জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা : বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী

জন্মের পর থেকে কচি-কাঁচার মেলা ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি নেত্রকোণা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে

প্রকাশিত: ২:৩৪ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৩০, ২০২৩

নেজা ডেস্ক :
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যখন পাকিস্তানী স্বৈরশাসকের দ্বারা বাধাগ্রস্থ হতো তখন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের আবরণে রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে চালিয়ে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা নিয়েই তৎকালীন পূর্ববাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ছত্রছায়ায় শিশু সংগঠনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই কচি-কাঁচা মেলা নামে একটি শিশু সংগঠন গড়ে তোলার  চিন্তা ভাবনা করতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক আন্দোলনের যে গতি সৃষ্টি হয় তা পূর্ব বাংলার বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মনোবল ও সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঞ্চার করে।

পূর্ববাংলার বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর আপন স্বাতন্ত্র, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ভাষা সংস্কৃতি, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাঙ্গালীর নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনেই ১৯৫৬ সালে সাহসিকা জননী কবি বেগম সুফিয়া কামালের ঢাকার তারাবাগের বাসভবনে দাদাভাই রোকনুজ্জামান খানের পরিচালনায় কচি-কাঁচা মেলার জন্ম হয়। এর স্বপ্নদ্রষ্টারা সেদিন সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি। ৬০ দশকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কচি-কাঁচা মেলা দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করে বাঙ্গালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস চালায়। ৬০ দশকে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেত্রকোণা মধুমাছি কচিকাঁচার মেলার জন্ম হয়েছিল।

জন্মের পর থেকে কচি-কাঁচার মেলা ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি নেত্রকোণা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। মধুমাছি কচি-কাঁচার ভাই বোনেরা পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতীয় দিবসসহ নজরুল, রবীন্দ্র জয়ন্তী, ১লা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, ঈদ উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে নিজেদের দেশীয় সংস্কৃতি প্রদর্শন করে দর্শকদের আনন্দিত করেছে। নেত্রকোণা অন্যান্য শিশু কিশোর সংগঠনের অনুষ্ঠানাদির চেয়ে কচি-কাঁচার মেলার অনুষ্ঠানাদি ছিল একটা ভিন্ন মাত্রার। কচি-কাঁচা মেলায় সাধারণত দেশীয় সংস্কৃতি ও খেলাধুলার প্রাধান্য ছিল বেশী। হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্দা, বৌছি, কুস্তি খেলা, ব্রতচারি, লাটি খেলা বিশেষ করে গ্রাম বাংলার ঐতিয্যবাহী সব ধরনের খেলাধুলার প্রচলন ছিল। পাশাপাশি দেশাত্মবোধক সংগীত, নৃত্যকলা, নাটক, কবিতা আবৃত্তিসহ জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি গানের মুর্ছনা ছিল মেলার ভাই বোনদের প্রাণের ষ্পন্দন। আর এই স্পন্দনেই এ অঞ্চলের মানুষকে জাগরিত করেছে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে।

১৯৬২ সালে রেল  অবরোধ ও ভাংচুরের মামলায় মেহের আলী বেশ কিছুদিন জেল হাজতে ছিলেন। জেলখানায় বসে মেহের আলী পাকিস্থানি সামরিক নির্যাতন এর বরিুদ্ধে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কচি-কাঁচা মেলা নামে একটি শিশু-কিশোর সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পণা করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬৩ সনের জানুয়ারি মাসে মধুমাছি কচিকাঁচার মেলা গঠন করেন। তিনি ছিলেন মধুমাছি কচিকাঁচার মেলার প্রধান উদ্যেক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক ।

মেলার পরিচালক হিসেবে ছিলেন জনাব এডভোকেট একে ফজলুল কাদের, আর উপদেষ্টা মন্ডলীতে ছিলেন- সর্বজনাব এন আই খান,জনাব আব্দুল খালেক, জনাব খালেকদাদ চৌধুরী, ডা. জগদীশ দত্ত, এডভোকেট ফজলুর রহমান খান,মাওলানা ফজলুর রহমান খান, হাবিবুর রহমান খান  প্রমুখ। জনাব মেহের আলী শামসুজ্জোহাকে আহ্ববায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আয়েশা খানমকে আহ্ববায়িকা করে কমিটি গঠন করে দেন। এরই মধ্যে ডাকসু নির্বাচন চলে আসে। মেহের আলী   ডাকসু নির্বাচনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন পূর্বপাকিস্থান ছাত্রলীগের প্রার্থীদেরকে বিজয়ী করবার জন্যে। কিন্তু সে নির্বাচনে ৯০টি আসনের মধ্যে ৮০ টি আসনে র্পূর্বপাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়ন জয় লাভ করে(হল ও কেন্দ্রীয় সংসদ মিলিয়ে)। মেহের আলী  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন কেন্দ্রীয় কচিকাচার মেলার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং কবি সুফিয়া কামাল ও রোকনোজ্জামান  দাদা ভাইয়ের সাথে অত্যন্ত  সুসম্পর্ক গড়ে তুলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদালয়  অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৯৬৪ সনে ১লা,২রে মে কবি সুফিয়া কমাল ও রোকনোজ্জামান দাদা ভাইসহ মেলার পরিচালকবৃন্দের ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নেত্রকোণায় নিয়ে আসেন। এদের মধ্যে ছিলেন কেন্দ্রীয় মেলার উপদেষ্ঠা সর্ব জনাব শামছুজ্জামান খান,হাসেম খান,মাহবুব তালুকদার, ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদিকা নুরজাহান বেগম, সুলতানা কামাল,শিমূল বিল্লা ও মিনু বিল্লাসহ সংগীত ও নৃত্যকলার শিল্পীবৃন্দ। তাদের আগমনে মধুমাছি কচি-কাঁচার মেলার ২ দিন ব্যাপী এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করে। দুই দিনের এই উৎসব শুধু মেলার ভাই বোনদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না। উৎসব ছড়িয়ে পড়ে শহরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দলে দলে শিক্ষার্থীরা কবিকে এক নজর দেখতে ছুটে এসেছিল মেলার প্রাঙ্গণে।

