তীতে  জনাব মতিয়ুর রহমান খানকে আহ্ববায়ক ও চামেলী খুরশিদকে আহ্ববায়িকা করে কমিটি গঠন করে দেয়া হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৫ সালে দায়িত্বে আসি আমি হায়দার জাহান চৌধুরী ও খনা সেন রায় আহ্ববায়ক ও আহ্ববায়িকা হিসেবে । পরে আলাউদ্দীন খান ও রেজিয়া রহমান ছবি  আহ্ববায়ক ও আহ্ববায়িকা হিসেবে দায়িত্বে আসেন। এরপর যারা আহ্ববায়ক হিসেবে দায়িত্বে আসেন তারা হলেন-জনাব আনোয়ারুল হক ভূইয়া, জসিম উদ্দীন ভূইয়া,দিলুয়ারুল হক ভূইয়া,এ টি এম মন্জুরুল হক,বিপুল সাহা,সাকী,রবিন,ইমু। এই কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক র্কমকান্ডের আড়ালে রাজনৈতিক র্কমকান্ড চালানোর উদ্দ্যেশেই মেহের আলী আইযুব বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগকে সুকৌশলে সম্পৃক্ত করেছিলেন।এরপর মেহের আলী   নেত্রকোনা শ্রমিকলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে এটিকেও একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করেন। তিনি নেত্রকোনা জেলা আওয়ামীলীগের শ্রম ও কৃষি বিষয়ক সম্পাদক হন। মেহের আলী  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন কেন্দ্রীয় কচিকাচার মেলার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং কবি সুফিয়া কামাল ও রোকনোজ্জামান  দাদা ভাইয়ের সাথে অত্যন্ত সুসম্পর্ক গড়ে তুলেন। ১৯৬৪ সালে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনারের অন্যতম স্থপতিও ছিলেন তিনি।

১৯৬০ সালে মার্শাল’‘ল’ বিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন নেত্রকোণার ছাত্র সংস্থার ভূমিকা উল্লেখ করার মত। এই ছাত্র সংস্থার ব্যানারেই ‘ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ’ শ্লোগানকে সামনে রেখে ও গোপণীয়তা বজায় রেখে মার্শাল ‘ল’ বিরোধী বিভিন্ন ভাষার হাতের লেখা পোস্টার রাতের অন্ধকারে শহরে সাঁটিয়ে দিয়ে জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করে এক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে নেত্রকোণার ছাত্র সংস্থা নামে এই সংগঠনটি। নেত্রকোণা ছাত্র আন্দোলনকে সামনে রেখে এই সংগঠনটি প্রাথমিক পর্যায়ে গোপনে, পরবর্তীতে প্রকাশ্যে ছাত্রদেরকে সংগঠিত করে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে শুরু করে। সেই সময়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা যেমন-সত্যকিরণ আদিত্য, আব্দুল খালেক, ওয়াজেদ আলীসহ প্রমুখ এই ধরনের প্রক্রিয়ার নেপথ্যে কাজ করছিলেন। কিংবদন্তী ছাত্রনেতা জনাব মেহের আলী সর্বজনাব জামাল উদ্দিন আহমেদ, মো: শামছুজ্জোহা, গাজী মোশারফ হোসেন, টি.এ রহমত উল্লাহ, নুরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান খান, আব্দুস সাত্তার প্রমুখ নেতাদের নিয়ে ছাত্র সংস্থা গড়ে তুলেন ।

এরপর ১৯৬২ সালে নেত্রকোনা মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে   জনাব মেহের আলী ও জনাব শামসুজ্জোহাকে প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী করে কমিটি করে দেয়া হয়। ঐ কমিটির অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্যবৃন্দ যারা ছিলেন তারা হলেনঃসর্বজনাব  জামাল উদ্দিন আহম্মেদ(সহ-সভাপতি) , বিপ্লব চক্রবর্তী, মতিয়র রহমান খান, শহিদ উদ্দিন আহমেদ, আ: মান্নান, আব্দুর রহমান, আব্দুল ওয়াহেদ, আলাউদ্দিন খান, আশরাফ আলী খান খসরু, হায়দার জাহান চৌধুরী (লেখক), ধীমান রঞ্জন বিশ্বাস (ভারত প্রবাসী)।  শুরু হয় নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন জেলা ছাত্রলীগের অভিযাত্রা। এই কমিটি তিন বছর দায়িত্ব পালন করে। জনাব মেহের আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার পর সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় জনাব জামাল উদ্দিন আহম্মেদকে।

আইয়ুব খানের মার্শাল’ ল’ বিরোধী গোপণ আন্দোলনের সূত্র ধরেই ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৬২’র হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবীতে দেশব্যাপী ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এরই পথ ধরে ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র সর্বদলীয় ছাত্রসমাজের ১১ দফা আন্দোলন যাহা গণআন্দোলনের রূপ নিয়ে পাকিস্থানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়ে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন মেহের আলী বঙ্গবন্ধুর সাথে একই মঞ্চে বহুবার বক্তব্য প্রদান করেছেন। ঐ সময় দল ছিল আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিকলীগ।

ছাত্রদের পরপরই যে দুটো গ্রুপ সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল তা হলো শ্রমিক ও কৃষক সমাজ। জেলা আওয়ামীলীগের শ্রম ও কৃষিবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে জনাব মেহের আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয় এই দুটো শক্তিশালী গ্রুপকে সংগঠিত ও স্বাধীকার আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য। মেহের আলী অত্যন্ত সফলভাবে তা সম্পন্ন করেন এবং ছাত্র,কৃষক, শ্রমিক ও জনতার প্রাণের নেতায় পরিণত হন। অতএব জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, শ্রমিকলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং জেলা আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী শ্রম ও কৃষিবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে প্রটোকল অনুযায়ী সব অনুষ্ঠানেই মেহের আলীর বক্তব্য দেয়ার সুযোগ এসে যেত। উপরন্তু প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ থাকায় একটা বাড়তি সুবিধাতো অবশ্যই মেহের আলী পেতেন।

৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ও সেই সাথে আরেক সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আগমন ঘটে। সেই সামরিক শাসক ছাত্র গণআন্দোলনের মুখে ৭০’র জাতীয় নির্বাচন এবং ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে নেত্রকোণা এলাকায় কিংবদন্তী ছাত্রলীগনেতা বীর মুক্তিমুযোদ্ধা শহীদ মেহের আলীর নাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণসহ নেত্রকোণার প্রতিরোধ যুদ্ধে মেহের আলী অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন। নেত্রকোণা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র ও যুব সমাজকে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে মেহের আলীর বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নেত্রকোণার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে ভারতের মহেশখলা যাওয়ার পথে মধ্যনগর থানার দুগনৈ গ্রামে তাঁর শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন মধ্যনগর সহ আশপাশ এলাকার ছাত্র যুবকদেরকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করবার জন্য।

বঙ্গবন্ধুর ৬দফার দাবীসহ ৬৯,৭০,৭১এর আন্দোলনগুলোকে নেত্রকোনার পাশাপাশি এই অঞ্চলেও জনপ্রিয় করে তোলেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এই অঞ্চলের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা  আকিকুর রেজা ভূইয়া ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও ধর্মপাশা উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়ালকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক   করে মধ্যনগর থানার মধ্যে প্রথম দুগনৈ গ্রামে মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে দেন। পরবর্তীতে তিনি  মোঃ আকিকুর রেজা ভূইয়াকে সভাপতি ও আব্দুল আউয়ালকে সহ-সভাপতি এবং বাদল চন্দ্র দাসকে সাধারণ সম্পাদক  করে মধ্যনগর থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে দেন। মেহের আলী সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে মধ্যনগর থানার ছাত্র ও যুব সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে থাকেন ও তাদের  থাকা খাওয়া এবং ট্রেনিংয়ের জন্য ইন্ডিয়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। সংগঠিত করতে থাকেন ও তাদের  থাকা খাওয়া এবং ট্রেনিংয়ের জন্য ইন্ডিয়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।  এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে মেজর মোত্তালিব (পরবর্তীতে যিনি সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন)  ও ক্যাপ্টেন গণীর নেতৃত্তে কয়েকশ সামরিক কর্মকর্তা ও ই পি আর সদস্য  দুগনৈ গ্রামে আসলে মেহের আলী উনার শ্বশুর বাড়ীতে কয়েকদিনের জন্য তাদের  সকলের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং নিরাপদে ট্রেনিংয়ের জন্য ইন্ডিয়াতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়াও মেহের আলী উনার শ্বশুর  রহমত আলী তালুকদারের বাড়ী থেকে শত শত মণ ধান, চাল, অন্যান্য সামগ্রী মহেষখলা ক্যাম্পে পাঠান যাহা ক্যাম্প পরিচালণায় অত্যন্ত গুরুত্ত্বর্প্ণূ ভুমিকা পালন করে।

সে সময় তিনি মধ্যনগরসহ আশপাশ এলাকার ছাত্র যুবকদেরকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য মহেশখলা যাওয়ার পর কতিপয় দুষ্কৃতিকারী ও চক্রান্তকারী সশস্ত্র ব্যক্তিগণ (যাদের বিরুদ্ধে বহু নিরীহ নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা,নির্যাতন ও লুন্ঠনের গুরুতর অভিযোগ ছিল– যার বর্ণনা আমাদের নেত্রকোনার গর্ব জাতীয় সাহিত্যিক বাংলা একাডেমী ও একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মহেষখলা ক্যাম্প পরিচলনা কমিটির অন্যতম সদস্য জনাব খালেকদাদ চৌধুরী তার অমরগ্রন্থ “শতাব্দীর দুই দিগন্ত“ বইটিতে উল্লেখ করে গেছেন।) মেহের আলীকে ব্যাংক লুটের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সেকান্দর নুরীর লোকেরা হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে  তিনি অন্যতম যিনি প্রথম ১৯৭১ সালের ১৭ই মে মহেষখলায় শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের খরচ ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে জাতীয় প্রয়োজনে জয়বাংলা বাহিনীর প্রধান কোম্পানী কমান্ডার সাবেক আওয়ামীলীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মো: শামসুজ্জোহার নেতৃত্তে বীরমুক্তিযোদ্ধা  বুলবুল ইপিআর সদস্যসহ অন্যান্যদরকে নিয়ে পুলিশের অস্ত্রাগার ও ব্যাংক লুট করেন (“মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা বইটিতে  সাবসেক্টর কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা  হায়দার জাহান চৌধুরী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন)। এই ঘটনার সাথে শহীদ মেহের আলীর বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা ছিলনা । অথচ নিরপরাদ মানুষটিকে হত্যা করা হলো। মেহের আলীকে হত্যার পরপরই বীরমুক্তিযোদ্ধা মো: শামসুজ্জোহা ও সাবেক আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আমরিুল ইসলামকেও গ্রেফতার করা হয় হত্যার জন্যে। সৌভাগ্যক্রমে তারা প্রাণে বেচে যান। স্মরণীয় যে, স্বাধীনতা লাভের মাত্র ৭ দিনের মধ্যে পরবর্তীকালে সেকান্দর নুরী নিহত হয়েছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন, এটি ছিলো জনাব মেহের আলী হত্যার অনিবার্য পরিণতি।

ষাটের দশকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান ও মুক্তিযু্দ্ধে জীবন বিসর্জনের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নেত্রকোণা পৌরসভায় ১৯৯৮ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে অজহর রোডের মোড় থেকে পূর্বদিকে ইসলামপুর পর্যন্ত এই রাস্তাটির নামকরণ করেছে – মুক্তিযোদ্ধা মেহের আলী সড়ক। স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান ও মুক্তিযু্দ্ধে জীবন বিসর্জনের জন্য “বিজয় একাত্তর সম্মাননা-২০২২”  এবং ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন কলেজ ও লোকসাহিত্য গবেষণা একাডেমি সম্মাননা স্মারক ২০২২ প্রদান করা হয়। মাননীয় সংসদ সদস্য  হাবিবা রহমান খান(শেফালী) ২০১৫ সালে  নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুলের একটি গেইটের নামকরণ করেন “বীর মুক্তিযোদ্ধা  মেহের আলী  গেইট”, শহীদ মেহের আলী স্মৃতি পরিষদ ও শহীদ মেহের আলী স্মৃতি যুব জাগরণ সমিতি, মালনী রোড(বর্তমানে সমিতি ঘরটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়েছে) নামে দুটি সংগঠন গড়ে তোলা হয় । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে শহীদ মেহের আলীর পরিবারের জন্য এক হাজার টাকা সম্মানী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। মেহের আলী হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনো অনুদঘাটিত। ভবিষ্যতে এই হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচনের জন্য আগামী প্রজন্মকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

[ লেখাটি নেত্রকোনার গর্ব জাতীয় সাহিত্যিক বাংলা একাডেমী ও একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,মহেষখলা ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য জনাব খালেকদাদ চৌধুরীর অমরগ্রন্থ “শতাব্দীর দুই দিগন্ত“,প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট সাবসেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিমুযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক,প্রাবন্ধিক সাবসেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিমুযোদ্ধা গোলাম এরশাদুর রহমানের মুক্তিসংগ্রামে নেত্রকোনা,  প্রখ্যাত সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক,প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ননী গোপাল সরকারের প্রবন্ধ “অগ্নিযুগের সূর্য সৈনিকঃ  বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মেহের আলী”, বিজয়’৭১-২য় সংখ্যা(পুনমূদ্রন)/২০২২( একটি সাহিত্য ও গবেষনাধর্মী পত্রিকা), ভাষা সংগ্রামের জন্যে রাষ্ট্রিকিট হওয়া মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ভাষা সৈনিক আজিম উদ্দীন আহমেদ সাহেবের প্রবন্ধ “,অসমাপ্ত গল্প” , মধ্যনগর থানা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের  সভাপতি  জনাব মোঃ আকিকুর রেজা ভূইয়ার বই “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কথা”(যিনি বাংলাদেশ সচিবালয়ের হিসাব নিরীহ্মা অধিদপ্তরের সহপরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহন করেন।),বিভিন্ন জাতীয় ব্যক্তিত্ত্বের সাক্ষাৎাকার, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার,স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎাকার, বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা,টিভি সংবাদ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও,অডিও ও মেহের আলীর ডায়েরী অবলম্বনে লেখা হয়েছে।]