সেই অনুষ্ঠানে মেলার ভাইবোনদের একটি দল কুচ-কাওয়াজ ও শরীর চর্চা প্রদর্শন করে। দাদা ভাই খুশী হয়ে দলটির নাম দেন শেরে বাংলা বাহিনী। আজও শেরেবাংলা বাহিনী বিভিন্ন জাতীয় দিবসে নিজেদের ঐতিহ্য তুলে ধরেন। পরবর্তীতে  জনাব মতিয়ুর রহমান খানকে আহ্বায়ক ও চামেলী খুরশিদকে আহ্বায়িকা করে কমিটি গঠন করে দেয়া হয় ১৯৬৪ সালে।১৯৬৫ সালে দায়িত্বে আসেন জনাব হায়দার জাহান চৌধুরী ও খনা সেন রায় আহ্বায়ক ও আহ্বায়িকা হিসেবে । পরে আলাউদ্দীন খান ও রেজিয়া রহমান ছবি  আহ্বায়ক ও আহ্বায়িকা হিসেবে দায়িত্বে আসেন। এরপর যারা আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্বে আসেন তারা হলেন-জনাব আনোয়ারুল হক ভূইয়া, জসিম উদ্দীন ভূইয়া,দিলুয়ারুল হক ভূইয়া,এ টি এম মন্জুরুল হক,বিপুল সাহা,সাকী,রবিন,ইমু।

আর এদের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে নেত্রকোণা মধুমাছি কচি-কাঁচার মেলা নামে ঐতিয্যবাহী এই শিশু কিশোর সংগঠনটি। বর্তমানে মধুমাছি কচি-কাঁচা বিদ্যানিকেতন নামের স্কুলটি কচি-কাঁচাদের ঠিকানা। আমি আগেই বলেছি একটি সূদুর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই এই ঐতিহাসিক শিশু সংগঠনটি জন্ম হয়েছিল। জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই সংগঠনটি এদেশের শিশু-কিশোরদের মাঝে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ উন্নয়ন, বিজ্ঞান প্রযুক্তিসহ আদর্শ দেশপ্রেমিক, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছে। কচি-কাঁচা মেলা থেকে বেরিয়ে আসা অনেক ছাত্র যুবকেরা ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে  মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অংশ নিয়েছেন। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেই দেশ বিদেশে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন।

জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই সংগঠনটি এদেশের শিশু-কিশোরদের মাঝে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ উন্নয়ন, বিজ্ঞান প্রযুক্তিসহ আদর্শ দেশপ্রেমিক, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছে। ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব নেত্রকোণা মেলার উপদেষ্ঠা মন্ডলীসহ কর্মী ও সাথী ভাইদের অনেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। ‘৭১ এ প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এরকম অনেক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নেত্রকোণার মধুমাছি মেলার সদস্য।

মেলার প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক মোঃ শামছুজ্জোহা মুক্তিযুদ্ধে একজন কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে মুক্তিবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে ১১ নং সেক্টরে বিভিন্ন রণাঙ্গণে  হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আমি নিজেও ১১নং সেক্টরে বি.এল.এফ (মুজিব বাহিনী) এর উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের একজন গর্বিত সৈনিক। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আশরাফ আলী খান খসরু(প্রাক্তন এম.পি), খন্দকার আনিসুর রহমান, শহীদ ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন, আলাউদ্দিন খান, আব্দুল মতিন, উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত, মোঃ সিরাজ উদ্দিন, ইসলাম উদ্দিন খান (কালা মিয়া), প্রদীপ কুমার জোয়াদার,মতিউর রহমান তালুকদার,বাদল মজুমদার নেত্রকোণার মধুমাছি কচি-কাঁচার মেলার সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মেলার প্রতিষ্ঠাতা আহবায়িকা আয়শা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আগড়তলা ২নং সেক্টরে মেলাগড় ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।

তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নারী মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মেলার প্রধান উদ্যেক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক শহীদ মেহের আলী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় নিহত হন। মেলার পরিচালক কে.এম.ফজলুল কাদের এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ যথাক্রমে মরহুম খালেকদাদ চৌধুরী, মরহুম এন.আই. খান, মরহুম আব্দুল খালেক এম.পি.মরহুম ফজলুর রহমান খান, মরহুম মাওলানা ফজলুর রহমান খান, মরহুম হাবিবুর রহমান খান ও ডাঃ জগদীশ চন্দ্র দত্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ১১নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও রিফিউজি ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। আবার অনেকে ক্যাম্প-ইনচার্জ হিসেবেও মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। নেত্রকোনা কচি-কাঁচার মেলা সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য অবদান। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গর্বিত অংশীদার হিসেবে আমাদের নেত্রকোণার মধুমাছি কচি-কাঁচা মেলার নাম স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এই লেখকের লেখা আরও পড়ুন……
ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতি ও ৭১’- র মুক্তিযুদ্ধ : বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
শহীদ মেহের আলী একটি নাম, একটি ইতিহাস : বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
নেত্রকোণায় বঙ্গবন্ধু: বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী

বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী:
(নেত্রকোনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি, সাবসেক্টর কমান্ডার,মুজিব বাহিনী বা বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স সংক্ষেপে (বি এল এফ), নেত্রকোনা প্রেস ক্লাবের সহ সভাপতি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ-৭১, নেত্রকোণা জেলা-এর সহ সভাপতি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট)